এখনই আসুক লকডাউন

আমার একবার হঠাৎ করে ভার্টিগো (মাথা ঘোরা) শুরু হলো। ১০ থেকে ১১ বছর আগের ঘটনা এটা। হতভম্ব হয়ে দেখি সবকিছু ঘুরছে লাটিমের মতো। এমনকি শুয়ে থাকলেও কমছে না কিছু। বিছানার চাদর খামচে ধরে ধরে উঠলাম। ‘বড়’ একজন ডাক্তার আমাকে অনেক যত্ন করে পরীক্ষা করলেন। একগাদা ওষুধ দিলেন। ওষুধ খেয়ে ভার্টিগো কমল, কিন্তু এত দুর্বল হয়ে গেলাম যে নড়তে পারি না আর। 

কয়েক দিন পর গেলাম নাক–কান–গলা বিশেষজ্ঞ ডা. জাহির আল-আমীনের কাছে। তিনি টিভিতে আমার টক শো দেখতেন। দেশের অবস্থা জিজ্ঞেস করলেন, কিছু হাসিঠাট্টা করলেন। তারপর আমাকে একটা বিছানায় শোয়ালেন। মুখ কাত করে একদিকে ঘুরিয়ে চাপ দিয়ে ধরে রাখলেন। বিস্মিত হয়ে এ অবমাননা সহ্য করলাম। একপর্যায়ে তিনি হাত সরালেন, আমাকে বাসায় চলে যেতে বললেন।

আমি বললাম: ওষুধ? তিনি বললেন: ওষুধ লাগবে না। আপনি ভালো হয়ে গেছেন।

তার মানে?

ভালো হয়ে গেছেন।

টেনিস খেলতে পারব?

হ্যাঁ।

আজকে পারব?

এখনই পারবেন।

বুকভরা অবিশ্বাস নিয়ে আমি তাঁর কক্ষ থেকে বের হলাম, সিঁড়ির দিকে হাঁটা শুরু করলাম, সিঁড়ি দিয়ে নামলাম। একটুও ঘুরছে না আমার মাথা। তিনি আমাকে বলেছিলেন নাকের একটা ময়লা কোথাও আটকে ছিল বলে আমার ভয়াবহ মাথা ঘুরছিল। কাত করে ধরে রেখে তিনি এটা কানের ভেতরে কোথায় যেন নিয়ে এসেছেন। ব্যস, আমার সমস্যা শেষ!

এ অবিশ্বাস্য গল্প ততক্ষণে বিশ্বাস করা শুরু করলাম। সাহস করে লন-টেনিসও খেললাম সে রাতে।

এভরিথিং নরমাল!

এ গল্পটা ডাক্তার হিসেবে ডা. জাহির আল-আমীনের মাপ বোঝানোর জন্য। এটাও বলার জন্য যে তাঁর ওপর সেদিন থেকে আমার অগাধ বিশ্বাস। তিনি একটি সর্বাধুনিক হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেছেন সম্প্রতি। এ বছর ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথমে সেখানে আমার নাকের অপারেশনের পর তিনি বলেছিলেন, ২৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে করোনা মরে যায়, এটা ভুল। বলেছিলেন বাংলাদেশে করোনা আসবেই। বলেছিলেন, এ রোগের চিকিৎসা এমনকি শনাক্তকরণের ন্যূনতম কোনো অবকাঠামো নেই এ দেশে।

দুদিন আগে তাঁর সঙ্গে কথা হলো। অনেক অঙ্ক করে, অনেক ব্যাখ্যা দিয়ে বোঝালেন কমপ্লিট লকডাউন ছাড়া কোনো গতি নেই বাংলাদেশে এখন আর। ২৮ থেকে সর্বোচ্চ ৩৫ দিন পর্যন্ত সারা বাংলাদেশের সব মানুষ নিজ নিজ বাসায় অবস্থান করলে (কমপ্লিট লকডাউন) করোনার প্রকোপ থেকে বহুলাংশে বাঁচব আমরা। কেন ২৮ দিন, কীভাবে একজন করোনা রোগী প্রায় তিনজনকে সংক্রামিত করে, কীভাবে এ সংখ্যা বাড়তে বাড়তে একসময় বাংলাদেশে কয়েক কোটি লোক সংক্রামিত হতে পারে, তা বোঝালেন। তবে কমপক্ষে ২৮ দিন সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন থাকলে ক্ষতি হবে অনেক কম। কারণ, এর মধ্যে করোনা রোগী এবং তার বাড়িতে তার মাধ্যমে সংক্রামিত পরিবারের সদস্যদের প্রায় সবার করোনা সেরে যাওয়ার কথা (মৃত্যু হবে ৩ শতাংশের মতো)।


