গ্রামগুলোকে ভাইরাসমুক্ত করার চ্যালেঞ্জ

এবারকার স্বাধীনতা দিবস আমরা ভিন্নভাবে পালন করলাম। এই পালনে কোনোরূপ অনুষ্ঠান-আনুষ্ঠানিকতা ছিল না। এবার ঘরে বসে আমাদের প্রিয়জনদের সঙ্গে এ গুরুত্বপূর্ণ দিনটি নীরবে আমরা পালন করলাম। এর ফলে এবার সুযোগ হলো আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগের কথা একাগ্রচিত্তে স্মরণ করতে এবং তা নিয়ে ভাবতে। স্মরণ করতে সেই ‘সকল মহান আদর্শ (যেগুলো) আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে আত্মনিয়োগ ও বীর শহীদদিগকে প্রাণোৎসর্গ করিতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা’। আরও স্মরণ করতে যে তাঁদের এই আত্মত্যাগের পেছনে উদ্দেশ্য ছিল একটি সুখী, সমৃদ্ধশালী ও শান্তিপূর্ণ বাংলাদেশ সৃষ্টি, ‘যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিল সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে’ (বাংলাদেশ সংবিধানের প্রস্তাবনা)। প্রসঙ্গত, মৌলিক মানবাধিকারের মধ্যে জীবনের বা বেঁচে থাকার অধিকারও অন্তর্ভুক্ত।

চারদিকের সুনসান নীরবতা মধ্যে এবারকার স্বাধীনতা দিবসে ব্যক্তিগতভাবে আমার সুযোগ হয়েছে আমার নিজের ঘনিষ্ঠ কয়েকজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার এ টি এম জাফর আলম, চিশতী হেলালুর রহমান, আরজ আলী (যাঁরা ইকবাল হল ছাত্র সংসদে আমার সহকর্মী ছিলেন) এবং শামসুল আলম চৌধুরীর (যিনি আমার ফুফাতো ভাই ও সহপাঠী ছিলেন) আত্মত্যাগের কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করার। একই সঙ্গে উপলব্ধি করার যে, যে মহান উদ্দেশ্য নিয়ে তাঁরা নিঃশর্ত ও নিঃস্বার্থভাবে প্রাণ দিয়েছেন, তা আজ বহুলাংশে অপূর্ণই রয়ে গেছে। আমরা যারা বেঁচে আছি, তারা তাদের এ স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছি। এ ছাড়া সুযোগ হয়েছে ভাবতে এবং নিজেকে প্রশ্ন করতে, এ ব্যর্থতার দায়মুক্ত হতে আজকের প্রেক্ষাপটে আমাদের কি কোনো কিছু করণীয় আছে?

এবারের স্বাধীনতা দিবসে আমার আরও উপলব্ধি করার সুযোগ হয়েছে যে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ আজ এক মহাদুর্যোগের মুখোমুখি। বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে আমরা জাতি হিসেবে এক জীবন-মরণের সমস্যায় নিপতিত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, করোনাভাইরাস সংক্রমণের চারটি স্তর রয়েছে। প্রথমত, যখন সংক্রমণ বিদেশ থেকে আনা হয় এবং এর প্রকোপ একটি বিচ্ছিন্ন-বিক্ষিপ্ত ঘটনা। দ্বিতীয়ত, স্থানীয় সংক্রমণ। অর্থাৎ এ স্তরে সংক্রমণের উৎস জানা এবং তা চিহ্নিত করা সম্ভব যেমন পরিবার কিংবা কোনো সুনির্দিষ্ট সংক্রমিত ব্যক্তির সংস্পর্শ। তৃতীয়ত, সামাজিক পর্যায়ে সংক্রমণ, যা ঘটে যখন সংক্রমণের উৎস অজানা এবং অনেক জায়গায় সংক্রমণ দৃশ্যমান। এ স্তরে সারা দেশে সংক্রমণের পরিমাণ এত ব্যাপক যে যেকোনো সংক্রমিত ব্যক্তির সংস্পর্শে না এসেও কিংবা সংক্রমণে জর্জরিত কোনো ভিন্ন দেশে না গিয়েও সংক্রমিত হওয়া সম্ভব। ফলে এ স্তরে দেশব্যাপী জ্যামিতিক হারে দাবানলের মতো সংক্রমণের বিস্তার ঘটে, যা বেশ কয়েকটি দেশে (যেমন: ইতালি, স্পেন, যুক্তরাষ্ট্রে) বর্তমানে আমরা লক্ষ করছি। চতুর্থত, যখন সংক্রমণ মহামারির পর্যায়ে পৌঁছে এবং ব্যাপক হারে মৃত্যু ঘটে।

বিশেষজ্ঞদের ধারণা, বাংলাদেশ এখন সংক্রমণের তৃতীয় স্তরে প্রবেশ করেছে এবং করোনাভাইরাসের সংক্রমণ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে এবং অনেক ব্যক্তি এ ভাইরাস বহন করছে, যদিও পরীক্ষার অভাবে তা চিহ্নিত হচ্ছে না। তবে আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে তা নিয়ন্ত্রণে আনা না গেলে, আরও অনেক ব্যক্তি সংক্রমিত হয়ে এটি মহামারি আকার ধারণ করতে পারে। অর্থাৎ করোনাভাইরাস সংক্রমণের করণে ব্যাপক মৃত্যু এড়াতে সম্ভবত দুই-তিন সপ্তাহের বেশি সময় আমাদের হাতে নেই বলে অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন। আর আমরা সবাই দল–মত, ধর্ম-বর্ণ ও সামাজিক অবস্থাননির্বিশেষে এ মৃত্যুর ঝুঁকিতে রয়েছি।

করোনাভাইরাসের কারণে আজ আমাদের সবার জীবনই শুধু ঝুঁকির মুখে নয়, অনেকের জীবিকাও হুমকির মধ্যে পড়েছে। আমাদের অর্থনীতি ব্যাপকভাবে রপ্তানির তৈরি পোশাক ও জনশক্তি রপ্তানির ওপর নির্ভরশীল। করোনাভাইরাসের সারা পৃথিবীতে ব্যাপকভাবে বিস্তারের কারণে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ দেশগুলোর অর্থনীতিতে যে মন্দাবস্থার সৃষ্টি হবে, তার প্রভাব আমাদের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দিতে পারে। ফলে অনেকে জীবিকার উৎস হারাতে ও বেকার হয়ে যেতে পারেন। সরকার যথাযথ ব্যবস্থা না নিলে তাঁদের কেউ কেউ, যাঁরা দিন আনে দিন খান, না খেয়ে মৃত্যুবরণও করতে পারেন।

সম্ভাব্য এ অর্থনৈতিক বিপর্যয় নিঃসন্দেহে শঙ্কার কারণ, তবে তার চেয়ে বড় ভয় হলো করোনাভাইরাস থেকে আশু মৃত্যুর ঝুঁকি। এই মৃত্যু রোধে সরকারের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের নাগরিকদেরও মুক্তিযোদ্ধাদের উত্তরসূরিদেরও আজ গুরুত্বপূর্ণ করণীয় রয়েছে। আমরা আমাদের বীর সেনানীদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে মানুষের জীবন রক্ষায় নিজেদের নিয়োজিত করতে পারি। আর তা করার মাধ্যমে আমাদের নিজেদের এবং নিজেদের আপনজনের জীবনও রক্ষা পাবে। কারণ, আমার প্রতিবেশী যদি করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়, তা আমার এবং আমার পরিবারের সদস্যদেরও সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি করে।

তাই আজ যদি আমরা আমাদের নিজের গ্রামকে করোনাভাইরাসমুক্ত করার শপথ নিয়ে কার্যক্রম হাতে নিই, তাহলে অন্য গ্রামবাসীর পাশাপাশি আমাদের নিজের এবং নিজেদের পরিবারের জীবন রক্ষার সম্ভাবনাও প্রশস্ত হবে। অর্থাৎ নিজের গ্রামকে করোনাভাইরাসমুক্ত করার কাজের সঙ্গে প্রত্যেকের নিজের এবং নিজের আপনজনের বেঁচে থাকার গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থও জড়িত।

নিজের গ্রামকে ‘করোনাভাইরাসমুক্ত গ্রাম’ করার ক্ষেত্রে আমরা আমাদের গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযোদ্ধাদের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে পারি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি জনযুদ্ধ। এ যুদ্ধে আমাদের দেশের আপামর জনসাধারণ, বঙ্গবন্ধুর ডাকে, যাঁর যা কিছু ছিল, তা নিয়ে শত্রুর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর মোকাবিলা করেছিলেন। ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলেছিলেন। আজ মানুষের জীবন রক্ষার্থেও করোনাভাইরাসের মতো অদৃশ্য শত্রুর বিস্তার রোধ করতে হলেও গ্রামের সব মানুষ, বিশেষ করে তরুণ সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। যারা গ্রামে বসবাস করছে না, তাদেরও গ্রামে অবস্থান করা স্বজনদের জীবন রক্ষার্থে এ কাজে ভূমিকা রাখতে হবে।

করোনাভাইরাসমুক্ত গ্রাম সৃষ্টি করতে হলে গ্রামবাসীদের একক এবং সম্মিলিতভাবে দুটি কাজ করতে হবে। প্রথম কাজটি হবে দায়িত্বশীল আচরণের জন্য সবাইকে সচেতন করা, যার অন্তর্ভুক্ত হবে ঘন ঘন হাত ধোয়া, পারস্পরিক দূরত্ব রক্ষা করা, হাঁচি-কাশি দেওয়ার সময় নাক-মুখ ঢাকা, বড় জনসমাগম এড়িয়ে চলাসহ বিশেষজ্ঞদের নির্দেশিত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা। একই সঙ্গে একটি প্রশ্নপত্র ব্যবহার করে যাঁরা এরই মধ্যে করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছেন, তাঁদের চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় সেবা পাওয়ার লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়া। একই সঙ্গে সম্ভাব্য সংক্রমিত ব্যক্তিদের হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন না হলে, তাদের ঘরে স্বতন্ত্র করে রাখা। আমরা নাগরিকেরা ইচ্ছা করলে এবং প্রত্যয়ী হলে এ কাজটি সহজেই করা সম্ভব হবে এবং অনেক সম্ভাব্য মৃত্যু ঠেকানো যাবে, যার মধ্যে আমরা নিজেরা এবং আমাদের আপনজনেরাও অন্তর্ভুক্ত।

তাই স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতির প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শনের জন্য আজ আমাদের নাগরিকদের প্রত্যয় হতে পারে: ‘সবাই মিলে শপথ করি, করোনাভাইরাসমুক্ত গ্রাম গড়ি’, যা জাতির জন্য একটি বিরাট বিপর্যয় রোধে সহায়ক হবে।

আমি নিশ্চিত যে সারা দেশের সচেতন মানুষ এগিয়ে এলে আমরা গ্রামে গ্রামে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে আবারও দুর্গ গড়ে তুলতে পারব, যা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং সময়স্বল্পতার কারণে অত্যন্ত জরুরিও। আমি আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি যে দি হাঙ্গার প্রজেক্টের সঙ্গে জড়িত স্বেচ্ছাব্রতীরা আমাদের কর্ম এলাকার উল্লেখযোগ্যসংখ্যক গ্রামে এ কাজটি করার ইতিমধ্যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, যাতে ‘সুজন সুশাসনের জন্য নাগরিকে’র সদস্যরা গুরুত্বপূর্ণ সহায়তা প্রদান করছেন। এ কাজে দ্রুততার সঙ্গে এগিয়ে আসার এবং মানবতার পাশে দাঁড়ানোর জন্য সব সচেতন নাগরিককে আমি সনির্বন্ধ আহ্বান জানাই।

বদিউল আলম মজুমদার, সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক।