সাংবাদিকের করোনাকাল দেখা

সংকট যত বড় হোক না কেন, জীবন চলে। মানুষকে নিজের রোজকার জীবন চালিয়ে নিতে হয়। আমরা সাংবাদিকতা করি এই জীবনের জন্য। একজন মানুষের জীবন, একে একে মিলে সবার জীবন। জীবন বাঁধা জীবনের সঙ্গে। জীবন মানে সম্পর্ক, প্রাণের সঙ্গে প্রাণের, প্রকৃতির সঙ্গে প্রাণের। সবাই ভালো না থাকলে একা কেউ ভালো থাকতে পারে না।

নতুন করোনাভাইরাসের কালে সাংবাদিকতার পথ খুঁজতে গিয়ে এই পুরোনো কথাগুলোর নির্যাস নতুন করে অনুভব করলাম। এখানেই আমার পথের রেখা দেখতে পেলাম। এখন চেনা জীবন থমকে গেছে। অজানা অনিশ্চয়তার ভয়, রোজকার জীবনের কঠিন ভার আর হতচকিত স্বার্থপরতার নানা চেহারা দেখছি। অন্যায়-অন্যায্যতা, বৈষম্য-বিভেদ, সুযোগের অভাব দেখছি। ক্ষমতার অক্ষমতা ও অদায়িত্বশীলতার নতুন-পুরোনো রূপ দেখছি।


পাশাপাশি মানুষের অন্যের জন্য দরদ আর উদ্ভাবনী শক্তির টুকরো টুকরো গল্পও জানতে পারছি। জীবনের স্বাভাবিকতা আর অস্বাভাবিকতার ওপরে হয়তোবা নতুন আলো পড়ছে। হয়তো না।

সাংবাদিক অতীতের ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে ভবিষ্যতে চোখ রেখে বর্তমানকে দেখেন। বইয়ে পড়া কথাটি মনের কোনায় পড়ে ছিল। আজ দেখি ধুলো ঝেড়ে সে সামনে হাজির হয়েছে। সাংবাদিকের কাজ সময়ের সত্যকে খোঁজা-দেখা-জানা-বোঝা আর জনমানুষকে তা জানানো। যাচাই-বাছাই করা তথ্য কোনো পক্ষ না নিয়ে যথাযথ প্রেক্ষাপটসমেত জানানো। সাংবাদিকের সত্যান্বেষণকে এভাবে বর্ণনা করা যায়।

আর আমার সব সময় মনে থাকে এক শেয়ালের গোপন কথা। ‘খুবই সরল’ এই গোপন কথাটা সে বলেছিল একটি গ্রহাণু থেকে পৃথিবীতে আসা একজন ছোট্ট রাজপুত্রকে। শেয়াল বলেছিল, কেবলমাত্র হৃদয় দিয়েই ঠিক জিনিসটি দেখা যায়; যা কিছু একান্ত জরুরি, চোখ তা দেখতে পায় না।

আনতোয়ান দ্য স্যাঁত-একসু পেরির দ্য লিটল প্রিন্স (ছোট্ট রাজপুত্র) বইটা যদি পড়া না থাকে, করোনাকালে সেটা অবশ্যই পড়বেন। যে সাংবাদিকেরা করোনার সত্য দেখছেন আর দেখাচ্ছেন, তাঁদেরও একই কথা বলি।

হৃদয় দিয়ে দেখা মানে কিন্তু নিজের ধারণা বা আবেগের বশে দেখা নয়। এ হলো মন দিয়ে, বোধ দিয়ে, চোখের দৃষ্টির সীমাবদ্ধতা ছাড়িয়ে সত্যকে দেখতে পারা। জীবনের পটভূমিতে সত্যকে দেখা। এখন ছাপা কাগজে, টিভিতে, অনলাইনে খবরের সাইটে অথবা ফেসবুক-টুইটার-ইনস্টাগ্রাম-ইউটিউবে, সামনাসামনি অথবা ফোনের আড্ডায় অনেক মানুষ করোনাভাইরাসের সর্বশেষ তথ্য জানতে চাইছে। নিজেকে আর প্রিয়জনকে নিরাপদে রাখার পরামর্শ খুঁজছে। তথ্য-পরামর্শেরও ঢল নামছে।

ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মহাপরিচালক তেদরোস আধানোম গেব্রেয়াসুস বলেছিলেন, আমরা এখন রোগের মহামারির সঙ্গে সঙ্গে ইনফোডেমিক অর্থাৎ কিনা তথ্যের মহামারির সঙ্গে লড়ছি। সেসব তথ্যের কিছু ঠিক, কিছু ভুল।

এই তথ্যের ঢলে করোনাভাইরাসের মতোই দ্রুত ছড়িয়েছে আতঙ্ক আর উদ্বেগ। আছে সরকারের অবহেলা বা তথ্য লুকানোর চর্চা। সুস্থির, আস্থাযোগ্য, সঠিক তথ্যবহুল, সৎ, স্বচ্ছ আর দিক-দেখানো সাংবাদিকতা এখন মানুষের বড় সহায় হতে পারে।

সম্প্রতি সরকার করোনা-সাংবাদিকতায় ‘অপপ্রচার বা গুজব’ নজরদারির উদ্যোগ নিয়েছে। সাংবাদিকেরও কিন্তু এখন সরকারকে নজরদারিতে রেখে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা করা অতি ফরজ কাজ।

১৪ মার্চ যুক্তরাজ্যের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় পাঁচজন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক তাঁদের করোনাবিষয়ক সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছেন। বিজ্ঞান সম্পাদক আয়ান স্যাম্পল জোর দিয়েছেন তথ্য যাচাই করার ওপর। সাংবাদিকতার এই মূল নীতিটি এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। 

আয়ান লিখেছেন, ভাইরাসটি কীভাবে ছড়ায়, সে-সম্পর্কিত কোনো বৈজ্ঞানিক লেখার ভুল ব্যাখ্যার ফল হবে মারাত্মক। মৃত্যুহার নিয়ে বিশেষ সতর্কতা দরকার-হারটার ভিত্তি কী? এটা কি নির্ণিত সংক্রমিত মানুষদের মধ্যে মৃত্যুর হার, নাকি সংক্রমিত ব্যক্তির মৃত্যুঝুঁকির হার (ইনফেকশন-ফ্যাটালিটি রেট)? দুটির মধ্যে গুরুতর পার্থক্য আছে।

মহামারি-অভিজ্ঞ আরও কয়েকজন সাংবাদিক মৃত্যুহারের বিষয়ে সতর্কতাকে সবিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের অলাভজনক বার্তাকক্ষ প্রোপাবলিকায় ক্যারোলিন চেন ৫ মার্চ লিখেছেন, মনে রাখতে হবে মৃত্যুহার একটি ধারণামাত্র (এসটিমেট)। 

সংক্রমণ শনাক্ত হওয়া ব্যক্তিদের সংখ্যা ধরে হিসাব করলে মৃত্যুহার যা হবে, সম্ভাব্য সংক্রমিত ব্যক্তিদের সংখ্যা ধরে করলে তা অনেক বদলে যাবে। শনাক্ত করার পরীক্ষা দুনিয়াজুড়েই খুব সীমিত। ক্যারোলিন যেকোনো প্রোজেকশন, প্রাক্কলন বা পূর্বাভাসের বেলাতেও সেটার ভিত্তি বুঝে সতর্কভাবে লিখতে বলছেন।

তথ্য-উপাত্ত আর পরিস্থিতি কিন্তু প্রতিদিন পাল্টে যাচ্ছে। হালনাগাদ করার জন্য আছে ডব্লিউএইচও, যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) আর বাংলাদেশের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)।

নিজে ভুল করা যাবে না। আবার গুজব বা ভুল তথ্য খণ্ডন করে ঠিক কথাটি জানানোও বড় দায়িত্ব। ডব্লিউএইচওর মিথ বাস্টার্স এবং পয়েন্টারের পলিটিফ্যাক্ট আর ইন্টান্যাশনাল ফ্যাক্ট-চেকিং নেটওয়ার্ক কাজে লাগবে।

এদিকে গার্ডিয়ান-এর লেখাটিতে বেইজিং ব্যুরোর প্রধান লিলি কুয়ো লিখেছেন, কখনো তাঁর দুশ্চিন্তা হতো সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের কণ্ঠস্বর খবরের ঢলে ডুবে যাচ্ছে কি না। অন্য সময় তিনি দুশ্চিন্তা করেন, যে মানুষদের গল্প বলছেন, তাঁদের নিরাপত্তা নিয়ে।

লিলি লিখেছেন, মানুষকে বিপদে না ফেলে এ সংকটের মানবিক দিকটি তুলে ধরার পন্থা নিয়ে তাঁরা প্রতিনিয়ত ভাবেন। মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি, বিচার-বিবেচনা আর সৃজনশীলতার দিকটি তুলে ধরতে চেষ্টা করেন। এ প্রসঙ্গে সরকারি নিয়ন্ত্রক বা সেন্সরকে পাশ কাটানো আর নাগরিক সাংবাদিকদের হারিয়ে যাওয়ার কথাও তিনি লিখেছেন।

মানুষের জীবনের জমিনে সত্য সহজে বোঝা যায়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক পয়েন্টার ইনস্টিটিউটের অ্যাল টম্পকিনস বলছেন, শুধু একজন ভুক্তভোগীর গল্প আতঙ্ক বাড়াবে। তাঁর পরামর্শ, জীবনের গল্পের পাশাপাশি পুরো পরিস্থিতির তথ্য-উপাত্ত দিন। সেটা সমস্যাকে প্রেক্ষাপটে ফেলে দেখাবে।

অ্যাল প্রতিদিনই করোনাভাইরাস-সম্পর্কিত সাংবাদিকতার নানা দিক নিয়ে লিখছেন (https://www.poynter.org/reporting-editing/2020/)। দুনিয়াজুড়ে সাংবাদিকেরা এই সংকটকালে নিজের শারীরিক ও মানসিক সুরক্ষা, সাংবাদিকতার কৌশল এবং দায়িত্ব চিহ্নিত করে পরামর্শ দিচ্ছেন।

অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের আন্তর্জাতিক মোর্চা গ্লোবাল ইনভেসিগেটিভ জার্নালিস্টস নেটওয়ার্কে (https://gijn.org/) সাংবাদিক মিরাজ আহমেদ চৌধুরী দুটি লেখায় অনেকগুলো পরামর্শ বাংলায় সংকলন করেছেন। যুক্তরাজ্যভিত্তিক জার্নালিজম.কো.ইউকে আর সলিউশনস জার্নালিজম নেটওয়ার্ক ভাবনার খোরাক জোগায়।

করোনাভাইরাসের দুনিয়ায় পরিবার-পরিজন নিয়ে বসবাস করে একই সঙ্গে সাংবাদিকের দায়িত্ব পালন করা কঠিন কাজ। সংক্রমণের ঝুঁকির পাশাপাশি আছে মানসিক চাপ। নিউইয়র্কের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকল্প ডার্ট সেন্টারে সেটা সামাল দেওয়ার খুব ভালো পরামর্শ আছে।

সাংবাদিকতা একটা উদ্বিগ্ন স্থবির সময় পার করছে। আমাদের কাজের ধরন পাল্টে যাচ্ছে। খবর সংগ্রহ করতে গেলে নিজের সুরক্ষা নিশ্চিত করার দায়িত্বটি বড় হয়ে আসে। ভাবতে হয়, অন্যকে যেন ঝুঁকিতে না ফেলি। কয়েকটি সংবাদমাধ্যম ভাগাভাগি করে তথ্য সংগ্রহের কথা কি ভাবা যায়?

মানুষের জীবন আর পরিস্থিতি নানা রকম। সাংবাদিককে সবার কথা বলতে হবে। যারা দুর্বল অবস্থানে, যাদের গলার জোর নেই, তাদের প্রতি বিশেষ দায়িত্ব থাকে। মাঠে নামলে দেখি, অনেকের জন্য করোনার ঝুঁকি ছাপিয়ে রোজকার জীবনের দাবি বড়।

সেদিন একজন রিকশাচালক আমাকে বলেছেন, ‘করোনা এখন আমগো প্যাটের মইধ্যে লাইগ্যা রইছে।’ এমন সব সংকটের কথা তুলে ধরা বিশেষ দরকার। করোনাকাল দীর্ঘ হবে। নতুন সংকটও আসবে। দরজায় কড়া নাড়ছে ডেঙ্গু। পরিবারে নির্যাতন, ধর্ষণ, অপরাধ, দুর্নীতি, বৈষম্য, বঞ্চনা-জীবনের চেনা সমস্যাগুলোও কি আর দূর হয়ে যাবে? বরং অর্থনৈতিকআর সামাজিক সংকট নতুন রূপ নেবে।

করোনাকালে খারাপ খবরই বেশি। খারাপ খবরে কিন্তু সমস্যা সমাধানের খোঁজ করা জরুরি। সরকার বা কর্তৃপক্ষীয় কারও অবহেলা-গাফিলতি-দায় চিহ্নিত করার সময়ও তেমনটা করা দরকার। নয়তো সে খবর কেবল ভয় আর হতাশা বাড়াবে। একইভাবে রোগের বিস্তার আর মৃত্যুহারের পাশাপাশি সেরে ওঠার মতো আশার খবরগুলো গুরুত্ব দিয়ে বলা দরকার। ভালো খবর আরও আছে।

ছোট-বড় মাত্রায় মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। বন্ধু-স্বজনেরা সুরক্ষা-দূরত্বে থেকেও নিকট হয়েছে। থম ধরা এই সময়ে যার সুযোগ আছে, সে নিজেকে নানাভাবে আবিষ্কার করছে। মানুষের সৃজনশীলতার গল্পগুলো সাংবাদিকেরা বলছেনও।

আসলে সাংবাদিকের দায়িত্ব চেনা কঠিন তো নয়। মানুষের কী জানা দরকার, কী তার অন্যকে জানানো দরকার, কী সে জানতে চায়-তা ভেবে, খুঁজে সত্য জানিয়ে মানুষের কাজে লাগা হচ্ছে দায়িত্ব। দায়িত্ব এটা করতে গিয়ে কারও অন্যায্য ক্ষতি না করা। দায়িত্ব উদ্বেগ না ছড়িয়ে সত্য জানানো।

সাংবাদিকতাকে ন্যায্য হতে হয়। বিষয় নির্বাচনে ও সত্য পরিবেশনে। কেবল ভাষা আর শব্দের ন্যায্যতা ও দায়িত্বশীলতা নিয়েই পাতার পর পাতা লেখা যায়। ‘আতঙ্ক’, ‘প্রাণঘাতী’, ‘ভয়ংকর’, বিদেশফেরত আর সংক্রমিত মানুষজনের ওপর ‘নজর রাখা’, ‘সংস্পর্শ’ এড়িয়ে চলা-এমন সব বিশেষণ আর উপস্থাপনা উদ্বেগই শুধু বাড়ায় না, আরও বড় ক্ষতি করে।

আতঙ্কিত উদ্বিগ্ন মানুষ ভুল সিদ্ধান্ত নেয়। স্বার্থপর হয়। ব্যক্তি বা গোষ্ঠী ধরে দোষারোপ করে। মানুষে মানুষে দূরত্ব বাড়ে। বিভেদ আর বৈষম্য বাড়ে। অনেকে নিজের এলাকায় কোয়ারেন্টিন কেন্দ্র বা হাসপাতাল স্থাপনে বাধা দিয়েছে। ভাইরাসটির সংক্রমণে মৃত ব্যক্তিকে এলাকার কবরস্থানে দাফন করতে দেয়নি। মৃত ব্যক্তির স্বজনদের বাঁচা হারাম করে তুলেছে। দেশে ফেরা প্রবাসীদের শত্রু বানিয়েছে। সর্দি-কাশি-জ্বরের রোগীকে ত্যাজ্য করছে।

সংক্রমণ ঠেকাতে ঘরবন্দী থাকা অথবা ছয় ফুট দূরত্বে থাকা আর এই বিচ্ছিন্নতা এক নয়। এই বিভেদ-বিচ্ছিন্নতা অমানবিক ও আত্মঘাতী। নভেল করোনাভাইরাস আর তার ফসল কোভিড-১৯ রোগ দুনিয়াজুড়ে কাউকে বাছবিচার করছে না। সব মানুষ যে একই নৌকার যাত্রী, এ কথা সে বুঝিয়ে দিয়েছে। সবাই মিলেই এই নৌকা পাড়ে নিতে হবে।
এ সময় সাংবাদিকের হৃদয় যেন বিরাম না মানে। আমাদের দেখা আর দেখানো মানুষকে মানুষের সঙ্গে সম্পৃক্ত করুক, ঠিক কাজটি করতে সাহায্য করুক।