করোনা-সংকটে ডেঙ্গুর পদধ্বনি

দেশের পুরো স্বাস্থ্যব্যবস্থার দৃষ্টি এখন করোনাভাইরাসের দিকে। এই রোগ মহামারি আকারে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ার আগেই তা রোধ করতে এখন সব শক্তি নিয়োগ করতে হচ্ছে। ফলে আমরা যে অচিরেই আরও একটি বড় স্বাস্থ্য–সমস্যার মুখোমুখি হতে পারি, সেটা প্রায় ভুলে গেছি।

সমস্যাটা ডেঙ্গু জ্বর। এই রোগে গত বছর প্রচুর মানুষকে ভুগতে হয়েছে, সরকারি হিসাবেই মারা গেছে ১৭৯ জন, বেসরকারি হিসাবে সংখ্যাটি ছিল ৩০০। কেন গত বছর ডেঙ্গুর এমন প্রকোপ ঘটেছিল, তা খতিয়ে দেখতে হাইকোর্টের নির্দেশে গঠিত বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটির চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের গাফিলতি ছিল ডেঙ্গুর প্রকোপ এত বেশি হওয়ার আংশিক কারণ। আর এ বছর যখন ডেঙ্গুর মৌসুম (এপ্রিল-অক্টোবর) এগিয়ে আসছে, তখন দেখা দিয়েছে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব। ফলে মহানগরের বিভিন্ন স্থান জীবাণুমুক্ত করার চেষ্টা করতে গিয়ে মশকনিধন কার্যক্রমে ভাটা পড়লে এ বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ সামলানো অত্যন্ত দুরূহ হয়ে পড়বে।

এ বছর ডেঙ্গুর মৌসুম শুরু হওয়ার আগেই অনেক মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হয়েছে। উদ্বেগের বিষয়, গত বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত যত মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিল, এ বছরের একই সময়ে আক্রান্ত হয়েছে তার প্রায় চার গুণ বেশি মানুষ। গত শুক্রবারও এক ব্যক্তি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ঢাকার একটি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ বিশেষজ্ঞরা পূর্বাভাস দিচ্ছেন, এ বছরের ডেঙ্গুর প্রকোপ গত বছরের রেকর্ড ছাড়িয়ে যেতে পারে। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ও এডিস মশার ঘনত্ব পর্যবেক্ষণ করে কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ বলেছেন, আগামী জুলাই-আগস্ট মাসে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়বে।

আমাদের লক্ষ রাখা দরকার, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব মোকাবিলার প্রস্তুতি নিতে গিয়ে গোটা দেশের সরকারি চিকিৎসাব্যবস্থার ওপর বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি হয়েছে। ইতিমধ্যে খবর পাওয়া যাচ্ছে যে করোনা-আক্রান্ত নয়, নানা রোগব্যাধিতে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা পাওয়া এখন অনেকটাই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। চিকিৎসকদের মধ্যে করোনা থেকে সুরক্ষার বিষয়ে অসন্তোষ রয়েছে, কয়েকজন চিকিৎসক ইতিমধ্যে এই রোগে আক্রান্ত হয়েছেন বলে খবর বেরিয়েছে, আরও কয়েকজনকে কোয়ারেন্টিনে যেতে হয়েছে। সংক্রমণের হার বাড়তে থাকলে অনেক চিকিৎসককে আইসোলেশনে যেতে হতে পারে। সব মিলিয়ে স্বাভাবিক দৈনন্দিন চিকিৎসা কার্যক্রমে বিঘ্ন সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা বাড়ছে। এই পরিস্থিতিতে করোনার প্রকোপ বৃদ্ধির সমান্তরালে যদি ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দেয়, তাহলে চিকিৎসাব্যবস্থার জন্য সেটা হবে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ অবস্থা।

আমরা যেন সেই অবস্থায় পড়ে না যাই, সে জন্য এখন থেকেই ডেঙ্গু প্রতিরোধের লক্ষ্যে মশকনিধন ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রমসহ অন্যান্য কাজ শুরু করতে হবে। বস্তুত ডেঙ্গুর প্রাক্‌-মৌসুম হিসেবে মার্চ মাস থেকেই যেসব কর্মসূচি পালন করার কথা, এ বছর সেগুলোর অধিকাংশই করা হয়নি। আমরা মনে করি, আর কালক্ষেপণ করার সুযোগ নেই, এখনই ডেঙ্গু প্রতিরোধের ব্যাপক প্রস্তুতি শুরু করা প্রয়োজন। মহানগরের বিভিন্ন স্থান জীবাণুমুক্ত করার পাশাপাশি মশকনিধনের কার্যক্রমও জোরদার করা হোক। দুই সিটি করপোরেশনকে এ বিষয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে, সেই সঙ্গে পাড়া-মহল্লার মানুষ, নাগরিক সমাজকে নিয়ে ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টির উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।