হায়, গুলিতে তো করোনা মরে না

একটি ভাইরাসই বুঝিয়ে দিল মানুষের এত দিনের নিরাপত্তা ধারণা কতটা ঠুনকো। ছবি: রয়টার্স
একটি ভাইরাসই বুঝিয়ে দিল মানুষের এত দিনের নিরাপত্তা ধারণা কতটা ঠুনকো। ছবি: রয়টার্স

সীমান্তে বন্দুক উঁচিয়ে এখনো কি দাঁড়িয়ে আছে সীমান্তরক্ষীরা? বহাল তবিয়তেই আছে কাঁটাতার? পৃথিবীর বুক দাগ টেনে ভাগ করে নেওয়া মানুষ কী করছে এখন? প্রথম দুই প্রশ্নের উত্তর নিশ্চিতভাবেই ‘হ্যাঁ’। তবে শেষ প্রশ্নই এখন মুখ্য, যার উত্তর খুঁজতে খুব একটা না ভাবলেও চলে। বিশ্বের বিস্তীর্ণ অঞ্চল এই মুহূর্তে স্থবির হয়ে পড়েছে। এই সময়ে সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত শব্দের তালিকায় ঢুকে পড়েছে ‘লকডাউন’ ও ‘কোয়ারেন্টিনের’ মতো শব্দগুলো। কোথাও রাষ্ট্র বা প্রশাসনিক নির্দেশে মানুষ নিজেকে বন্দী করছে, কোথাও মানুষ স্বেচ্ছাবন্দী হচ্ছে।

সত্যিকারের এক বৈশ্বিক ঘটনায় মানুষেরা নিজেকে নিজেই বন্দী করছে এখন। আপাতত চুকিয়ে ফেলছে সামাজিকতার হিসাব-নিকাশ। সাধারণ মানুষের পায়ে বেড়ি পরাতে সীমান্ত আঁকা রাষ্ট্রগুলো তার সীমান্তনিরাপত্তার যাবতীয় আলাপ এখন গিলে ফেলতে বাধ্য হচ্ছে। কারণ, সীমান্ত ডিঙাতে কোনো ভাইরাসের পাসপোর্ট-ভিসার প্রয়োজন পড়ে না।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের যুক্তরাষ্ট্রেই যেমন এখন সীমান্তদেয়াল নিয়ে কোনো হইচই নেই, যা ট্রাম্প জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থেই তুলতে চেয়েছিলেন। নরেন্দ্র মোদির ভারতের দিকে তাকালে কেই-বা বলবে যে এই কিছুদিন আগেও দেশটিতে নাগরিক পঞ্জি ও সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন নিয়ে তুমুল কাণ্ড হয়ে গেছে, যার অনতিদূরের প্রেক্ষাপটেই ছিল সীমান্ত টানার ইতিহাস। কাশ্মীরের রাজনৈতিক বন্দীদের দেওয়া হয়েছে মুক্তি। সেখানে এখন তিন সপ্তাহের লকডাউন চলছে। কী বলবে এখন কাতারকে এত দিন অবরুদ্ধ করে রাখা সৌদি আরবসহ চার আরব দেশ। সেখানেও তো মূল অজুহাত ছিল নিরাপত্তা। ম্যাজিকের মতো হঠাৎ করেই যেন উবে গেছে নিরাপত্তার সব আশঙ্কা। থাকবেই–বা কেন, ‘নিরাপত্তা’ শব্দটির ভুলভাল ব্যাখ্যা ও চর্চায় মানুষ যে তার সীমানাকেই সীমায়িত করতে বাধ্য হয়েছে।

নতুন করোনাভাইরাস দেখিয়ে দিয়েছে, নিরাপত্তার সম্বন্ধটি এতটা সরল নয়। একজনের দিকে আরেকজন বন্দুক তাক করে থাকলেই নিরাপদ থাকা যায় না। একের পর এক ব্যালিস্টিক মিসাইলের পরীক্ষা করলেই বা গোলাবারুদ দিয়ে গুদাম ভরে ফেললেই নিরাপদ থাকা যায় না। নিরাপত্তার অজুহাত তুলে কোনো একটি জাতিকে ভূমি থেকে উৎখাত করে দেশছাড়া করেও থাকা যায় না তথাকথিত ‘সুরক্ষিত’। এই যে এত এত রাডার, এত এত স্যাটেলাইট বসিয়ে মানুষ ভাবল, ‘বাহ বেশ, এবার একটু নিশ্চিন্ত হওয়া গেল’, তা কি এখন ভীষণ রকম হাস্যকর মনে হচ্ছে না?

