'খিলগাঁও সিনড্রোম' কীভাবে রুখব?

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

চলমান ভাইরাস যুদ্ধের মধ্যেই ঢাকার খিলগাঁওয়ে স্থানীয় বাসিন্দারা সরকারের কাছে বিস্ময়কর এক দাবি তুলেছেন। করোনাভাইরাসে মৃতদের স্থানীয় কবরস্থানে দাফন করতে দিতে চান না তাঁরা। আপত্তির ধরন ছিল বেশ জোরালো ও সংগঠিত। ওই দাবিতে স্থানীয় বাসিন্দারা সেখানে ব্যানারও টাঙিয়ে দিয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হতবিহ্বল হয়ে সেই ব্যানারের ছবি দেখেছেন দেশ-বিদেশের কোটি কোটি মানুষ।

স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে ‘সমাজ’ জীবিতদের অসুস্থতা থেকে বাঁচাতে না পারার ব্যর্থতার মাঝে মৃতদেহেরও দায়িত্ব নিতেও অনিচ্ছুক। এটা অবশ্যই একটা নতুন মুহূর্ত। যে মুহূর্তটি খোলামেলাভাবেই এত দিনকার ‘সামাজিক চুক্তি’ থেকে বেরিয়ে আসার খবর দিচ্ছে।

খিলগাঁওয়ে অতি সুউচ্চ কোনো ভবন থাকলে তার ছাদ থেকে একই রকম দৃশ্য দেখা যেত বিশ্বের বহু দেশে, ভিন্ন ভিন্ন রূপে ও ভঙ্গিতে। যেমন, ২৫ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও সিনেট কয়েক দিনের তুমুল পরিশ্রম ও দর-কষাকষি শেষে যখন দুই ট্রিলিয়ন (দুই লাখ কোটি!) ডলার সহায়তা ঘোষণা করল, তখনো দেশটিতে কিছু মিডিয়ার বাইরে সামান্যই আশাবাদ বা উদ্দীপনা দেখা গেছে।

এটাও মূলত ‘খিলগাঁও সিনড্রোম’। সেখানকার নাগরিকরাও সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে জীবনের নিরাপত্তায় কিছু না পেয়ে দিশেহারা। অথচ ২০১৮ সালেও যুক্তরাষ্ট্রের বাসিন্দারা ৯৮ ট্রিলিয়ন ডলার সমমূল্যের সম্পদের মালিক ছিল। লোকসংখ্যার সঙ্গে মিলিয়ে গড় করলে ব্যক্তিপ্রতি প্রায় তিন লাখ ডলার মূল্যের সম্পদ ছিল সেখানে। কিন্তু এই সম্পদ তাদের নিরাপত্তা দিতে পারেনি। কারণ, সম্পদকে ভুল জায়গায় বিনিয়োগ করা হয়েছিল। যে বিনিয়োগ কেবল আরও ডলার বানিয়েছে। একই দশা টাকাওয়ালাদের। রুপিওয়ালাদের। রিয়ালওয়ালাদের। সমস্যাটা সম্পদ নয়, সম্পদের বিনিয়োগ ক্ষেত্র নিয়ে।

সেই বিনিয়োগ চিন্তায় কোনো সংশোধনী নেই এখনো। সেই সংশোধনী ছাড়াই এখন গতানুগতিকভাবে ‘রাষ্ট্র’গুলো জনগণকে দিতে চাইছে ডলার, পাউন্ড, রুপি, টাকা। এ ছাড়া তাদের কাছে আপাতত কিছু আর নেই। কিন্তু ‘কোভিড-১৯’ নামের অদৃশ্য প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মানুষ মুদ্রাকে কোনো রক্ষাকবচই মনে করছে না। তাদের দরকার অভিভাবকসুলভ একটা সমাজ। নতুন সামাজিক চুক্তি। যে ‘চুক্তি’ তাকে নিরাপত্তা দেবে। বাঁচার নিশ্চিত আশ্বাস দেবে। মাস্ক খুলে অক্সিজেন টানতে বাধা দেবে না। ভাঙনের কালে একজন আরেকজনকে টেনে রাখবে। মৃত্যুর পর প্রত্যেকের কবর ঘিরে নিকটজনরা চোখের পানি ফেলবে। দাফন-কাফনে বাধা তো নয়ই।

কিন্তু সেটা বোধ হয় আর হওয়ার নয়। দৈনিক কালের কণ্ঠ–এর ২৬ মার্চের সংবাদে দেখা গেল বগুড়ার নন্দীগ্রামে প্রবাস থেকে আসা মানুষদের বাড়িতে বাড়িতে ‘লাল পতাকা’ উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের সমাজজীবনে লাল পতাকা বিশেষ সতর্কবার্তা। এতকাল বহু আদরণীয় ‘প্রবাসী’রা এভাবেই সমাজের ‘অপর’ এখন।

প্রবাসীরা যুগের পর যুগ উজাড় করে ডলার-পাউন্ড-রিয়াল পাঠিয়েছেন দেশ ও নিকটজনকে। দেশের ‘বৈদেশিক মুদ্রার তহবিল’-এর বড় স্তম্ভ তাঁরা। ভাইরাস সংক্রমিত হলে তাঁদের চিকিৎসা পাওয়ার হক ছিল। কিন্তু সামাজিকভাবে তাঁরা চিহ্নিত হচ্ছেন ঝুঁকির প্রতীক। অথচ ঝুঁকি মোকাবিলায় সক্ষম একটা ব্যবস্থাপনা গড়া হয়নি এত দিনের হাজার হাজার কোটি টাকার রেমিট্যান্স দিয়ে। যে ব্যবস্থার সুবিধা পেতে পারত প্রবাসী-নিবাসী সবাই। চরাচরজুড়ে কোনো বাড়িতে ‘সাদা পতাকা’ নেই আজ।

অর্থনৈতিক ব্যবস্থাটির ‘জাদুকরি শক্তি’ নিঃশেষিত
পুরোনো রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনার অসহায়ত্ব খোলাসা হয়ে যাওয়া মাত্রই বিশ্বের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানেরা রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ বাঁচাতে উদার হৃদয়ে রাষ্ট্রের কোষাগার খুলে ধরেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের আগে-পরে ব্রিটেন জিডিপির ১৫ ভাগ সমান তহবিল ছাড় করার ঘোষণা দিয়েছে। ভ্যাট ও কর দেওয়ার মেয়াদ পেছানো হয়েছে। কানাডা জিডিপির তিন ভাগ পরিমাণ সম্পদ একই কাজে লাগাবে বলছে। ভারত ২০ বিলিয়ন ডলারের প্রণোদনা ঘোষণা করতে যাচ্ছে। বলা হচ্ছে, লকডাউনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের মধ্যে সবচেয়ে গরিব ১০ কোটিকে শুরুতে সাহায্য করবে সরকার। বাংলাদেশও রপ্তানিমুখী শিল্পের জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনার কথা জানিয়েছে। তবে সব দেশেই ব্যবসায়ীরা আরও বেশি চাইছেন।

কিন্তু সম্ভাব্য সম্পদের জোগান কোথা থেকে আসবে, সেসব নিয়ে নানা বিতর্ক চলছে। নিশ্চয়ই জনগণকেই এসব সম্পদের জোগান দিতে হবে।

তবে রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানেরা যত বড় অর্থনৈতিক প্যাকেজই ঘোষণা করুন, তাতে মানুষের মাঝে বিশেষ কোনো স্বস্তি তৈরি হচ্ছে না। কারণ, অনেক দেশেই আক্রান্তরা জানে না, তাদের চিকিৎসার উপায় কী হবে, চিকিৎসা ব্যয় কীভাবে মিটবে। তাদের মৃত্যু ঘটলে পরিবারের বাকিদের কী হবে? ইতিমধ্যে কোটি কোটি অস্থায়ী কর্মী চাকরিচ্যুত। কোটি কোটি ছোট ব্যবসায়ীকে কেউ এই আশ্বাস দিতে পারছে না যে কবে পাইকারি ও খুচরা বাজার আবার স্বাভাবিক হবে।

এত দিনকার প্রধান অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মূল শক্তির জায়গা ছিল সবাইকে কাজে নামাতে পারা এবং ঘরের বাহির করা। সেই ‘জাদুকরী শক্তি’তে আপাতত টান পড়েছে। খিলগাঁও সিনড্রোম তারই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া।

সমাজে দরকার নতুন ভাবাদর্শ
বিভিন্ন দেশের সরকার যতই আর্থিক প্রণোদনা ঘোষণা করুক, তাতে উদ্দীপনা তৈরি না হওয়ার প্রধান কারণ দুটি। এটা এমন অবস্থা নয় যে বাড়ির কাঠামোর ওপর ছাদ ভেঙে পড়েছে। এবার ভেঙে পড়ছে খোদ বাড়ির ‘ফাউন্ডেশন’।

ফলে ছাদ তৈরির উপকরণ সরবরাহ করে এবারের ঝড় থেকে রক্ষা পাওয়ার চেষ্টা বৃথা। বিভিন্ন দেশে ঘোষিত প্রণোদনা আমলাতন্ত্র, ব্যবসায়ী ও রাজনীতির ক্ষুধা মিটিয়ে চুইয়ে চুইছে কত দিনে, কতটা নিচের দিকে সবচেয়ে খারাপ অবস্থার শিকারদের কাছে আসবে, সেসব নিয়ে মানুষের আগ্রহ সামান্যই। সবাই বুঝতে পারছে এসব প্রণোদনা প্যাকেজ আসলে বিদ্যমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় শাসকদের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার মরিয়া চেষ্টা মাত্র। একজন অর্থনীতিবিদ একে তুলনা করেছেন ‘হেলিকপ্টার ড্রপিং’-এর সঙ্গে। এই হেলিকপ্টার ড্রপিং ধাঁচের অর্থকৌশলে মানুষ প্রচণ্ড হতাশ, বিরক্ত, ক্ষুব্ধ। তাদের মাঝে সম্পূর্ণ প্রতারিত হওয়ার বোধ। এই বোধ মানুষকে স্বাভাবিক বিবেচনা শূন্য করে ফেলে। খিলগাঁও সিনড্রোম আসলে তা–ই। এই মানুষদের আবার স্বাভাবিক ও আশাবাদী করতে হলে অর্থের চেয়েও জরুরি নতুন কোনো ভাবাদর্শ। যে ভাবাদর্শ মানুষকে নিরাপত্তা দিতে ‘লকডাউন’-এর বিকল্প কোনো উপায় দেখাবে। কিছুদিনের লকডাউনের পরই যে ‘বিকল্প’ লাগবে।

কত বাড়িতে ‘লাল পতাকা’ টাঙাব আমরা?
এটা বোঝার জন্য পণ্ডিত হওয়ার দরকার হয় না যে যত ট্রিলিয়ন ডলার-পাউন্ডই তাতে ঢালা হোক, পুঁজিতান্ত্রিক বর্তমান বিশ্বব্যবস্থাকে কোনোভাবেই আগের স্বাভাবিক অবস্থায় আর নেওয়া যাবে না। কারণ এটা গতানুগতিক কোনো মন্দা নয়। সমস্যাটি এখন কেবল সম্পদের জোগানজনিত অভাব নয়। সম্পদ কোথা থেকে আসছে, কার কাছে যাবে, কী কাজে লাগবে—এসব প্রশ্নের মীমাংসা ছাড়া ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার কোনো কাজে আসবে বলে বিশ্বাস করে না মানুষ। যারা এত দিন এসব প্রশ্নের মীমাংসা দিয়েছে, তাদের ওপর মানুষের আর আস্থা নেই।

ফলে বিশ্বের দেশে দেশে মানুষের দরকার পড়েছে বিশ্বাসের পুনরুদ্ধার। নতুন এক ‘সামাজিক চুক্তি’। যা মানুষের আস্থা ফেরাবে ভবিষ্যতের দিকে। এর জন্য দরকার পুরো সামাজিক সম্পদকে সামাজিক নিরাপত্তায় ব্যয় করা। পরিকল্পনাগুলো হতে হবে স্থানীয় সমাজের জীবনধারার সঙ্গে মিল রেখে। পরিকল্পনার কেন্দ্রে থাকতে হবে মানুষে স্বাস্থ্য, বাসস্থান ও খাবারের প্রশ্ন। গুটি কয়েক ব্যবসা খাতের সংকীর্ণ প্রবৃদ্ধি চিন্তার চূড়ান্ত অবসান দরকার আজ। করোনা বাংলাদেশ ও বৈশ্বিক উন্নয়ন চিন্তার আমূল পরিবর্তনের তাগিদ তৈরি করেছে। পুলিশি লকডাউনের চেয়েও অনেক সুদূরের দিকে ভাবতে হবে সবাইকে। এই অর্থে চলতি ভাইরাস–যুদ্ধ কেবল একটা মহাসংকটই নয়, একটা মহাসুযোগও। কারণ, তা আমাদের ‘গভীর-গোপন-ক্ষত’ সারাইয়ের উপলক্ষ তৈরি করেছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী তাদের ৪৫ ভাগ সদস্য দেশেই এখনো মানুষ ও ডাক্তারের সমীকরণ ১০০০: ১–এর চেয়েও কম। অথচ ২০১৯-এও বিশ্বে মানুষের হাতে ৩৬০ ট্রিলিয়ন ডলার সমান সম্পদ ছিল। সম্পদ ও চিকিৎসাজনিত অসহায়ত্বের এই দুটি চিত্রটি পাশাপাশি রাখলেই স্পষ্ট, বিশ্বব্যবস্থাটি এত দিন ভুল পথে চলেছিল। কেউ না কেউ তাকে ভুল পথে নিয়েছে। খিলগাঁও সিনড্রোমের জন্য চূড়ান্ত বিচারে সেই পরিচালকেরাই দায়ী।

বিশ্বব্যাংকের হিসাবে ২০১৭ সালে বিশ্বজুড়ে সশস্ত্র বাহিনীর নিয়মিত সদস্যসংখ্যাই ছিল প্রায় তিন কোটি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে ওই একই সময় বিশ্বের দরকার ছিল নতুন ৪৩ লাখ ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী।

এসব তথ্য-উপাত্ত আমাদের দেখাচ্ছে বৈশ্বিক সম্পদ কোন দিকে গিয়েছে এত দিন এবং শত্রু-মিত্র-নিরাপত্তা ধারণায় ঠিক কোথায় গলদ ছিল। এই গলদ সংশোধন করতেই নতুন সামাজিক চুক্তি দরকার। তবে দেশে দেশে শুধু নতুন সামাজিক চুক্তিও যথেষ্ট নয়। একই সঙ্গে কোভিড-১৯ নতুন এক বিশ্বব্যবস্থারও তাগিদ দিচ্ছে। কারণ এত দিনকার ‘বিশ্বব্যবস্থা’ মানুষকে রক্ষা করা দূরের কথা নিজেকেও রক্ষা করতে পারছে না।

দেশে ও আন্তর্জাতিক পরিসরে
নতুন ‘চুক্তি’র পাশাপাশি মানুষকেও পুরোনো জীবনধারা পাল্টানোর তাগিদ তৈরি করেছে কোভিড। অর্থাৎ পরিবর্তনের ডাক এসেছে ব্যক্তিগত লাইফ-স্টাইলের। এভাবে করোনাভাইরাস তিন স্তরের পরিবর্তনের দিকে ঠেলে দিয়েছে পৃথিবী নামক গ্রহকে। আপাতত কোনো স্তরেই কোনো মৌলিক সমাধান চিন্তা হাজির নেই।

কেবল মানুষকে ‘লকডাউনে’ যেতে বলা হচ্ছে দেশে দেশে। কিন্তু কোনো সরকার কিংবা বৈশ্বিক সংস্থা বলতে পারছে না, লকডাউনের পরে কী হবে? কেন প্রজন্মের পর প্রজন্ম ‘সিস্টেম’-এর জন্য খেটে যাওয়ার পরও মানুষ তার দেহটিকেও নিরাপদ রাখতে পারছে না? কেন মুক্ত বাতাসে স্বাভাবিক প্রশ্বাসের অবস্থাও নেই আজ? কেন মানুষের কাছে প্রিয়জনের মৃতদেহও অচ্ছুত আজ? ‘লাল পতাকা’ই কী সমাধান?

কত বাড়িতে সেটা টাঙাব আমরা?

আলতাফ পারভেজ: গবেষক