মানুষের অবিমৃশ্যকারিতা ও প্রকৃতির প্রতিশোধ

প্রকৃতি স্থবির নয়, সে সজীব—এ কথা প্রায় সোয়া শ বছর আগে আমাদের জানিয়ে গেছেন আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু। এমনকি প্রতিটি বৃক্ষ অনুভূতিপ্রবণ, আঘাতে সে ন্যুব্জ হয়, ভালোবাসায় উৎফুল্ল হয়। যাকে আমরা আজ প্ল্যান্ট নিউরোবায়োলজি নামে অভিহিত করি, জগদীশ বসু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগেই সে বিজ্ঞানের সূত্রপাত করেছিলেন। সম্প্রতি প্রকাশিত জার্মান পরিবেশবিদ পিটার ওলেনবেন তাঁর সাড়া জাগানো দ্য হিডেন লাইফ অব ট্রিজ গ্রন্থে জগদীশ বসুর বলা সে কথাটাই নতুন করে ব্যাখ্যা করেছেন। 

সজীব প্রকৃতি মানে শুধু বৃক্ষ বা অরণ্য নয়। আমরা মানুষেরাও এই প্রকৃতির অংশ, অথবা এর সম্প্রসারণ। সবাই একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। একে অপরকে বাঁচতে সাহায্য করি। উদাহরণ হিসেবে ওলেনবেন আমেরিকার বিখ্যাত ইয়েলোস্টোন ন্যাশনাল পার্কের উল্লেখ করেছেন। এটি একসময় বিশুদ্ধ অরণ্য ছিল। যেদিন থেকে মানুষ সে অরণ্যের ওপর নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা শুরু করল, তখন থেকেই প্রকৃতি তার ভারসাম্য হারাতে শুরু করে। প্রথমে লোপাট হলো নেকড়ে। তাদের অবর্তমানে বহুগুণে বেড়ে গেল এল্ক বা বাঁকানো লম্বা শিংওয়ালা হরিণ। তারা চড়াও হলো সে অরণ্যের এসপেন, উইলো ও অন্যান্য পত্রবহুল উদ্ভিদসমূহের ওপর। তাদের আক্রমণে দ্রুত কমতে থাকল সেসব বৃক্ষরাজি; ফলে খাদ্যের খোঁজে সে অরণ্য থেকে পালাতে শুরু করল অন্য সব পশু ও পাখি। বিরান হয়ে উঠল একসময়ের বিস্তীর্ণ অরণ্য। ১৯২০ সালে ইয়েলোস্টোনকে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় উদ্যান ঘোষণার পর পরিকল্পিতভাবে ফিরিয়ে আনা হলো নেকড়েদের। ক্রমেই সজীব হলো বৃক্ষরাজি, ফিরে এল পশু-পাখি। নতুন জীবন ফিরে পেল ইয়েলোস্টোন। ওলেনবেনের কথায়, প্রকৃতির রক্ষক হিসেবে নেকড়ে মানুষের চেয়ে অনেক যোগ্য। সে কথা আবার সত্য প্রমাণিত হলো। 

প্রকৃতির রক্ষক হওয়ার বদলে আমরা যখন তার ভক্ষক হয়ে দাঁড়াই, তখন তার ফল কী ভয়াবহ হতে পারে, সে কথার আরেক উদাহরণ করোনাভাইরাস। এই অদৃশ্য ভাইরাসের আক্রমণে সারা বিশ্ব এখন এক অভাবিত বিপর্যয়ের মুখে। এখনো নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হয়নি, তবে অধিকাংশ বিজ্ঞানীর ধারণা, এই ভাইরাসের উৎস বাদুড় অথবা প্যাঙ্গোলিন নামক একটি ক্ষুদ্র বন্য প্রাণী। মধ্য চীনের উহান শহরের একটি তাজা মাছ-মাংসের বাজারে মুরগি ও অন্যান্য প্রাণীর পাশাপাশি বাদুড় ও প্যাঙ্গোলিন বিক্রি হতো। সারিবদ্ধ খাঁচার ভেতরে তাজা এসব জন্তু রাখা হতো, ক্রেতারা নিজ নিজ পছন্দমতো সেসব কিনে ঘরে ফিরতেন। এক প্রাণীর গা বেয়ে পড়া ঘাম ও লালা এসে মিশত অন্য প্রাণীর সঙ্গে। এদের অনেকগুলোর রোগগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এক প্রাণীর ভাইরাস অন্য প্রাণীর ভাইরাসের সঙ্গে মিশে নতুন এক ভাইরাসের জন্ম হওয়াও অস্বাভাবিক নয়। কেউ কেউ বলছেন, নতুন করোনাভাইরাসের সূত্রপাত এভাবেই হয়েছে। 