বিশ্বের ১৯৬টি দেশ ও অঞ্চল এখন কমবেশি নতুন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। মৃতের সংখ্যা বাড়ছে হু হু করে। বিশ্বের প্রতিটি মানুষ এই মুহূর্তে পরস্পর বিচ্ছিন্ন থাকলেও মানসিকভাবে সবচেয়ে বেশি সংযুক্ত। এক দেশের আক্রান্ত হওয়ার খবর, মৃতের সংখ্যা বৃদ্ধির খবর আরেক দেশের মানুষকে উদ্বিগ্ন করছে। নিজেকে বাঁচাতে ব্যস্ত থাকলেও অন্য মানুষটির আক্রান্ত হওয়ার খবর তাকে আতঙ্কিত করে তুলছে। এক ধরনের অসহায়বোধ তাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। এ-ই তো হওয়ার কথা ছিল আদতে। প্রকৃতির অন্য সন্তানদের তুলনায় দুর্বল হওয়ায় তার তো একা বাঁচার কোনো সুযোগ ছিল না। সেই আদিতে যূথবদ্ধতাই মানুষকে বাঁচিয়েছিল। অথচ দিনে দিনে নিজের সেই পরিচয়কেই সে ভুলে গেছে। প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের মধ্যেও তারা টেনে দিয়েছে বিভাজনের রেখা, সাম্প্রতিক সময়ে যা ভয়াবহভাবে বাড়ছিল।

ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র, এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্যসহ প্রায় প্রতিটি অঞ্চলেই বিভাজন উসকে দেওয়া লোকরঞ্জনবাদী রাজনীতিরই এক অভাবিত প্রসার ঘটছিল। সবার মধ্যেই ছিল যুদ্ধ যুদ্ধ ভাবটা বেশ প্রকট আকারে। অবশ্য এ বিশ্বের নেতারা যুদ্ধ ছাড়া অস্বস্তিতেই থাকেন। প্রতিপক্ষ না পেলে নেতৃত্ব যেন জোরালো হয় না। তাই প্রতিপক্ষ তৈরি হয় প্রয়োজন অনুযায়ী। নেতারা বড় বড় হলঘরে বসে কোনো এক পক্ষের দিকে আঙুল তাক করে বলে দেন—‘তবে এই হোক প্রতিপক্ষ’। আর সেই প্রতিপক্ষকে কিংবা ভবিষ্যৎ কল্পিত কোনো প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে রাষ্ট্র তার নাগরিকদের দেওয়া অর্থে বাড়িয়ে চলে অস্ত্রের ভান্ডার। মানুষকে বোঝানো হয়, তার নিরাপত্তা ঝুঁকিতে। তাকে বাঁচাতেই নাকি এত আয়োজন। ‘ক্ষমতার কালো কেদারায় বসে রাইফেল তাক করে’ থাকা লোকেরা সর্বত্রই আছে। আর তাই প্রতিবছর পাল্লা দিয়ে বাড়ে সামরিক ব্যয়।

২০১৭ সালে পুরো বিশ্ব সরাসরি সামরিক খাতে ব্যয় করেছে ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি ডলারের বেশি। এটা মোটাদাগের হিসাব। এর সঙ্গে আরও নানা হিসাব জুড়ে দিলে সে অঙ্ক মাথা ঘুরিয়ে দেবে। সামরিক শক্তির সবচেয়ে বড় আস্ফালন দেখানো দেশ যুক্তরাষ্ট্রের দিকে তাকালেই বিষয়টি বোঝা যাবে। ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক খাতের বাজেট ছিল ৬৩৯ বিলিয়ন ডলার। এই অঙ্কই অনেক বড়। কিন্তু এর সঙ্গে যখন অন্য অঙ্কগুলো যুক্ত হয়, তখন অন্য খাতগুলোর সংকোচন ও এ খাতের প্রসারণ রীতিমতো চমকে দেয়। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাময়িকী সায়েন্সম্যাগের তথ্যমতে, ওই একই বছর গবেষণা খাতে বরাদ্দ ছিল ১৫৫ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার। এই বরাদ্দের পর ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন নিজেদের গবেষণাবান্ধব হিসেবে জাহির করতে শুরু করে। কারণ, আগের বছরের তুলনায় বরাদ্দ বেশ খানিকটা বাড়ানো হয়েছিল। কিন্তু এই মোটাদাগের গবেষণা বরাদ্দের মধ্যেই রয়েছে ফাঁকিটা। সায়েন্সম্যাগই জানাচ্ছে, এই বরাদ্দের মধ্যে ৮২ দশমিক ৯ বিলিয়ন সামরিক খাতসংশ্লিষ্ট গবেষণার জন্য বরাদ্দ। আর বাকিটা বেসামরিক খাতের জন্য, যার পরিমাণ ৭২ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার। এর বাইরে স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ নানা খাতের বরাদ্দের মধ্যেও সামরিক হিস্যাটি ঢুকে পড়ে।

শুধু যুক্তরাষ্ট্র কেন, প্রায় সব দেশের অবস্থাই এমন। এমনকি শান্তির সময়েও এই বিনিয়োগ শুধু চলেই না, বাড়তেও থাকে। অস্ত্রের মজুত বাড়ানোকেই রাষ্ট্রগুলো নিরাপত্তা নিশ্চিতের একমাত্র পন্থা মনে করে। বন্দুক আর গোলাবারুদের পরিসংখ্যান তুলে ধরে, নানা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহড়া দিয়ে সাধারণ মানুষকে রাষ্ট্র দেখাতে তৎপর যে ‘দেখো তোমাকে কতটা নিরাপদ করলাম’। সীমান্তে সীমান্তে বন্দুক উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে সবাইকে বোঝাতে চায় যে নিরাপত্তা মানেই বন্দুক, নিরাপত্তা মানেই নজরদারি। কিন্তু ‘নিরাপত্তা’র এই ব্যাখ্যা কতটা ভ্রান্ত, তা এসে এবার দেখিয়ে দিল করোনাভাইরাস, যাকে চোখে দেখা যায় না। ফলে অজস্র গুলির মজুত রেখেও, সীমান্তগুলোয় অতন্দ্র প্রহরী বসিয়েও তাকে ঠেকানো যায় না। গুলি করে তাকে মারা যায় না। এই সময়ে এটি এমন এক উপলব্ধি, যা প্রত্যেক মানুষকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। মানুষ বুঝতে পারছে, নিরাপত্তার নামে কত ঠুনকো ব্যবস্থা তারা গড়ে তুলেছে।

পৃথিবীকে দাগ টেনে ভাগ করে নেওয়া, জাতি-ধর্ম-বর্ণসহ অসংখ্য অজুহাতে বিভাজিত হওয়া মানুষ এখন টের পাচ্ছে, সীমানা আরও ছোটও হতে পারে। জাতিতে জাতিতে, সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে যে সীমানারেখা টেনে দেওয়া হয়েছিল, প্রকৃতিকে উত্ত্যক্ত করার যে সীমা লঙ্ঘন করা হয়েছিল, প্রবৃদ্ধি নামক পাগলা ঘোড়ার গতি বৃদ্ধির যে অসীম ক্ষুধা চালিত করছিল তাকে, তারই ফল আজ বলে দিচ্ছে—‘তুমি ক্ষান্ত হও; একটু জিরাও, গ্রহণ করো স্বেচ্ছাবন্দিত্ব’। নতুন করোনাভাইরাস প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের প্রতিনিয়ত করে চলা অন্যায়ের ফল; তাকে সীমিত করার, বনসাই বানাতে চাওয়ার ফল।

এই করোনাভাইরাসই এখন মানুষকে তার ক্ষুধা কমানোর বার্তা দিচ্ছে। সে জানিয়ে দিচ্ছে, ‘প্রকৃতির সব সন্তানকে নিয়েই বাঁচার চেষ্টা করতে হবে। না হলে ছোট গণ্ডির মধ্যে বন্দী হয়ে যেতে হবে।’ লকডাউন হয়ে পড়া বিশ্বের গৃহবন্দী মানুষেরা এই অবসরে এই কথা কি ভাববে? তারা কি সেই তথাকথিত নেতাদের বলবে, নিরাপত্তা ধারণার ভুল ব্যাখ্যা আর দেবেন না। অস্ত্রের নিরাপত্তা যেকোনো সময় ভেঙে পড়তে বাধ্য। সত্যিকার নিরাপত্তা সহাবস্থান, সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি, সেবা, প্রকৃতিবান্ধব জীবনাচারের ধারণার সম্প্রসারণ ও চর্চার মধ্যেই রয়েছে। যদিও করোনাভাইরাসের এই মহামারি রূপ রাষ্ট্রের হাতেই আরও বেশি নিয়ন্ত্রণ তুলে দিয়েছে জীবন রক্ষার্থে ভূমিকা পালনের জন্য। এই ভূমিকা থেকে রাষ্ট্র পিছু হটবে কি না, মানুষ তার স্বাধীনতা ফিরে পাবে কি না, তা মানুষকেই নিশ্চিত করতে হবে। ইতিহাস বলে, রাষ্ট্র সংকটমুহূর্তে তার ছড়ানো জাল সহজে গুটিয়ে নিতে চায় না। তাই সাধারণ মানুষকেই এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।

ফজলুল কবির: সাংবাদিক
[email protected]