ডা. জাহিরের ব্যাখ্যা অনুসারে আমি একটি উদাহরণ দিচ্ছি। ধরা যাক, এ মুহূর্তে বাংলাদেশে করোনায় আক্রান্ত আছে ৫০ হাজার মানুষ। কমপ্লিট লকডাউন হলে তাঁরা সংক্রমণ করবেন আরও দেড় লাখের মতো মানুষকে। তাহলে এ তিন লাখ লোকের মধ্যে ৩ শতাংশ হিসাবে মারা যাবেন প্রায় ৯ হাজার মানুষ।

আর কমপ্লিট লকডাউন না হলে? সে ক্ষেত্রে ক্রমান্বয়ে ও অব্যাহতভাবে সংক্রামিত হতে পারে কয়েক কোটি মানুষ। মারা যাবে কয়েক লাখ মানুষ। কমপ্লিট লকডাউনের ‍তুলনায় এ সংখ্যা কমপক্ষে এক শ গুণ বেশি হবে।

লকডাউন হলে ১০ হাজার মানুষ, নাহলে কমপক্ষে ১০ লাখ মানুষ। হিসাবটা মোটামুটি এ রকম।

ডা. জাহিরের ব্যাখ্যা শুনে আমি শিউরে উঠি। আমি বিশ্বাস করি সবার তা হওয়া উচিত।

তাঁর আশঙ্কার ভিত্তি থাকলে কমপ্লিট লকডাউন শুরু হোক এখনই। লকডাউনের ২৮ দিন দেশের নিরন্ন মানুষকে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করবে সরকার। পশ্চিমবঙ্গে এ রকম করা গেলে তার চেয়ে দ্বিগুণ বড় বাজেটের দেশ বাংলাদেশে কেন তা করা যাবে না? প্রয়োজনে আমরা সবাই এগিয়ে আসব। আমরা ঢাবির শিক্ষকেরা দুদিনের বেতন দান করলে তা হয় কোটি টাকার বেশি।

দুদিন কেন, প্রয়োজনে আমি আমার এক মাসের বেতন দিতে রাজি আছি। এ সমাজে আমার চেয়ে অনেক বড় মনের মানুষও আছে বহু। এ সমাজে বড় বড় কোম্পানি ও ব্যবসায়ী গোষ্ঠী আছে। আছেন বিত্তশালী গার্মেন্টস মালিকেরা। সবাই মিলে হতদরিদ্র এক কোটি পরিবারকে এক মাস খাওয়াতে পারব না আমরা? নিশ্চয়ই পারব।

সরকার আন্তরিকভাবে উদ্যোগ নিলে এগিয়ে আসবে সবাই।

আমি সাধারণ মানুষ। আমার ধারণা এ উদ্যোগের বিকল্প নেই। কমপ্লিট লকডাউন ছাড়া আমাদের গতি নেই কোনো। বিমানবন্দর অরক্ষিত রেখে, প্রবাসীদের হিসাব না রেখে, তাঁদের হোম কোয়ারেন্টিন না বুঝিয়ে, ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় জনসমাগম করে, ঢাকা থেকে গিজগিজে অবস্থায় মানুষকে সারা দেশে ছড়িয়ে দিয়ে অনেক সর্বনাশ করা হয়েছে ইতিমধ্যে। এ রাষ্ট্রের সামর্থ্য নেই বিপুলসংখ্যক মানুষকে চিহ্নিত–শনাক্ত করার। যা আছে খুব যৎসামান্য, যতটুকু বাড়ানো যাবে তাও খুব অপ্রতুল।

তা–ই যদি হয়, কমপ্লিট লকডাউন শুরু করতে হবে অনতিবিলম্বে।

আসিফ নজরুল: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক