জাতির জন্য একটা সামগ্রিক রূপকল্প থাকতে হয়

>
রওনক জাহান। ফাইল ছবি
রওনক জাহান। ফাইল ছবি
রওনক জাহান। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের ডিস্টিংগুইশ ফেলো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক। স্বাধীনতার ৪৯তম বার্ষিকী উপলক্ষে তিনি প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন এই দীর্ঘ সময়ে আমাদের অর্জন, ব্যর্থতা ও প্রত্যাশা নিয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিজানুর রহমান খান

প্রথম আলো: একাত্তরের ২৩ মার্চের কথা আপনার মনে আছে?

রওনক জাহান: হ্যাঁ, খুব মনে আছে। সেদিন আমার ছোট বোন নতুন জাতীয় পতাকা সেলাই করেছিল, সেই পতাকা আমরা আমাদের বাসায় তুলেছিলাম। সেদিনই ভেবেছি, স্বাধীন হয়ে গেছি। কিন্তু সেদিন মানুষের যে চেতনা ছিল, তার সঙ্গে আজকের মিল খুঁজি।

প্রথম আলো: দুই মার্চের মধ্যে বড় তফাত কী? চাওয়া-পাওয়ার?

রওনক জাহান: তখন এ দেশের মানুষ ছিল দরিদ্র, শিক্ষার হার ছিল কম। তখন বড় আশঙ্কা ছিল বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নতি কেমন হবে? এখন দেখি সেসব বিষয়ে আমাদের বেশ ভালোই উন্নতি হয়েছে। ১৯৭৩ সালে শ্রীলঙ্কা গিয়েছিলাম। সকালবেলায় চোখে পড়ল, মেয়েরা লাইন দিয়ে স্কুলে যাচ্ছে। তখন দুঃখ হলো শ্রীলঙ্কা অত উন্নত দেশ নয়, তবু মেয়েরা ইউনিফর্ম পরে স্কুলে যাচ্ছে। আর আমাদের এই চিত্র নেই। এখন গ্রামে-গঞ্জে তো আমরা এই দৃশ্য দেখি। অতএব আমাদের অনেক চাওয়া পূর্ণ হয়েছে। কিন্তু যেখানে অপূর্ণতা রয়ে গেছে, সেটা হচ্ছে আমাদের রাজনৈতিক ও শাসনব্যবস্থার ব্যাপারে। ১৯৭১ সালে গণতন্ত্র বা রাজনীতি নিয়ে আমাদের মনে কোনো দুশ্চিন্তা ছিল না। পাকিস্তানের ২৩ বছর আমরা গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছি। একটি অসাম্প্রদায়িক দেশ চেয়েছি। ধনী-দরিদ্রের তফাত থাকবে না। কিন্তু গণতন্ত্র, সুরাজনীতি ও সুশাসন নিয়ে দুশ্চিন্তা ছিল না। অথচ আজ ঘটেছে উল্টো। বরং গণতন্ত্রের অবনতি ঘটছে। শুরুতেই তিন-চার বছরের মাথায় আমরা সামরিক শাসনে পড়লাম। অবশ্য তারপর আমরা গত ৩০ বছর নির্বাচনী গণতন্ত্র অনুশীলন করলাম। তদুপরি গণতন্ত্র ও সুশাসনের ব্যাপারে উন্নতি নেই।

প্রথম আলো: এর কারণগুলো কী? আশু প্রতিকার

কিছু দেখেন?

রওনক জাহান: বাংলাদেশের ২৫ বছর পূর্তিতে বাংলাদেশের গণতন্ত্রহীনতা নিয়ে যা লিখেছিলাম, তার তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। কিছুটা অবনতি ঘটেছে। কারণগুলো বিস্তারিত আলোচনার বিষয়। সেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর বড় ভূমিকা আছে। তাদের মধ্যে গণতন্ত্রের চর্চা থাকতে হবে। অনেকগুলো চেক অ্যান্ড ব্যালান্সের বিষয় রয়েছে। শক্তিশালী নাগরিক সমাজ থাকা দরকার। তবে যখন স্বাধীন হলাম, তখন থেকেই আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা ছিল। নাগরিক সমাজও দুর্বল ছিল। কিন্তু সেসব শক্তিশালী করার পরিবর্তে আমরা একটা ব্যক্তিকেন্দ্রিক অ্যাডহক সমাধানে গিয়েছি। তারপর ক্রমাগতভাবে আমরা প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্বল করেছি।

প্রথম আলো: এসব দুর্বলতা নিয়ে ১৯৯০ সালে আমরা সামরিক স্বৈরাচারকে বিদায় দিয়েছি। তদুপরি উন্নতি থেমে থাকেনি। এখন প্রশ্ন উঠছে, এগুলো খুব জরুরি কি না? কারণ, এগুলো দুর্বল রেখেও মধ্যম আয়ের দেশে, বড় প্রবৃদ্ধির দিকে দেশকে নিয়ে যাওয়া যায়।

রওনক জাহান: উন্নয়ন বলতে কিছু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয়তো বেড়েছে। কিন্তু আমাদের ভাবতে হবে, পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে যখন আমরা স্বাধিকার আন্দোলন করেছিলাম এবং ১৯৭১ সালে যখন স্বাধীনতার সংগ্রাম করেছিলাম, তখন আমাদের লক্ষ্য কী ছিল? জাতির
জন্য একটা সামগ্রিক রূপকল্প থাকতে হয়। এর পরিবর্তে আয় দিয়ে যাচাই করা একটি সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি। বেশি আয়, আয়েশ, দালানকোঠা, রাস্তাঘাট দিয়ে সেই স্বপ্নের গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক শোষণহীন ব্যবস্থা পরিমাপযোগ্য নয়। আমরা অবশ্যই সবাই উন্নয়ন চাইছি। কিন্তু একই সঙ্গে আমরা সুশাসন, একটি সিস্টেমের মধ্যে থাকতে চাই। এই যে যুক্তি দেওয়া হচ্ছে দুর্নীতি থাকুক, উন্নয়ন হোক। কিন্তু দুর্নীতি বিপুলসংখ্যক মানুষের ক্ষতি করে। আমরা তো একটা দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবস্থার মধ্যে থাকতে চাই না। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে আমরা বলি, আইনের
শাসন চাই, ব্যক্তি শাসন নয়। তার কারণ, ব্যক্তি ক্ষণস্থায়ী, আইন স্থায়ী।

প্রথম আলো: এই কথাগুলো পণ্ডিতজনেরা বলেন এবং পাঠ্যপুস্তকে থাকে। সমকালীন বাংলাদেশে গুণীজনেরাও এটা কম মানছেন বা এতে বিশ্বাস হারাচ্ছেন বলে প্রতীয়মান হয়। দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া কর্তৃত্ববাদী শাসনে তৈরি।

রওনক জাহান: কিন্তু আপনি তাই বলে আইনের শাসনের সঙ্গে কর্তৃত্ববাদী শাসন মিশ্রিত করতে পারেন না। আপেল ও কমলালেবুর মিশ্রণ ঘটে না। কেউ কর্তৃত্ববাদী হতে পারেন, কিন্তু সেখানে সেই সঙ্গে শাসনের জন্য তাঁরা একটা দৃশ্যমান এবং বিশ্বাসযোগ্য সিস্টেম ও রুলস তৈরি করেছেন। এভাবে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করেছেন। আফ্রিকায় কিছু দেশে দেখি, কর্তৃত্ববাদী শাসনই আছে, কিন্তু দৃশ্যমান আইনের শাসন নেই। সিঙ্গাপুরে কর্তৃত্ববাদী শাসন রয়েছে। কিন্তু তারা একটি আইনের শাসন দৃশ্যমান করতে পেরেছে। একটি সিস্টেম ও আইনের শাসনের মাধ্যমে সিঙ্গাপুর ও দক্ষিণ কোরিয়ায় টেকসই উন্নয়ন হয়েছে।

প্রথম আলো: তাহলে কি আপনি বলবেন বাংলাদেশে সেই সিস্টেমের ঘাটতি রয়েছে? আর অনেকে আমাদের সিস্টেমহীন কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থা নিতে বলছেন। অনেকে বলছেন, গণতন্ত্র কম নাও, বেশি নাও উন্নয়ন।

রওনক জাহান: (হাসি) আমাদের তো বলা হচ্ছে, আমাদের দুটোই আছে।

প্রথম আলো: আপনার তাতে সায় আছে কি?

রওনক জাহান: আমাদের সুশাসন, আইনের শাসন ও গণতন্ত্রে অনেক ঘাটতি রয়েছে। আপনি যদি দেখেন, ১৯৯০-এর দশক থেকে যত ধরনের গণতন্ত্রবিষয়ক সূচক পৃথিবীর যখন যেখানে তৈরি হয়েছে, তাতে সব সূচকেই আমরা নিচের দিকে। বিশেষ করে আইনের শাসনে আমরা একদম ওপরে উঠতেই পারছি না। নব্বইয়ের দশকে আমরা বাক্‌স্বাধীনতা ও নাগরিক সমাজের সূচক, যাকে আমরা কণ্ঠস্বর সূচক বলি, তাতে কিছুটা ওপরে উঠেছিলাম। সেখান থেকেও আমরা পড়ে যাচ্ছি।

প্রথম আলো: শুধু রাজনীতিবিদদের দায়ী করবেন? নাকি নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যম বা সমাজের অন্য অংশীজনেরও তাতে দায় রয়েছে?

রওনক জাহান: দায় সবারই আছে। কিন্তু যখন যারা রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকে,তখন তাদের একটা অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হয়।

প্রথম আলো: বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রের ঘাটতি বা মৃত্যুঘণ্টা, যা আমরা প্রতিনিয়ত দেখি, শুনি।

রওনক জাহান: এটা ঠিক যে বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রের সংকট চলছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো একজন ব্যক্তি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হয়েছেন। নরেন্দ্র মোদি ও দুতার্তে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হয়েছেন। একটা দীর্ঘ সময় সামনের সারিতে থাকা উদারনৈতিক লোকেরা কেবল নির্বাচননির্ভর গণতন্ত্রে মোহাচ্ছন্ন থেকেছেন। ৩০ বছর ধরে এ দেশে উদারনৈতিক গণতান্ত্রিকমনা লোকের সামনেও গণতন্ত্রের সমূহ ঘাটতি ঘটে গেছে। কিন্তু গণতন্ত্রের এসব ঘাটতির ব্যাপারে ততটা সোচ্চার হননি এই উদারনৈতিক গণতন্ত্রীরা। এখনকার শূন্যতা, সেই নীরবতার ফল।

প্রথম আলো: ভারতে কংগ্রেস দীর্ঘকাল শাসন করেছে। সেখানে টানা নির্বাচননির্ভর গণতন্ত্র। কখনো সংবিধানের ভেঙে পড়াও দেখেনি। তদুপরি সেখানে তো ধর্মীয় জাতীয়তাবাদীদের উত্থান ঘটল। আমরা তার সম্ভাব্য প্রভাবে ভয় পাব না?

রওনক জাহান: আমরা যদি ইংল্যান্ড বা আমেরিকার মতো উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের দিকে তাকাই, তাহলে দেখি তারা সিভিল ও রাজনৈতিক অধিকারের অনেক কথাই বলছে। কিন্তু বাস্তবে তারা (ভারতসহ) দেখাচ্ছে, কিছু লোকের হাতেই অনেক টাকাপয়সা, সম্পদ জমে যাচ্ছে। ভারতে ওপরে নির্বাচন, আড়ালে পেশি ও টাকার খেলা চলেছে। অথচ পঞ্চাশের দশকে আমাদের এখানে যাঁরা নির্বাচিত হয়েছিলেন, তাঁরা এই খেলা চিনতেন না। টাকার খেলায় আমেরিকা এতটাই ওপরে যে টাকা না থাকলে কারও জন্য প্রাইমারির কপাট বন্ধ। উদারপন্থীরা দেখেছিলেন, গণতন্ত্রের মূল অনুষঙ্গগুলোতে (ইনস্ট্রুমেন্ট) দুর্নীতি ঢুকে পড়েছিল, কিন্তু তারা নির্বিকার থেকেছে। এর ফলে আজ ডেমাগগ বা বাগাড়ম্বরকারীরা মানুষকে যা-তা বুঝিয়ে ‘নির্বাচিতের’ তকমা জুটিয়ে নিচ্ছে। এ থেকে বেরোতে হলে শুধু রাজনৈতিক গণতন্ত্র নয়, অর্থনৈতিক গণতন্ত্র লাগবে। আর্থিক গণতন্ত্রের মানে একদমই এক দিনের ভোট দেওয়ার বিষয় নয়। যাঁরা ভোট দিচ্ছেন এবং যাঁরা নির্বাচিত হচ্ছেন। তাঁদের মধ্যে অর্থনৈতিক দূরত্ব ক্রমাগত বাড়ছে। জনপ্রতিনিধিরা সাধারণ জনগণের সুখ-দুঃখ কতটা জানেন, তাদের উন্নতির জন্য কতটা চেষ্টা করছেন, সেটা দেখতে হবে। এসব বুঝে দরকারি পদক্ষেপ নিতে উদারপন্থী সচেতন মহল খুব বেশি দেরি করে ফেলেছে। তাই গোটা বিশ্বেই একটা ধস নেমেছে। বিশ্বটাই এখন এক গভীর রাজনৈতিক সংকটে।

প্রথম আলো: একেক দেশের রাজনীতি একেক রকম থাকবে। কিন্তু আমাদের ঘাটতি গভীরতর করতে কে বেশি ভূমিকা রাখল? বৈশ্বিক নাকি অভ্যন্তরীণ কারণ?

রওনক জাহান: কোভিড-১৯ পরিস্থিতি আমাদের দেখাচ্ছে যে পৃথিবী থেকে আমরা বিচ্ছিন্ন নই। বিশ্বায়ন ও বৈশ্বিক প্রভাব সবখানেই রয়েছে। আমি বলব, আমাদের যেটা সমস্যা, সেটা গোড়াতেই আমাদের দলসহ প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা থাকা এবং তা আর মেরামত করতে অপারগ থাকা। ভারতে স্বাধীনতার পরে বহু বছর ধরে তারা স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের একটা সুযোগ পেয়েছিল। ও রকম একটা সুযোগ আমরা কখনোই প্রায় পাইনি। তাই আজকের সংকটের মধ্যেও সেখানে একটা প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর, সড়কে মানুষ দাঁড়াতে পারে। শাহিনবাগ তার সর্বশেষ উদাহরণ। আমরা এমনটা পারি না।

প্রথম আলো: আপনি গোড়ার দুর্বলতার ওপর এতটা জোর দিচ্ছেন?

রওনক জাহান: নিশ্চয়। যদি তারা গোড়ায় খুবই শক্তিশালী থাকত, তাহলে ১৯৭৫ সালে এত সহজে সেনাবাহিনী ক্ষমতা নিতে পারত না। আমাদের সব প্রতিষ্ঠানই দুর্বল ছিল, রাজনৈতিক দল, প্রশাসন, সামরিক বাহিনীতে অনেক কোন্দল ছিল। মাস মবিলাইজেশনের সামর্থ্য শুধু দলেরই থাকে, পঁচাত্তরে যা কাজে আসেনি।

