লক্ষ্যগুলো পুনর্বিবেচনা করা একান্ত জরুরি

ছবি: রয়টার্স
ছবি: রয়টার্স

১৭ মার্চ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত টানা ১০ দিনের সাধারণ ছুটি ঘোষণার সময়োপযোগী সিদ্ধান্তের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। বিশ্বব্যাপী মহামারি মোকাবিলায় সাধারণত প্রতিরোধ, শনাক্তকরণ, দমন এবং প্রশমন—এই চার পর্যায়ে কার্যক্রম পরিচালিত হয়। কোভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়া রোধ করার ক্ষেত্রে সরকারের এ পদক্ষেপের কোনো বিকল্প ছিল না।

করোনাভাইরাস ডিজিজ বা কোভিড-১৯ একটি শ্বাসতন্ত্রের রোগ। এর জন্য দায়ী করোনাভাইরাস গ্রুপের সার্স কোভি-২ নামের নতুন একটি ভাইরাস। আমাদের দেশ এখন অনেক উষ্ণ ও আর্দ্র। অনেকে ভাবছেন এই কারণে কোভিড-১৯-এর ব্যাপক সংক্রমণ এখানে ঘটবে না। কিন্তু বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিরা সতর্ক করে বলেছেন, এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার মতো পর্যাপ্ত তথ্য–উপাত্ত এখনো নেই। বেশ কয়েক বছরের বিভিন্ন ঋতুর উপাত্ত ছাড়া আবহাওয়ার সঙ্গে এ ভাইরাসজনিত রোগের যোগসূত্র বের করা সম্ভব নয়। তাঁরা এ–ও মনে করেন, প্যান্ডেমিক বা বৈশ্বিক পরিসরের মহামারি সাধারণ মহামারির মতো আবহাওয়াগত সম্পর্ক প্রদর্শন করে না। তাই বাংলাদেশে কোভিড–১৯–এর ব্যাপক সংক্রমণ ঘটবে না, এ বিষয়ে আশাবাদী হওয়ার মতো জোরালো যুক্তি মেলে না। 

ধরে নেওয়া যায়, একটি কার্যকর টিকা আবিষ্কার ও তার ব্যবহারের আগ পর্যন্ত, কিংবা রোগটির প্রকোপ হঠাৎ করে নিজ থেকেই কমে যাওয়ার আগ পর্যন্ত এই অতিমাত্রায় ছোঁয়াচে রোগটি সবাইকে সংক্রমিত করে যেতে থাকবে, এর থেকে সহসা মুক্তির সম্ভাবনা নেই।

কোভিড-১৯ নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও চীনে যৌথ মিশনের রিপোর্টে দেখা যায়, ফেব্রুয়ারির ২০ তারিখ পর্যন্ত ল্যাবরেটরির পরীক্ষায় নিশ্চিত হওয়া আক্রান্ত ব্যক্তিদের ৮০ শতাংশই মৃদু থেকে মাঝারি পর্যায়ের অসুস্থতায় ভুগেছেন। তাঁদের বাড়তি অক্সিজেন দেওয়ার দরকার পড়েনি। অর্থাৎ তাঁরা বাসায় থেকেই চিকিৎসা নিয়েছেন। বাকিদের ১৬ শতাংশের অবস্থা গুরুতর এবং ৪ শতাংশের অবস্থা আশঙ্কাজনক ছিল, তাঁদের হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয়েছিল। আশঙ্কাজনক অবস্থায় পৌঁছে যাওয়া রোগীদের ক্ষেত্রে ইনটেনসিভ কেয়ার তথা হাসপাতালের আইসিইউ শয্যার প্রয়োজন ছিল।

মহামারির প্রাথমিক পর্যায়ে সব দেশ এর ছড়িয়ে পড়া ঠেকানো বা প্রতিরোধ এবং স্বাস্থ্যব্যবস্থার সক্ষমতা বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দেয়। এ ক্ষেত্রে আমেরিকার সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (সিডিসি) ২০০৭ সালের প্রি-প্যান্ডেমিক প্ল্যানিং গাইডেন্স রিপোর্টের একটি গ্রাফ ব্যবহার করা হয়। এতে ব্যাপক হারে সংক্রমণ প্রতিরোধে এবং ব্যাপক প্রাণহানি কমাতে রোগের প্রাদুর্ভাবের সম্ভাব্য পিক বা সর্বোচ্চ পর্যায় নিরূপণ করে তাকে বিলম্বিত করা, হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপর চাপ কমানোর কৌশল বের করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বিশ্বজুড়ে এই গ্রাফই ‘ফ্ল্যাটেনিং দ্য কার্ভ’ বা কোভিড-১৯ মোকাবিলার চালিকা শক্তি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

ফ্ল্যাটেনিং দ্য কার্ভ প্রেক্ষাপটে ভারতের একটি উদ্যোগের দিকে তাকানো যাক। তাদের চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা আশঙ্কাজনক রোগীদের চিকিৎসায় একটি ভেন্টিলেটর দিয়ে একই সঙ্গে দুজনের চিকিৎসার উপায় বের করেছেন। তাঁদের মাত্র ৩০ হাজার ভেন্টিলেটর ছিল, কিন্তু তাঁরা রাতারাতি এর সক্ষমতা বাড়িয়ে দ্বিগুণ করে ফেলেছেন।

কোভিড-১৯ মোকাবিলায় আমাদের দেশের কার্যক্রমের দিকে তাকালে কোনো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য দেখা যায় না। যেকোনো কাজের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য আগেই নির্ধারণ করা প্রয়োজন, তাতে সেই কাজ সফল বা ব্যর্থ হলো কি না তা পর্যালোচনা করা যায় এবং প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনা যায়। ২৩ মার্চ ঘোষণা করা হলো ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি। এ ঘোষণা প্রচারিত হওয়ার সঙ্গ সঙ্গেই মানুষের ঢল দেখা গেল ঢাকা ছাড়ার জন্য। পরে অবস্থা বেগতিক দেখে আন্তজেলা যোগাযোগ বন্ধ করা হলো। লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পরিষ্কার থাকলে আগে যোগাযোগ বন্ধ করে তারপর ছুটি ঘোষণা করা হতো এবং নির্দ্বিধায় বলা যায়, করোনাভাইরাসের সম্ভাব্য সংক্রমণ ঠেকাতে তা অনেক বেশি কার্যকর হতো।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে পৃথিবী এমন আর কোনো বৈশ্বিক সমস্যার সম্মুখীন হয়নি। এ ক্ষেত্রে একটি ভুলেই অনেক মানুষের জীবন শেষ হয়ে যেতে পারে। বাংলাদেশে সুনির্দিষ্ট কৌশল, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ঠিক করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের লক্ষ্য স্থির করা উচিত অনেকগুলো বিষয়কে কেন্দ্র করে। সেগুলোর কয়েকটি হতে পারে এমন: কতজন আক্রান্ত? রোগের প্রাদুর্ভাবের সম্ভাব্য পিক বা সর্বোচ্চ মাত্রা কবে হতে পারে? আমরা প্রাণহানির হার সর্বোচ্চ কতর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখব? বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা রোগ নির্ণয়ের ওপর জোর দিয়েছে। তারা বলেছে অন্ধ অবস্থায় আগুন নেভাতে পারবেন না। আমরা কত পরীক্ষা করব, কাদের পরীক্ষা করব? পরীক্ষার ক্ষেত্রে আমাদের কৌশলগুলো কী হবে? কীভাবে নমুনা সংগ্রহ করব? পরীক্ষার স্থান হবে কোথায়? এ পরীক্ষা করার মতো সক্ষমতা কয়টি ল্যাবরেটরির আছে? তাদের অবস্থান কোথায়? আক্রান্তদের কীভাবে মৃদু, মাঝারি, মারাত্মক ও আশঙ্কাজনক হিসেবে নিরূপণ করব? কী ধরনের মানুষকে নজরদারিতে রাখব? কোন রোগীকে বাসায় রেখে চিকিৎসা দেব আর কাদের হাসপাতালে নেব? আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থার সক্ষমতা কী? আমাদের সক্ষমতা কোথায় উন্নীত করতে হবে? কত দিনের মধ্যে কোভিড-১৯–এর প্রাদুর্ভাব কমিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চাই? আমাদের লক্ষ্যে সহায়তা করার মতো সক্ষমতা কাদের আছে— ব্যক্তি পর্যায়ে, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে?

ছোট–বড় সব দেশই সরকারি আমলাদের পাশাপাশি চিকিৎসাবিজ্ঞানী, মহামারি বিশেষজ্ঞ (এপিডেমিওলজিস্ট), জীবাণু বিশেষজ্ঞ (ভাইরোলজিস্ট), জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ, চিকিৎসকসহ বিভিন্ন তরুণ গবেষকের সমন্বয়ে টাস্কফোর্স গঠন করে কোভিড-১৯ মোকাবিলায় সচেষ্ট। এ বৈশ্বিক মহামারি মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও দূরদর্শিতা কোনো একক প্রতিষ্ঠানের পক্ষে থাকা সম্ভব নয়।

একটি প্রস্তাবনার মধ্যে লেখার ইতি টানছি। প্রথমত পরীক্ষার মাধ্যমে যত দ্রুত সম্ভব প্রকৃত আক্রান্ত ব্যক্তিকে শনাক্ত করা; দ্বিতীয়ত তাঁর চিকিৎসা দেওয়া। যত সময়ক্ষেপণ করব, তত চিকিৎসাব্যবস্থার ওপর চাপ বাড়বে এবং অনেক মানুষের অহেতুক প্রাণহানি ঘটবে।

এখনই উচিত সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) কল সেন্টারের কার্যক্রমের পরিধি ও সক্ষমতা এমন পর্যায়ে বাড়ানো, যাতে কেউ যোগাযোগ করলে তাঁর বিস্তারিত জেনে তিনি আক্রান্ত কি না, তা পরীক্ষার মাধ্যমে নিরূপণ করতে হবে। আক্রান্ত হয়ে থাকলে তিনি সংক্রমণের কোন পর্যায়ে রয়েছেন, তা নিরূপণ করতে হবে। তিনি কোন এলাকার বাসিন্দা বা কোন এলাকা থেকে ফোন করেছেন, সে বিষয়ে (জিআইএস লোকেশন) তথ্যও সংগ্রহ করতে হবে।

যেহেতু এখন ইনফ্লুয়েঞ্জার প্রাদুর্ভাবের সময়, সেহেতু কোনো রোগী কোভিড-১৯–এ আক্রান্ত কি না, তা নিরূপণ করা অনেক জটিল। এ ক্ষেত্রে নিশ্চিত করতে হবে কোভিড-১৯-এর উপসর্গ যাঁদের মধ্যে আছে এবং যাঁরা মৃদু থেকে মাঝারি পর্যায়ের আক্রান্ত, সবাই যেন নিজ নিজ বাসায় থেকেই চিকিৎসা পান। নিশ্চিত করতে হবে যে তাঁরা ৫ থেকে ৭ দিনের মাথায় সেরে উঠবেন, প্রয়োজনে তাঁদের নির্ধারিত হাসপাতালের বহির্বিভাগে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা মেনে অ্যাম্বুলেন্সযোগে এনে চিকিৎসা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। অন্যদের ক্ষেত্রে সবাইকে বাসা থেকে নির্ধারিত হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।

আইইডিসিআরের কল সেন্টারে যেসব টেলিফোন কল আসবে, সেগুলো কোন কোন স্থান থেকে এসেছে (জিআইএস লোকেশন) তা পর্যালোচনা করে এলাকাভিত্তিক সংক্রমণের চিত্র বের করা ও আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে যাঁরা স্বাস্থ্যকর্মী, তাঁদের অগ্রাধিকার দেওয়া প্রয়োজন। আক্রান্ত ব্যক্তিরা কল সেন্টারের সেবার প্রতি আস্থা হারালে যেকোনো হাসপাতালে গিয়ে উপস্থিত হবে। তার ফলে সেই হাসপাতালের কোনো চিকিৎসক আক্রান্ত হতে পারেন, তার ফলে সেই হাসপাতাল লকডাউন—এ রকম পরিস্থিতি কোনোভাবেই কাম্য নয়। পরীক্ষার নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষার সক্ষমতা বাড়াতে আরও সরকারি–বেসরকারি হাসপাতাল ও সংস্থা, যাদের ল্যাবরেটরিতে আরটি-পিসিআর মেশিন আছে, তাদের কাজে লাগাতে হবে। আইইডিসিআর পরীক্ষার নমুনা সংগ্রহ করে আরএনএ আলাদা করে দিলে অন্যদের ল্যাবরেটরির জৈব-সুরক্ষার মান কম হলেও সমস্যা নেই, ঝুঁকি থাকবে না। কল সেন্টার অপারেশনের জন্য বেসরকারি কল সেন্টার অপারেটর, আর জিআইএসভিত্তিক তথ্য–উপাত্ত পর্যালোচনার জন্য তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের কাজে লাগানো যায়। টাস্কফোর্স দলের সদস্যরা এসব কল পর্যালোচনা করে নতুন নতুন কার্যকর কৌশল বের করতে পারবেন।

কোভিড-১৯ চিকিৎসায় নির্ধারিত হাসপাতালের জরুরি পরিস্থিতিভিত্তিক কর্মপদ্ধতির বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এর পাশাপাশি স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরাপত্তা সরঞ্জাম নিশ্চিত করতে হবে। চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা নতুন ওষুধের (থেরাপিউটিক ড্রাগ) গবেষণা করবেন। রোগীকে নিজ দায়িত্বে হাসপাতালে আসা থেকে বিরত রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। সে জন্য পর্যাপ্ত অ্যাম্বুলেন্সের সংস্থান করা দরকার।

প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে টাস্কফোর্স দলের সদস্যরা তাঁদের কার্যক্রম সম্পর্কে জনগণকে প্রতিদিন অবহিত করবেন। বিশেষজ্ঞদের মতামত ও পর্যালোচনা জনগণকে আশ্বস্ত করবে এবং সঠিক কাজে উদ্বুদ্ধ করবে। আমরা সবাই মিলে আন্তরিকভাবে তৎপর হলে কোভিড-১৯ মোকাবিলায় বাংলাদেশ অবশ্যই সফল হবে।

তারিফুল ইসলাম: জনস্বাস্থ্য, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও গণযোগাযোগ বিশেষজ্ঞ
[email protected]