থানায় ঝুলন্ত লাশ ও আইজিপির পরামর্শ

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

দায়িত্ব পালনের সময় পুলিশ সদস্যদের সাধারণ মানুষের সঙ্গে বিনয়ী, সহিষ্ণু ও পেশাদার আচরণ করার নির্দেশ দিয়েছেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মো. জাবেদ পাটোয়ারী। ইউনিট কমান্ডারদের কাছে পাঠানো বার্তায় তিনি বলেছেন, ‘জনজীবন সচল রাখতে চিকিৎসা, ওষুধ, নিত্যপণ্য, খাদ্যদ্রব্য, বিদ্যুৎ, ব্যাংকিং, মোবাইল ফোনসহ আবশ্যক সব জরুরি সেবার সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তি ও যানবাহনের অবাধ চলাচল নিশ্চিত করুন। দায়িত্ব পালনকালে সাধারণ জনগণের সঙ্গে বিনয়ী, সহিষ্ণু ও পেশাদার আচরণ বজায় রাখুন।’

বিভিন্ন পত্রিকায় কোথাও কোথাও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের বাড়াবাড়ির খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এ নিয়ে সমালোচনামুখর। আইজিপি পুলিশকে পেশাগত দায়িত্ব পালনে সহিষ্ণু ও বিনয়ী হতে বলেছেন। কিন্তু মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা তা বিবেচনায় নিচ্ছেন বলে মনে হয় না।

সাধারণ মানুষ আইনবিরুদ্ধ কিছু করলে সেটি অসচেতনতা বা অজ্ঞতা বলে চালিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা যদি আইনবিরুদ্ধ কাজ করেন, তাহলে মানুষের যাওয়ার কোনো জায়গা থাকে না।

এই করোনা সংকটের মধ্যেই কয়েক দিন আগে দিনাজপুরের বিরলে পাটকলশ্রমিকেরা বকেয়া বেতনের দাবিতে আন্দোলন করছিলেন। কারখানাটি স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতার। তিনি শ্রমিকদের বকেয়া বেতন না দিয়েই কারখানা বন্ধ করতে চান। এতে শ্রমিকেরা ক্ষুব্ধ হন। তাঁরা বলেছেন, ‘আপনি আপনার কারখানা বন্ধ করুন, আপত্তি নেই। কিন্তু আমাদের বকেয়া বেতন-ভাতা দিতে হবে।’ কিন্তু মালিক তাঁর অবস্থানে অনড় থাকেন। ফলে শ্রমিকেরা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। মালিক শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণ করতে পুলিশ ডাকেন। শ্রমিকেরা ডাকলে কখনো পুলিশ আসে না। মালিক ডাকলে আসে। এরপর পুলিশ ও শ্রমিকদের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়ে যায়। শ্রমিকেরাও কারখানা ভাঙচুর শুরু করেন। তাঁদের নিবৃত্ত করতে পুলিশ গুলি চালালে কয়েকজন শ্রমিক আহত এবং একজন দোকানদার নিহত হন।

যেকোনো আন্দোলন বা বিক্ষোভ দমন করার সহজ উপায় হিসেবে শক্তি প্রয়োগের পথই বেছে নেওয়া হয়। প্রথমে লাঠিপেটা, তারপর কাঁদানে গ্যাসের শেল। তাতেও কাজ না হলে গুলি। বেতন না পাওয়া শ্রমিকদের পরিণতি যেন লাশ হয়ে যাওয়া। এর আগে খুলনায়ও পাটকলশ্রমিকদের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে হতাহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছিল।

বরগুনার আমতলী থানার ঘটনাটি আরও মর্মান্তিক ও নৃশংস। আজ শনিবার ইত্তেফাক–এ প্রকাশিত খবরের শিরোনাম ছিল: ‘ওসির কক্ষে আসামির ঝুলন্ত লাশ’। ওসির কক্ষে যাঁর ঝুলন্ত লাশ পাওয়া গেছে, তাঁর নাম শানু হাওলাদার। গুলিশাখালী ইউনিয়নের পশ্চিম কলাগাছিয়া গ্রামের বাসিন্দা। পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হয়, তাঁকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। আর পুলিশের দাবি, শানু হাওলাদার আত্মহত্যা করেছেন।

একজন মানুষ আত্মহত্যা করতে কেন থানার ওসির কক্ষ বেছে নেবেন? পুলিশ ২৩ মার্চ তাঁকে বাড়ি থেকে ধরে থানায় নিয়ে এল। আর চার দিনের মাথায় লাশ হয়ে গেল। ওসির কক্ষে একজন মানুষ ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে আত্মহত্যা করলেন, কেউ দেখলেন না! ওসি সাহেব কোথায় ছিলেন? অন্যান্য পুলিশ সদস্য কোথায় ছিলেন?

ওসি সাহেব কি একজন আসামির জন্য তাঁর কক্ষ খুলে দিয়েছিলেন, যাতে তিনি নিরাপদে আত্মহত্যা করতে পারেন? ফৌজদারি আইন অনুযায়ী আত্মহত্যাও অপরাধ। আত্মহত্যাকারীকে যিনি সহায়তা করেন, তিনিও অপরাধী। আসলে একটি সত্যকে আড়াল করতে গিয়ে আমতলী থানার পুলিশ অনেক মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছে।

শানু হাওলাদারকে হত্যা করা হয়েছে, না তিনি আত্মহত্যা করেছেন, সেটি বের করার উপায় এর সুষ্ঠু তদন্ত। কিন্তু সুষ্ঠু তদন্তটি কে করবে? বরগুনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের কমিটি করা হয়েছে। অর্থাৎ পুলিশ অভিযুক্ত। আবার পুলিশই তদন্তকারী। পুলিশ সংস্কার কমিশন আলাদা তদন্তকারী সংস্থা করার সুপারিশ করা হয়েছিল। সেটি এখনো আলোর মুখ দেখেনি। কোনো সরকারই চায় না পুলিশ বিভাগে সংস্কার হোক। পুলিশের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ পুলিশ তদন্ত করলে সত্য বেরিয়ে আসবে না। এ জন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক দলের নেতা ও নাগরিক কমিটির নেতারা বিচার বিভাগীয় কমিটির দাবি জানিয়েছেন।

শানু হাওলাদারকে গ্রেপ্তার করা হয় ২৩ মার্চ। আর থানার ওসির কক্ষে ঝুলন্ত লাশ পাওয়া যায় ২৮ মার্চ। এই চার দিন তিনি কোথায় ছিলেন? পুলিশের দাবি অনুযায়ী যদি শানু হাওলাদার গুরুতর অপরাধও করে থাকেন, তাঁকে কেন আদালতে সোপর্দ করা হলো না? থানা-পুলিশ কোনো আসামিকে গ্রেপ্তার করার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে সোপর্দ করার কথা।

তাহলে কি পরিবারের কথাই ঠিক যে পুলিশ তাঁর কাছ থেকে মোটা অঙ্কের উৎকোচ চেয়েছিল, তিনি সেই টাকা দেননি বা দিতে অসমর্থ ছিলেন বলে তাঁকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে?

আমতলী থানার ঘটনাটি যে গুরুতর, তা পুলিশ বিভাগের তৎপরতা দেখেই বোঝা যায়। যেদিন ওসির কক্ষের শানু হাওলাদারের লাশ পাওয়া গেল, সেদিনই থানার ওসি (তদন্ত) মনোরঞ্জন মিস্ত্রি ও ডিউটি অফিসার এএসআই আরিফকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এরপর থানার ওসি আবুল বাশারকে প্রত্যাহার করে বরগুনা পুলিশ লাইনসে সংযুক্ত করা হয়।

এ ঘটনা এমন সময়ে ঘটল, যখন করোনা সংকটের কারণে সারা দেশে লকডাউন চলছে। লকডাউন সাধারণ মানুষের জন্য হলেও আমতলী থানার পুলিশের জন্য নয়। তারা শানু হাওলাদার নামের এক আসামিকে চিরতরে লকডাউন করে দিল।

আইজিপির নির্দেশনা ও পরামর্শ আমতলী থানার ওসি বা মাঠপর্যায়ের অনেক পুলিশ কর্মকর্তাই আমলে নেন না। মানে পুলিশের চেইন অব কমান্ড খুব কাজে দিচ্ছে না। ফলে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে যতই সহিষ্ণু ও বিনীত হতে বলা হয়, বাস্তবে তার প্রতিফলন ঘটে না।

‘এই পুলিশ লইয়া আমরা কী করিব?’

সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]