প্রথম আলো: সাম্প্রতিক কালে একজন মার্কিন গবেষক বলেছেন, বাংলাদেশে রক্ষণশীল ইসলামের উত্থান ঘটছে।

রওনক জাহান: ওই গবেষক হয়তো একটা সমীক্ষার ভিত্তিতে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন। কিন্তু আমাদের দেশে আমরা অনেক সময় অনেক কথা বলি, যা অনুমাননির্ভর।

প্রথম আলো: এবার আমরা স্বাধীনতা দিবস উদ্‌যাপন করছি মুজিব বর্ষে। সুতরাং এর একটি ভিন্ন মাত্রা রয়েছে। আপনি কীভাবে দেখছেন?

রওনক জাহান: আমি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অনেক পড়ছি। লিখছিও। তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীআমার দেখা নয়াচীন, তাতে তিনি দেখিয়েছেন যে তখনকার সময়ে কী করে কিছু লোক টাকাপয়সা খেয়ে ইসলামকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করেছে। তখন তিনি অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে এর বিরুদ্ধে বলতে পেরেছিলেন। তিনি বারবার বলে গেছেন যে ইসলাম তো বলেনি, দ্বিমত পোষণের জন্য কাউকে খুন করা যায়। তিনি ইসলামের উদারনৈতিক ব্যাখ্যা দিতে পেরেছিলেন। এবং যাঁরাই স্বাধিকার আন্দোলনের সঙ্গে ছিলেন, তাঁরা সেটাকে ধারণ করেছিলেন। তাঁরাও সবাই এমনই চিন্তার অধিকারী ছিলেন। তাঁরা বলতেন, ধর্মের অনুশীলন একটি ব্যক্তিগত ব্যাপার। রাষ্ট্রে সব নাগরিকের সমান অধিকার। এখন খালি চোখে আমি যে পরিবর্তনটা দেখি, আমাদের দেশের মানুষ অতীতে ধর্মকর্ম পালন করতেন সাধারণভাবে। কিন্তু আমরা এখন দেখি এর একটা বাহ্যিক বিষয় আছে। মানুষ বেশ খরচ করে। লৌকিকতানির্ভর ধর্মকর্ম করেন অনেক মানুষ। আগে মেয়েরা নীরবে মাথায় কাপড় দিতেন। এখন হিজাবের ব্যাপক ব্যবহার। অবশ্য এটা দেখেই এই উপসংহারে পৌঁছানো যাবে না যে মেয়েরা হিজাব পরছে, তাই তারা রক্ষণশীল হয়ে যাচ্ছে। হিজাব পরা মেয়েরাও তো ভীষণ স্মার্ট। সাহসিকতার সঙ্গে তারা বাকপটু, জীবন সম্পর্কে তাদের রয়েছে স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি। আমি এটাও শুনেছি যে গ্রামগঞ্জে নারীর বিরুদ্ধে অনেক সহিংসতা বেড়ে গেছে। আর তাই সুরক্ষার জন্য তারা হিজাব পরাকে গুরুত্ব দিচ্ছে। তাই কিছু বিষয় দেখেই সমাজ রক্ষণশীলতার দিকে যাচ্ছে, সেটা বলা যায় না।

প্রথম আলো: ধর্মীয় গোষ্ঠীর সঙ্গে অন্যায্য আপসকামিতা।

রওনক জাহান: আগের থেকে বিরাট যে তফাত দেখতে পাই, বৈচিত্র্যকে মানুষ অনেক বেশি সহিষ্ণুতার সঙ্গে দেখত। সেই যুগে আমরা ভাবিনি যে একজন মুসলমান আরেকজন মুসলমানের কাছে প্রমাণ দিতে হবে যে সে গুড মুসলিম কি না। আমরা সে যুগে মুরতাদ কথাটাই শুনিনি। আমি এখন যেটা দেখতে পাই সেটা হচ্ছে, সহিষ্ণুতা কমেছে। একজন মুসলমান কিছু ক্ষেত্রে কত সহজেই শুধু তার বিবেচনায় ভালো মুসলিম নয় বলেই তাকে সে খুন করতে পারে। ধর্মীয় লোকাচার আড়ম্বরপূর্ণ হয়েছে। কথা হচ্ছে, এই যাঁরা এমনটা করছেন, তাঁদের কি রক্ষণশীল বলব নাকি বলব না? আধুনিক সমাজব্যবস্থায় মেয়েরা স্কুল-কলেজে যাচ্ছে, চাকরিতে যাচ্ছে। এ নিয়ে আসলে আমাদের আরও গবেষণা, সমীক্ষা এবং আলোচনা হওয়া দরকার।

প্রথম আলো: আমাদের যে গণতন্ত্রের ঘাটতি চলছে, তার কোনো প্রভাব কি এ–সংক্রান্ত ধ্যানধারণার মধ্যে পড়েছে?

রওনক জাহান: আমি যে নেতিবাচক দিকটার দিকে পুনর্বার গুরুত্ব দেব, সেটা হলো সমাজে অসহিষ্ণুতা বৃদ্ধি পাওয়া। সেটা শুধু ধর্মের জায়গা থেকে নয়, রাজনৈতিকভাবেও ভিন্নমত পোষণকারীদের বিষয়ে অসহিষ্ণুতার প্রকাশ ঘটছে। গণতন্ত্র মানেই হলো যে আপনি ভিন্নমত মানবেন। বহুত্ববাদ মানবেন। সামাজিক বৈচিত্র্য মানবেন। আপনি আমাকে একজন তাত্ত্বিক বলতে পারেন। কিন্তু কথাটা হচ্ছে যে ‘সংখ্যালঘুর সম্মতির ভিত্তিতে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন হলো গণতন্ত্র।’ কিন্তু সংখ্যালঘু ও তাদের ভিন্নমতের প্রতি অসহিষ্ণুতা বেড়ে গেলে আর গণতন্ত্র থাকল না।

প্রথম আলো: বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দল নানাভাবে নিস্তেজ অবস্থায় রয়েছে। এমন চেপে রাখা দীর্ঘায়িত হলে কোনো বিপদ আসতে পারে কি না?

রওনক জাহান: ১৯৯১ সালের পর থেকেই দুটি বড় রাজনৈতিক দলের মধ্যে যখন ক্ষমতা বণ্টন চলছিল, তখন মনে হয়েছিল এটা একটা ভালো দিক। আমরা হয়তো একটা দ্বিদলীয় ব্যবস্থার দিকে যাচ্ছি। তখন একে অপরকে নিয়ন্ত্রণ করবে। অনেক সমাজেই প্রধানত দুটো বিপরীত আদর্শের বৃহৎ দল থাকে। কিন্তু গণতান্ত্রিক পরিবেশে তাদের মধ্যে একটা সমঝোতা থাকে। বিএনপির ভারতবিরোধিতা এবং ধর্মাশ্রয়ী সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল ছাড়া অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে দুই বড় দলের তফাত নেই। বাক্‌স্বাধীনতা যদি থাকে, তাহলে এই সব ভিন্নমত নিয়ে আলোচনা করা যায়। আলোচনা করেই ধর্মীয় এবং অন্যান্য উগ্রবাদকে হারানো যায়। আমরা গণতান্ত্রিকভাবেই ধর্মান্ধতাকে পরাস্ত করেছিলাম সত্তরের নির্বাচনে। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতেও এ কথাই বলা। বঙ্গবন্ধুর কাছে যখন জানতে চাওয়া হলো তখন তিনি বললেন যে বিরোধী দলের দরকার রয়েছে। কারণ, বিরোধী দল না থাকলে ক্ষমতাসীন দল স্বৈরতান্ত্রিক হয়ে যায়।

প্রথম আলো: আপনি বঙ্গবন্ধু থেকে অনেক পড়েছেন। কিন্তু আজকে আমাদের পাঠকদের জন্য এমন কিছু বিষয় বলুন, যা সমকালীন বাংলাদেশের জন্য তাৎপর্য রয়েছে।

রওনক জাহান: আমাদের জাতীয় চার নীতির বিষয়ে তাঁর বোঝাপড়াটা তিনি অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বলেছেন। তিনি বারবার বলেছেন, প্রেস ফ্রিডম দিতে হবে। এটা আপনি কারাগারের রোজনামচা পড়লেও দেখতে পাবেন। কারণ, তিনি বলেছেন, আমরা গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক রাজনীতিতে বিশ্বাসী। আর সে কারণেই বাক্‌স্বাধীনতা, সমাবেশের স্বাধীনতা থাকতে হবে। ১৯৪৯ থেকে ১৯৫২ পর্যন্ত তাঁকে যে কারাগারে রাখা হয়েছিল, তা তাঁর বিরুদ্ধে কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়াই জননিরাপত্তা আইনে। সিভিল রাইটসের ওপরে বঙ্গবন্ধু বেশি জোর দিয়েছেন। গণতন্ত্র ও ভোটের ওপর জোর দিয়েছেন। কারণ, তিনি মনে করতেন যে প্রতিষ্ঠানকে জনপ্রতিনিধিত্বশীল হতে হবে। গণতন্ত্র ও ভোটের অধিকার নিয়ে অনেক লেখা আছে। তিনি লিখেছেন যে পাকিস্তান আন্দোলন তিনি করেছিলেন। কিন্তু বারবার লিখেছেন, খাজা নাজিমুদ্দিনের মুসলিম লীগ ভূস্বামীদের। আর আমরা গণতন্ত্র চাইছি কৃষকদের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য। তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীআমার দেখা নয়াচীন-এ এসব বিষয় খুব পরিষ্কার। তিনি লিখেছেন, ‘আমি কমিউনিস্ট নই। কিন্তু আমি সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি।’ প্রশ্ন হলো, সমাজতন্ত্র বলতে তিনি কী বুঝেছিলেন? কয়েকটা খুব সহজ বিষয়। ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে বিরাট তফাত থাকবে না। সেটা তিনি পঞ্চাশের দশকে বলেছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরেও বলেছেন। মানুষ ও মানুষের মধ্যে একটা বিরাট অর্থনৈতিক বৈষম্য থাকতে পারবে না।

প্রথম আলো: সেই বৈষম্য পাহাড়সমান।

রওনক জাহান: সেটা আপনি বলতে পারেন। আজকের রাজনৈতিক ডিসকোর্স থেকে শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা ও শোষণ-শোষকের কথা একদম উঠে গেছে। অথচ বারবার তিনি লিখেছেন, জমিদার ও মহাজনেরা শাসকশ্রেণি। এই গরিব লোকদের এই শোষণের হাত থেকে উদ্ধার করতে হবে। চীনে গিয়ে তিনি দেখেছেন, চীন কৃষকদের মধ্যে ভূমি বণ্টন করেছে। চীন সব স্কুল ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করেছে। তিনি এসবের প্রতি তাঁর অত্যন্ত শক্তিশালী সমর্থন ব্যক্ত করেছেন। তিনি বই পড়ে সমাজতন্ত্রী ছিলেন না। তাঁর কতগুলো পরিষ্কার ধারণা ছিল। মূলমন্ত্র ছিল, ধনী-দরিদ্রের বড় তফাত থাকবে না। ক্লাস এক্সপ্লয়েটেশন থাকবে না। সরকারের দায়িত্ব সম্পদের সুষম বণ্টনের এবং স্বাস্থ্যসেবাসহ জীবনযাপনের মৌলিক উপাদানগুলো নিশ্চিতকরণের। এই বিষয়গুলো এখন স্ক্যান্ডিনেভিয়ান অনেক দেশেই দেখা যাবে। তারা গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। আবার এই ধরনের সমাজতান্ত্রিক ধাঁচের ব্যবস্থাও নিশ্চিত করেছে। ধর্মনিরপেক্ষতার যে নীতি তিনি গ্রহণ করেছিলেন তার সারকথা ছিল, যেকোনো ধরনের সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিরুদ্ধাচরণ। মুসলমানরা একটা আলাদা সম্প্রদায়, তিনি সেটা স্বীকার করছেন।