এশিয়ার অনেক দেশে, বিশেষত চীনে বাদুড় ও প্যাঙ্গোলিন উভয় প্রাণীই মানুষের খাদ্য হিসেবে পাওয়া যায়। এখানে অনেকের ধারণা, বিভিন্ন কঠিন অসুখের নিরাময় সম্ভব প্যাঙ্গোলিনের মাংস থেকে। অনেক দিন থেকেই বাদুড় বা প্যাঙ্গোলিনের মতো বন্য প্রাণীর বাজারজাত করা বা বিদেশে রপ্তানি নিষিদ্ধ। আর নিষিদ্ধ বলেই হয়তো এই অঞ্চলের বিভিন্ন দেশে, যেমন চীন, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় প্যাঙ্গোলিনের মাংস ও আঁশ-কাঁটা স্বাস্থ্যকর খাদ্য হিসেবে অত্যন্ত জনপ্রিয়। চীনের নব্য ধনীদের মধ্যে তো বটেই, সে দেশের সরকারি নেতাদের মধ্যেও আদা ও ধনেপাতার চাটনি বানিয়ে প্যাঙ্গোলিনের মাংস পরিবেশনের প্রতিযোগিতা হয়। এক হিসাবে দেখছি, ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে চীনা কর্তৃপক্ষ প্রায় ৯ টন প্যাঙ্গোলিনের কাঁটা ও আঁশ জব্দ করে। বস্তুত, প্যাঙ্গোলিন হচ্ছে বিশ্বের পাচারকৃত বন্য প্রাণীর মধ্যে এক নম্বর। 

বাদুড় ও প্যাঙ্গোলিন থেকে করোনাভাইরাসের উদ্ভব হয়ে থাকতে পারে—এই সন্দেহ থেকে গত ফেব্রুয়ারি মাসে চীনের জাতীয় কংগ্রেসে গৃহীত এক সিদ্ধান্তে এই সব প্রাণীর বাণিজ্যিক কেনাবেচা নতুন করে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। চীনের রাষ্ট্রপ্রধান সি চিন পিং পর্যন্ত এই জাতীয় বন্য প্রাণীর কেনাবেচার বিরুদ্ধে কঠোর নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করার তাগিদ দিয়ে বলেছেন, ‘এই ব্যাপারে আমরা আর চোখ বন্ধ করে থাকতে পারি না।’ 

কিন্তু বাদুড় বা প্যাঙ্গোলিন তো হাজার হাজার বছর ধরে বেঁচে আছে। কই, এত দিন তো কোনো করোনাভাইরাসের জন্য তাদের বিরুদ্ধে অপরাধীর তর্জনী উত্থিত হয়নি। এই প্রশ্নের জবাবে পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বলেছেন, অপরাধ বাদুড় বা প্যাঙ্গোলিনের নয়, মানুষের। যাদের প্রকৃতিতে স্বাধীনভাবে বিচরণের কথা, মানুষ সেই সব প্রাণী ধরে এনে গাদাগাদি করে খাঁচাবদ্ধ করে রেখেছে। যে অরণ্যে তাদের বিচরণের কথা, মানুষের আগ্রাসনের ফলে তাদের পরিমাণও কমে আসছে। বন্য প্রাণীর প্রাকৃতিক আবাসস্থলের ওপর মানুষের হামলার একটা ফল হয়েছে এই যে এই সব প্রাণীর গঠন প্রক্রিয়ায় বড় ধরনের ক্ষতিকর প্রভাব পড়েছে। বিজ্ঞানীরা এর নাম দিয়েছেন ‘জুনোটিক স্পিলওভার’। সিএনএনের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে ব্রিটিশ বন্য প্রাণী বিশারদ অ্যান্ড্রু কানিংহাম বলেছেন, মানুষের আগ্রাসী ব্যবহার বাদুড়ের মতো প্রাণীর ওপর প্রবল মানসিক (হ্যাঁ, মানসিক) চাপ সৃষ্টি করতে পারে। এর ফলে তার রক্তের গঠন ও তাপমাত্রা বদলে যেতে পারে। এই বাদুড়ের দেহ নিঃসৃত ভাইরাস উহানের বাজারে অনায়াসে অন্য প্রাণীর সঙ্গে মিশ্রিত হওয়ার সুযোগ পায়। এর ফলে যে নতুন ভাইরাসের জন্ম হয়, তা প্রাণী থেকে মানুষে ছড়িয়ে পড়ে। আর তারপর এক মানুষ থেকে দশ মানুষ, দশ থেকে হাজার, হাজার থেকে লাখ। বিজ্ঞানীরা বলছেন, উহানে প্রথম যে কয়জন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়, তার প্রায় সবাই সেই বাজারে কেনাবেচা করতে এসেছিলেন। 

