এই শান্তি চেয়েছিলে বুঝি?

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

করোনা মৌলিক জায়গায় হাত দিয়েছে। মানবিকতা, স্নেহ-ভালোবাসা, দায়িত্বশীলতার পরীক্ষায় ফেলেছে এই বহুরূপী ভাইরাস। শাসক-শাসিত যা-ই হই, মানুষ হিসেবে, পিতা-মাতা, ভাই-বোন-সন্তান হিসেবে আমরা কি আমাদের সেরাটা দেব, নাকি আগের চেয়ে খারাপ করে ফেলব—সেই পরীক্ষা। আমরা ছুটি চেয়েছি অন্তহীন ছোটাছুটি থেকে। হট্টগোল থেকে ঘরের শান্তি চেয়েছি। চেয়েছি অবসর; শরীরের আরাম আর মনের বিরাম। প্রতিটি কর্মজীবী মানুষ এই শান্তি চায়নি কি? তাহলে কেন শান্তি পাচ্ছি না?

এক চীনা ড্রাগন দেবতার খুব ভক্ত। সকাল-সন্ধ্যা দেবতার আরাধনা করে আর ডাকে, ‘দেখা দাও, দেখা দাও’। ভক্তের অতি ডাকাডাকিতে ড্রাগন দেবতার মনে ভাবের উদয় হলো। তিনি এক শুভদিনে দেখা দিলেন। সে কী ভয়াল মূর্তি, মুখ দিয়ে আগুন ছুটছে। এ দেখে ভক্ত ভয়ে প্রাণ যায় যায় অবস্থা। ভগবান, এই কি চেয়েছিলাম! বলতে বলতে ভক্ত জানপ্রাণ দিয়ে ছুট লাগাল।

আমাদেরও সেই দশা। করোনা এসে বিশ্রাম দিল। কিন্তু এই শান্তি কি চেয়েছিলাম? যখন মেলামেশা বন্ধ, ছোঁয়াছুঁয়ির স্বাধীনতা লোপাট, মনে কুটকুট করে প্রাণ সংশয়ের ভয়, তখন শান্তি ও ছুটির অর্থ নতুন করে ভেবে নিতে হবে। অনেক সময় আমরা আমাদের সত্যিকার চাওয়াগুলোকে ভয় পাই।

সব মন্দের একটা ভালো আছে। করোনা আমাদের জীবনযাপন নবায়নের সুযোগ দিয়েছে। যদি আমি আমার পরিবারকে এই দুঃসময়ে ভালো না রাখি, সবাই সবাইকে আনন্দ, সুবিধা, সেবা দেওয়ার চেষ্টা না করি, তাহলে ঘরে কেউ টিকব না। যত অমানবিক ও স্বার্থপর হব, ততই ঘরের মানুষ বাইরে যেতে বাধ্য হব, আর ততই কাছে চলে আসবে করোনা।

লকডাউন, হোম কোয়ারেন্টিন অনেকের জীবন বিষিয়ে তুলছে। ইরানের আয়াতুল্লাহ খোমেনি লেখক সালমান রুশদিকে মৃত্যুদণ্ডের ফতোয়া দিলে তাঁকে অনেক দিন নিরাপত্তার খাতিরে গৃহবন্দী থাকতে হয়। সে সময় তাঁর স্ত্রী ছিলেন মেরিঅ্যান। ও রকম দিনেই মেরিঅ্যান রুশদিকে ত্যাগ করেন। পরে তিনি বলেছেন, যদি স্রেফ বারান্দায় গিয়ে মানুষ দেখতে পারতাম, তাহলেও হয়তো রুশদিকে ছেড়ে যেতাম না। করোনার কবলে আটকে থেকে অনেকের পারিবারিক সম্পর্ক খারাপ হয়ে যাচ্ছে, অনেকে ভুগছে বিষাদে। করোনা কেবল জনস্বাস্থ্য ও অর্থনীতিকেই খারাপ করছে না, তা বিশাল জনগোষ্ঠীকে অবসাদগ্রস্ত করছে। এ রকম দিনে উদ্দীপ্ত ও আশাবাদী হওয়া, পারিবারিক সময়কে উপভোগ্য করার চমৎকার মন তৈরি করা জরুরি।

ঘরে যেসব কাজ করতে চাইনি এত দিন, সেসব করার আনন্দ নিতে জানতে হবে। পারিবারিক বন্ডিং ও গৃহস্থালি সহযোগিতা দিয়েই সেটা করা যায়। আমরা নিজেদের ভালোবাসি, নিজেদের সক্ষমতায় অনেকেরই অনেক আত্মবিশ্বাস। করোনার সময়ে নিজেকে সহমর্মী করে তুলে, অন্যদের ভরসা হয়ে উঠে সেই ভালোবাসা ও সক্ষমতার প্রমাণ দিতে পারি না কি?

আধুনিকতা আমাদের শিখিয়েছে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী হতে, কেবলই একার উন্নতির পথে সবার উন্নতি হবে বলা হয়েছে। প্রকৃতিকে জয় করাকেই ভাবা হয়েছে সভ্যতা। আজ সকলই গরল ভেল। জনস্বাস্থ্য নিশ্চিত না হলে ব্যক্তির স্বাস্থ্য নিরাপত্তাও থাকে না। ভোগের রাস্তায় পৃথিবীকে শেষ করে দিলে পৃথিবী মহামারি দিয়ে মানুষকে শেষ করে দেবে। একা একা বাঁচা যায় না। লকডাউন, কোয়ারেন্টিন ও আইসোলেশনের দিনে সেটা কি আমরা উপলব্ধিতে আনতে পারছি? করোনা ধনী-গরিব মানছে না। আজ যদি গরিবের স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক সামর্থ্যের খোঁজ না রাখি, তাহলে দেশের স্বাস্থ্যই ভয়ানক খারাপ হয়ে যাবে। বনজঙ্গল, নদী-নালাগুলো যদি না বাঁচে, আমরাও বাঁচব না।

পুঁজিবাদ হয়ে পড়েছে এক মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ, একসময় তা কিছু মঙ্গল করলেও আজকের দুনিয়ার সব অশান্তি, বিপর্যয়ের গোড়া এখানেই। জলবায়ু পরিবর্তন, দূষণ, দারিদ্র্য ও যুদ্ধে সর্বনাশ হয় হোক, পুঁজিবাদের বিকল্প নেই, পুঁজিবাদ অমর; এই বিশ্বাস মৌলবাদ, এই নীতি মহামারিবান্ধব। করোনা আমাদের হুঁশ ফেরাতে বলছে।

 করোনা কারুকে অসামাজিক-অপারিবারিক হতে বলেনি। আছোঁয়া থাকা মানে শারীরিক দূরত্বে থাকা, অসামাজিক হয়ে পড়া না। যে দেশে, সমাজে ও পরিবারে মানবতার সংক্রমণ যত শক্তিশালী, সেখানে করোনার সংক্রমণ সবচেয়ে কম। কিন্তু করোনা মোকাবিলায় ব্যক্তিমানুষ থেকে পুলিশ ও প্রশাসনের মধ্যে অমানবিক আচরণের সংক্রমণ ঘটছে। কিউবায় একটা কল্যাণমূলক সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা আছে। বিশাল প্রবৃদ্ধি, হাজারো বিলিয়নিয়ার কিংবা বেগমপাড়ানিবাসী লোক তাদের নেই। কিন্তু তারাই আজ বিশ্বের অন্যতম নিরাপদ দেশ। ষাট-সত্তর দশকে যুক্তরাষ্ট্র জীবাণু অস্ত্রের আক্রমণ চালাত কিউবায়। আখখেতে মড়ক লাগানো, ডেঙ্গু জ্বর ছড়ানো ইত্যাদি। এর মোকাবিলায় কিউবা চিকিৎসাব্যবস্থা শক্তিশালী করে, বিনিয়োগ বাড়ায় জনস্বাস্থ্য গবেষণায়। তার ফল কিউবার স্বাস্থ্যব্যবস্থার অসাধারণ উন্নতি। কিউবার ডাক্তাররা আজ ইতালিকে সেবা দিচ্ছেন, তাদের শিক্ষকেরা ভেনেজুয়েলা-বলিভিয়া থেকে আফ্রিকা পর্যন্ত অবদান রেখে চলেছে। অসুবিধাকে এভাবে সুবিধায় পরিণত করতে পারার শিক্ষা আমরা কি নেব না? ক্লায়েন্ট নির্ভর চিকিৎসাব্যবস্থাকে পাবলিকমুখী ব্যবস্থায় রূপান্তরের ডাক দিচ্ছে করোনা।

মহামারি সহানুভূতিকেও হত্যা করে। একদিকে লাঠিপেটা, স্বার্থপরতা, মজুতদারি, নির্বিকার স্বার্থপরতা, অন্যদিকে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর মানবিকতা। প্রথমটায় করোনাকে শক্তিশালী করে, দ্বিতীয় ধরনের লোকেদের ভয় পায় করোনা। করোনার দিন শেষ হবেই। কিন্তু আমরা কি আগের মতোই চলব, নাকি রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি বদলাব; ঘরে বসে এই ভাবনা ভাবা খুবই দরকার। বিপদের দিনে বন্ধু তোমার পথের সাথিকে চিনে নিয়ো।

ফারুক ওয়াসিফ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক