সংকটে মুনাফা নয়, জয়ী হোক মানবিকতা

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

গত দুই মাসে বিশ্ব যেন ওলটপালট হয়ে গেছে। বুলেটের বেগে বিভিন্ন দেশে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে। এই মহামারিতে যেমন মানুষ মারা যাচ্ছে, তেমনি নাজুক হয়ে পড়ছে গোটা বিশ্বের অর্থনীতি। বিভিন্ন দেশে লকডাউন করা হয়েছে। লকডাউনের আগে যে যা পারছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনে ঘরে ঢুকে যাচ্ছে। বলা যায়, করোনাভাইরাস মহামারির কারণে সব অর্থনীতিই এখন তীব্র সরবরাহ সংকটে পড়েছে।

অনেক দিন ধরে যুক্তরাজ্যের স্কটল্যান্ডে আছি। ইউনিভার্সিটি অব এবারডিনে পড়াই। এর আগে অস্ট্রেলিয়ায় ছিলাম। ১৫ বছরের প্রবাস জীবনে এমন অদ্ভুত পরিস্থিতি আর দেখিনি। সুপারশপগুলোতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসহ খাদ্য সরবরাহ খুবই কম। দোকানগুলোতে স্যানিটাইজার থেকে শুরু করে সাবানজাতীয় সব পণ্যের শেলফ ফাঁকা। তবে এর মধ্যে একটা স্বস্তিদায়ক বিষয়, জিনিসের দাম বাড়েনি। একটি মজার অভিজ্ঞতা বলি, সেদিন একটি সুপারশপে ভোজ্যতেল কিনতে গিয়েছি। সাধারণত যে ব্র্যান্ডের তেল কিনি সেটি নেই। আরেকটি ব্র্যান্ডের তেল আছে যেটি একটু দামি। আর কিছু না থাকায় অগত্যা ওটাই নিলাম, দাম পরিশোধ করতে গিয়ে দেখি ওই তেলের দাম অর্ধেক করে দিয়েছেন দোকানি। যেহেতু এই তেলের দাম বেশি এবং অন্য পণ্য নেই, তাই ক্রেতার জন্য দামটা কমিয়ে দিয়েছেন তাঁরা। শুধু এই দোকান নয়, বেশির ভাগ দোকানই নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যের (যেমন রুটি, ডিম, দুধ) দাম বাড়ায় না, ক্ষেত্রবিশেষে কমিয়ে রাখা হয়েছে। এটা তাঁরা করেছেন তাঁদের সামাজিক ও নৈতিক দায়িত্ববোধ থেকে। করোনাভাইরাস সংকটের কোনো অন্যায্য সুযোগ তাঁরা নিতে চান না।

একই সময়ে বিদেশে বসে নিজের দেশেরও কিছু গল্প শুনলাম। এই সংকটের সময়ে দেশে থাকা পরিচিতজনেরা ১৫০ টাকার হ্যান্ড স্যানিটাইজার কিনেছে ৩০০ টাকায়। মুখের মাস্কের দাম বেড়েছে ঘণ্টায় ঘণ্টায়। বিকেলে ৫০ টাকায় কিনলে সন্ধ্যায় গিয়ে তা ১২০ টাকায় কিনেছে মানুষ। এমনও ঘটনা পড়লাম গণমাধ্যমে, এক দোকানের চেয়ে আরেক দোকান দাম কম রাখায় মারামারি বেধে গেছে। পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকার পরও করোনা-আতঙ্কের সুযোগ নিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে বিচার করতে হয়েছে অনেক মানুষের।

একই ধরনের আচরণ লক্ষ করছি প্রবাসে আমাদের দক্ষিণ এশীয় (বাংলাদেশি, ভারতীয় কিংবা শ্রীলঙ্কান) ব্যবসায়ীদের মধ্যেও। চাল, ডাল, দেশি মাছ অথবা হালাল মাংসের জন্য দেশি ও সাউথ এশিয়ান গ্রোসারি স্টোরেই আমরা যাই। যুক্তরাজ্যে হলেও এখানে অভিজ্ঞতাটা ভিন্ন হচ্ছে। এই অস্থির সময়ে প্রায় সব জিনিসের দাম অনেক বাড়িয়ে দিয়েছেন প্রবাসী ব্যবসায়ীরা। ছোট আয়তনের দোকানে পণ্য সরবরাহকারীরাও দাম বাড়ানোর সঙ্গে জড়িত থাকতে পারেন।

বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশিরা অতিথিপরায়ণ। এ গুণটি প্রবাসী ব্যবসায়ীদের মাঝেও আছে। অস্ট্রেলিয়ার সিডনি, যুক্তরাজ্যের লন্ডন অথবা যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের কোনো বাংলাদেশি রেস্তোরাঁয় গিয়ে নতুন প্রবাসী হিসেবে পরিচয় দিলে তাঁরা আপনাকে আপ্যায়ন করবেন, আপনার খোঁজখবর নেবেন, এতটুকু অভিজ্ঞতা প্রবাসীদের আছে। অতিথিপরায়ণতা অবশ্যই একটি ভালো গুণ, তবে একজন নৈতিকতা ও সামাজিক দায়িত্ববোধসম্পন্ন ব্যবসায়ী হওয়ার জন্য এতটুকু গুণ যথেষ্ট নয়।

সংকটের সময় সরবরাহ কমে গেলে পণ্যের দাম বাড়িয়ে অতিরিক্ত মুনাফা করা বাজার অর্থনীতির বাইরে নয়। চাহিদা ও জোগানের হিসাবে দামটা বাড়ে। তবে সভ্য সমাজ একে ভালো চোখে দেখে না। তাই রাতারাতি ঘণ্টাখানেকের মধ্যে দাম বেড়ে যাচ্ছে—এমন ঘটনা যুক্তরাজ্যে তাদের দোকানে চোখে পড়েনি। এই ধরনের স্বাস্থ্য সংকটের সময় আসলে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সবাই যদি দায়িত্বসম্পন্ন আচরণ করেন, পরিস্থিতি কিছুটা হলেও স্বাভাবিক থাকে। কারণ সংকটের সময় ব্যবসায়ীদের সামাজিক ও নৈতিক দায়িত্ব বেড়ে যায়। এই নৈতিকতা প্রয়োগ করতে হয়। মানুষের বিপদে অতিরিক্ত মুনাফা তো দূরে থাক, কোনো মুনাফা করাই উচিত নয়। বৈশ্বিক এই সংকটময় মুহূর্তে সবার উচিত সবার জন্য এগিয়ে আসা।

করোনা মহামারিতে এখন পর্যন্ত ৩৪ হাজার মানুষ মারা গেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এমন দুর্যোগ আর দেখেনি বিশ্ব। সবার শত্রু এক। বাংলাদেশের মতো অধিক জনগোষ্ঠীর দেশে এটি মোকাবিলা করা আরও বড় চ্যালেঞ্জ। তবে আশা রাখি নৈতিকতা ও মমত্ববোধ দিয়ে সারা বিশ্বের মানুষ এই শত্রুর মোকাবিলা করতে পারবে। সংকটে মুনাফা নয়, জয়ী হোক মানবিকতা।

ড. ম. আজিজুল ইসলাম: চেয়ার ইন অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড প্রফেসর ইন সাসটেইনেবল অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ট্রান্সপারেন্সি, ইউনিভার্সিটি অব এবারডিন