এটা কি তাহলে প্রকৃতির প্রতিশোধ? প্রকৃতি যদি সজীব হয়, যদি তার অনুভূতি থাকে, তাহলে তার এমন প্রতিশোধে বিস্মিত হব না। লক্ষ লক্ষ বছর ধরে মানুষ ক্রমেই প্রকৃতির ওপর তার আধিপত্য বিস্তার করেছে। বন কেটে বানিয়েছে নগর, ভূগর্ভ থেকে হরণ করেছে গ্যাস, তেল ও কয়লা, নদীপথ পরিবর্তন করে নির্মাণ করেছে অতিকায় বাঁধ। প্রকৃতির ওপর এক কাল্পনিক বিজয় লাভ করে আমরা নিজেদের অজেয় ভেবেছি। কিন্তু এখন সর্বংসহা প্রকৃতি মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। পরিবেশ পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণতার ভেতর দিয়ে নিজের ক্রোধের প্রকাশ ঘটিয়েছে সে। 

প্রকৃতি একসময় প্রতিশোধ নেবে, এমন এক সম্ভাবনার কথা প্রায় দেড় শ বছর আগে উল্লেখ করে গেছেন ফ্রেডেরিখ এঙ্গেলস। প্রকৃতি প্রতিশোধ নিতে পারে, এমন কথা সম্ভবত তিনিই প্রথম বলেছিলেন তাঁর অসম্পূর্ণ ডায়ালেক্টিকস অব নেচার গ্রন্থে। তাতে তিনি প্রকৃতির বিরুদ্ধে ধাবমান মানুষকে এই বলে সাবধান করে দিয়েছিলেন, এতটা বাড়াবাড়ি করো না। মনে রাখবে, তোমাদের প্রতিটি বিজয় প্রকৃতির প্রতিশোধ হিসেবে তোমাদের কাছেই ফিরে আসবে। মেসোপটেমিয়া, গ্রিস ও রোম সাম্রাজ্য যেভাবে অরণ্য ধ্বংস করে নগর নির্মাণ করেছে, তার পরিণতি হয়েছে ভয়াবহ, এ কথা সুনির্দিষ্টভাবে তখনই উল্লেখ করেছিলেন এঙ্গেলস। বৈশ্বিক উষ্ণতা হয়তো তাঁর অজ্ঞাত ছিল, কিন্তু তিনিই প্রথম সমাজবিজ্ঞানী, যিনি অবিবেচক মানুষকে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন প্রকৃতির ওপর বল্গাহীন আক্রমণের ফল হবে বনজ সম্পদের ধ্বংস, সুপেয় জলের প্রবল সংকট ও শস্যভূমির অনুর্বরতা। প্রায় বিদ্রূপ করেই বলেছিলেন, আল্পস পর্বতমালার পাদদেশে হাজার বছর ধরে লালিত পাইন অরণ্য কেটে কৃষিক্ষেত্র বানানোর ফলে যে পাহাড়ি ঝরনা এই ভূমিকে উর্বর করেছে, তা নিঃশেষিত হবে। প্রাকৃতিক উর্বতার স্থান নেবে প্রবল বন্যা। আজকের পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে আমরা জানি, কী কঠোর সত্য উচ্চারণ করেছিলেন এঙ্গেলস। 

একটি আশার কথাও বলেছিলেন তিনি। মানুষকে তিনি পরামর্শ দিয়েছিলেন, আমরা যদি নির্দয় বিজেতা না হয়ে, বহিরাগত কোনো আক্রমণকারী না হয়ে প্রকৃতির অনুগত প্রজা হই, তাহলে সে আমাদের কেবল আশ্রয়ই দেবে তাই নয়, আমাদের রক্ষাকর্তাও হবে। তিনি আমাদের আশ্বস্ত করে বলেছিলেন, খুব বেশি কিছু নয়, এর জন্য প্রয়োজন শুধু প্রকৃতির আইন মেনে চলা। 

করোনাভাইরাসের মতো বিপর্যয় থেকে আরেকবার প্রমাণিত হলো, সে আইন মেনে না চললে কি নির্মম প্রতিশোধ নিতে পারে প্রকৃতি। 

হাসান ফেরদৌস প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক