দয়া করে কলঙ্ক, আতঙ্ক, ঘৃণা ছড়াবেন না

‘সিঙ্গাপুর থেকে আসা পিতা দুধের শিশুকে আক্রান্ত করে এখন পলাতক’। এটি একটি সংবাদ শিরোনাম। সামাজিক মাধ্যমে খুব চালাচালি হচ্ছে সংবাদটি। শিরোনাম পাঠেই পাঠকদের অনুভূতিগুলো কী কী হতে পারে ভাবুন—

-বাবা না আর কিছু?

-কী রকম দায়িত্বজ্ঞানহীন! কেন এসেছে এ অবস্থায়?

-কী রকম স্বার্থপর রে, বাবা! নিজে বাঁচতে পালিয়েছে!

-না জানি স্ত্রীকেও আক্রান্ত দিয়ে গেল কি না। না জানি আরও কতজনকে আক্রান্ত করে দিয়ে গেছে!

এ রকম আরও বহু অনুসিদ্ধান্ত টানা যেতে পারে, যেগুলোর বেশির ভাগই শিশুর পিতার দানব-ভাবমূর্তি তৈরি করবে। নিদেনপক্ষে তাকে অপরাধীর কাঠগড়ায় ওঠানোর মতো মন্দ মানুষ তো মনে হবেই। তাতে করে খুব সহজেই আমরা যা হারিয়ে ফেলি, তার নাম ‘সংবেদনশীলতা’।

মানুষটির দানব রূপ তৈরি করে আমরা নিজেরাও কিন্তু ঊন মানুষ হয়ে যাই। আমরা সহজ অনুধাবন, কাণ্ডজ্ঞান এবং বিবেচনাবোধও হারিয়ে ফেলি। তাই আমরা বিকল্প অনুসিদ্ধান্তগুলো ভাবতেই পারি না যে লোকটি হয়তো ভেবেছে—

-তাড়াতাড়ি দূরে সরে গেলেই শিশুটি বেঁচে যাবে। সংক্রমণ হয়তো এখনো তেমন হয়নি, থাকলেই বরং সংক্রমণ বিপজ্জনক ও অনিরাময়যোগ্য হবে।

-স্ত্রীসহ অন্যদের যাতে আরও সংক্রমিত করতে না হয়, সে জন্য দায়িত্ববান বলেই লোকটি দূরে চলে গেছে।

-অসহনীয় মানসিক যন্ত্রণা, অপরাধবোধ ও আত্মগ্লানিই মানুষটিকে সরে যেতে বাধ্য করেছে।

-প্রাণের ভয়ে মানুষটি আত্মরক্ষার ব্যবস্থা নিয়েছে। সমাজ নিষ্ঠুর হয়ে উঠেছে। করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের শারীরিক আক্রমণের অনেকগুলো ঘটনা যে ঘটেছে, সেসব সংবাদ লোকটির জানা। তাই তাঁর আতঙ্ক তৈরি হয়েছে।

-এই সময়ে তিনি কেন দেশে এসেছেন অভিযোগে নানা রকম তিরস্কার-গঞ্জনা স্ত্রী ও আত্মীয়-পরিজনদের কাছ থেকে শুনতে হতে পারে ভেবেছেন।

-স্ত্রী রাগের মাথায় তাঁকে ছেড়ে যেতে পারেন, তালাক দিতে পারেন। স্ত্রী-সন্তানকে না হারানোর আশঙ্কা ও তাড়নাতেই হয়তো তেমনটি করেছে। ভেবে নিয়েছে করোনার কাল কেটে গেলে, স্ত্রী-সন্তান বেঁচে গেলে ফিরে আসবেন। তখন চলে যাওয়ার কারণ বুঝিয়ে বললে বুঝে নেবে সবাই।

পত্রিকার শিরোনাম খুব সহজেই আমাদের মনোজগৎ নিয়ন্ত্রণ করে। মহামারির যেকোনো কালের মতো বর্তমান সময়টিও সামাজিক দুর্যোগের কাল। স্টিগমা বা কলঙ্কবোধ এই সময়ের অন্যতম বড় সামাজিক সমস্যা। একটি সময় ছিল যখন মানুষ আশপাশে এইডস রোগী আছে শুনলে পালাত। স্ত্রী-সন্তান স্বামীকে ছেড়ে পালাত। কোনো গ্রামে এইডস রোগী একজন শনাক্ত হলে গ্রামবাসীর অনেকে জমিজিরেত বেচে দিয়েও অন্য জায়গায় চলে যেত। এসবই স্টিগমা। এখন আমরা জানি, এইডস কথায় কথায় ছড়ায় না এবং একটি নিরাময়যোগ্য রোগ। ‘কলঙ্কভীতি’কে ইংরেজি ‘স্টিগমা’–এর দুর্বল বাংলা বলা যেতে পারে। রোগীর প্রতি একধরনের কলঙ্কজাত ঘৃণা আরোপ করাই স্টিগমা। ঘৃণার পেছনে থাকে সংক্রমণের ভয়। তারও আড়ালে থাকে অজ্ঞতা, তথ্যের অভাব, গুজব, সংবেদনহীন জনশ্রুতি ইত্যাদি।

সামাজিক কলঙ্কভীতির অত্যন্ত বাজে পরিণাম রোগীর মানসিক ট্রমা। ‘ট্রমা’ বলতে ভীতিসঞ্জাত অসহ্য মানসিক যাতনাকে বোঝায়। যিনি আক্রান্ত তার মানসিক যন্ত্রণা থাকে সীমাহীন। তিনি জানেন, কেউ তাঁকে পছন্দ করছে না কিংবা ভয় পাচ্ছে অথবা ঘৃণা করছে। একদিকে রোগভোগ, অন্যদিকে সমাজের বিরুদ্ধাচরণ, অসমর্থন, ঘৃণা-বিদ্বেষ তাই অনেককে আত্মহত্যাপ্রবণও করে তোলে।

সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমের শিরোনামগুলোতে চমক তৈরির যে চেষ্টা দেখা যাচ্ছে, সেগুলোকে দায়িত্বপূর্ণ সাংবাদিকতা বলার সুযোগ নেই। কারণ, সংবেদনহীন শিরোনামগুলো অসুখটির ভয়াবহতা নির্দেশ করতে গিয়ে সামাজিক বন্ধনের অন্তর্গত সুমধুর রসায়নকে প্রায়ই অস্বীকার করে বসে। এ রকম কয়েকটি অসংগত শিরোনাম—

-স্বামী ইতালি হতে ফিরেছে জেনে স্ত্রীর পলায়ন

-করোনায় আক্রান্ত সন্দেহে প্রবাসীকে গণপিটুনি

-প্রবাসী জেনে রোগীকে রেখে ডাক্তারের পলায়ন

-প্রবাসীদের বাজারে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা বাজার কমিটির

এগুলো সবই নেতিবাচক শিরোনাম। হতে পারে পাঠক এ রকম শিরোনামে আকৃষ্ট হন বেশি। কিন্তু এ ধরনের শিরোনাম সমাজে নেতিবাচক মনোভাব তৈরি করে। সমাজের মানুষজন এতটাই ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ওঠেন যে আশপাশে কোনো রোগী আছেন শুনলেই আঁতকে ওঠেন। এই রকম স্টিগমা অসুখের ঝুঁকি আরও অনেক বেশি বাড়ায়। তাই যাঁরা অসুস্থ, তাঁদের মধ্যে ব্যাধি গোপন করার মানসিকতা তৈরি হয়। একজন রোগীর হয়তো লক্ষণগুলো প্রাথমিক পর্যায়ের, যা লুকিয়ে রাখা সম্ভব। জনভীতির কারণে তাঁরা সেগুলো যথাসাধ্য লুকিয়ে রাখবেন। তাতে ঝুঁকি বাড়ে। কারণ, বাহকদের কেউ সেরে গেলেও অন্য অনেককে জ্যামিতিক হারে সংক্রমিত করে যাবেন। তাঁদের কারও কারও বেলায় শারীরিক শক্তি-সামর্থ্য ও উত্তম রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতার কারণে ভাইরাস চূড়ান্ত ক্ষতি বা মৃত্যুর কারণ না–ও হতে পারে। কিন্তু তাঁদের রোগ গোপন করার কারণে দুর্বল রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতার অন্য অনেকেই আক্রান্ত হতে পারেন। মারাও যেতে পারেন।

সামাজিক স্টিগমা এবং ব্যাধিগ্রস্তের ট্রমা সব সময়েই ছোঁয়াচে রোগ নিয়ন্ত্রণে বড়সড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এরই মধ্যে ট্রমা ও স্টিগমা উসকে দেওয়া সংবাদ শিরোনাম গোদের ওপর বিষফোড়ার মতো অতিরিক্ত ক্ষতিকর হয়ে উঠতে পারে।

প্রচারমাধ্যমগুলো ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো স্টিগমা ও ট্রমা ছড়িয়ে দেওয়ার বাহন না হয়ে উঠুক।

হেলাল মহিউদ্দীন: অধ্যাপক, রাজনীতিবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান; এবং গবেষক, সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়