কিন্তু হিন্দু-মুসলিম বিভাজনের তিনি অত্যন্ত বিরোধী ছিলেন। তিনি লিখেছেন, পাকিস্তান হওয়ার পরে সব নাগরিকের সমান অধিকার থাকবে। এটা তিনি বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও বলেছেন। বলেছেন, ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। সবাই নিজ নিজ ধর্ম পালন করবেন। ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। রাষ্ট্রভাষা বাংলা যারা চেয়েছে, তাদের পাকিস্তানিরা হিন্দুঘেঁষা হিসেবেই দেখত। শেখ মুজিব তাত্ত্বিক ছিলেন না। তিনি খেতখামার থেকে উঠে আসা মানুষের নেতা ছিলেন। যখন কাদিয়ানিবিরোধী সহিংসতা হলো, তখন তিনি শক্তভাবে বলেছেন, একজন মুসলমান আরেকজন মুসলমানকে হত্যা করতে পারে না। বলেছেন, ধর্মের নামে কাউকে হত্যা করা পাপ। সারা জীবন ধরেই তিনি এসব বিষয়ে একটা ধারাবাহিক শক্ত অবস্থানে ছিলেন। তাঁর এই বইগুলো তো সবার হাতেই রয়েছে। তাঁর কী কী নীতি-আদর্শ ছিল, সেটা তো খুবই স্পষ্ট। এখানে একটা প্রশ্ন উঠতে পারে, তিনি সারা জীবন রাজনীতি করেছেন ক্ষমতার বাইরে থেকে। কিন্তু ক্ষমতায় এসে তাঁর জন্য সেসব বাস্তবায়ন করা ছিল কঠিন কাজ।

প্রথম আলো: মুজিব বর্ষে আপনি বঙ্গবন্ধুর মৌলিক নীতি-আদর্শের কথা বললেন। কিন্তু তার সঙ্গে মিলিয়ে যদি আজকের আওয়ামী লীগের একটা তুলনা করেন।

রওনক জাহান: আমি তো সেটাই বলি, ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য ঘোচানোর যে আউটলুক তাঁর ছিল, সেখানে আওয়ামী লীগ নেই। অর্থনৈতিক উন্নতি বলতে তারা এখন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ওপরে অনেক বেশি জোর দিচ্ছে। তারা অবকাঠামোগত উন্নয়ন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সুবিধার উন্নয়নে নজর দিচ্ছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু যে বৈষম্য দূরীকরণের কথা বলেছিলেন, সেখানে তাদের দেখা যায় না। চূড়ান্ত বিচারে আমাদের সমাজের দিকে তাকাতে হবে। উন্নয়নের মধ্যে কী ধরনের মানুষ আমরা হয়ে উঠছি। আমাদের অনেক টাকাপয়সা হচ্ছে, এটাই তো একমাত্র লক্ষ্য হতে পারে না। বঙ্গবন্ধু এই যে একটা ধারাবাহিক অবস্থান নিয়ে রাজনীতি করেছেন, সেই বিষয়ে আওয়ামী লীগ অবস্থান নিচ্ছে না।

প্রথম আলো: সর্বশেষ প্রশ্ন। প্রধান বিরোধী দলের নেতা মুক্তি পেয়েছেন।

রওনক জাহান: রাজনৈতিক সমঝোতার পথে একে একটি ভালো পদক্ষেপ হিসেবে দেখছি। এতে একটা মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিরও প্রতিফলন ঘটেছে।

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

রওনক জাহান: ধন্যবাদ।