'ভাত যদি না পাই, পানি খায়া থাকমু'

এই মানুষেরা খাবার পাওয়ার অনিশ্চয়তায় এমনই কাতর যে, করোনাভাইরাস মহামারি সম্পর্কে একটি কথাও কেউ উচ্চারণ করল না। ছবি: সংগৃহীত
এই মানুষেরা খাবার পাওয়ার অনিশ্চয়তায় এমনই কাতর যে, করোনাভাইরাস মহামারি সম্পর্কে একটি কথাও কেউ উচ্চারণ করল না। ছবি: সংগৃহীত

রোববার সন্ধ্যার পরে ঢাকার বাংলামোটর থেকে মগবাজারের দিকে হেঁটে যাচ্ছিলাম। গন্তব্য দিলু রোডের কাছে এক ওষুধের দোকান। সড়ক প্রায় জনশূন্য, যানবাহন বলতে মাঝে মাঝে দুই একটা প্রাইভেট কার, একটা-দুটো রিকশা। নির্মল বাতাস, মাথার ওপরে আকাশ ভীষণ স্বচ্ছ। চারদিকে সুনসান নীরবতা। সড়কের বাম ধার দিয়ে হেঁটে চলেছি, ডান পাশ দিয়ে একটা খালি রিকশা যাওয়ার সময় চালকের জিজ্ঞাসা, ‘মামা, কই যাবেন?’

‘এই তো, কাছেই। আপনি বাড়ি যাননি?’
রিকশাচালক থামলেন, ‘য্যাতে পারিনি, মামা।’
‘কেন?’
‘এক হাজার ট্যাকা ভাড়া চায়।’
‘কীসের ভাড়া এক হাজার টাকা?’
‘বাসের ভাড়া, মামা। যেদিন সবাই চলে গেল। আমার কাছে তো অত ট্যাকা নাই। মাত্রই কয়দিন হলো আসিছি। এর মধ্যে করোনার জ্বালায় কামাই বন্ধ হয়া গেল।’
‘মাস্ক পরেননি কেন?’
‘ভুলে বাসাত ছ্যাড়ে আসিছি, মামা।’
‘পুলিশ দেখলে কিন্তু মারবে।’
অপ্রস্তুত হাসি। হ্যাংলা-পাতলা তরুণটির নাম আমিনুল ইসলাম। বয়স ‘পঁচিশ-ছাব্বিশ হবার পারে।’ কথায় আঞ্চলিক টান ও কিছু শব্দের উচ্চারণেই বুঝলাম, বাড়ি উত্তরবঙ্গ। জিজ্ঞাসা করে জানা গেল জয়পুরহাট জেলার কালাই উপজেলার হাটশহর নামের এক গ্রামের মানুষ। বাড়িতে মা-বাবা আছে; বউ আছে, পাঁচ বছর বয়সী একটা ছেলে আছে। ঢাকায় রিকশা চালান, মগবাজারের মধুবাগে থাকেন। রিকশার মালিককে প্রতিদিন ১৪০ টাকা ‘জমা’ দিতে হয়। প্রতিদিন রিকশা চালান; এক মাসে আয় হয় ১৫-১৬ হাজার টাকা। এক মাস পর পর বাড়ি যান; কয়েকদিন ‘ছুটি’ কাটিয়ে আবার ফিরে আসেন।
‘রিকশা চালাচ্ছেন, পুলিশ বাধা দেয়নি?’
‘প্রথম দিন দিছিল, মামা। কয়, করোনা হোবে, বাসাত যাও। বাসাত্থে বলে বার হওয়া হোবে না। তা গরিব মানুষ, বাসার মধ্যে বসে থাকলে কাম হোবে মামা? আয় না করলে খামো কী?’
‘আয় হচ্ছে?’
‘না মামা, এক্কিরে আয় নাই। আজ তিনটা দিন, মামা। পেসেনজারই নাই। দুই-একজন যদি পাই, কয় দশ ট্যাকা ভাড়া দিবে। গেল চলো, না গেলে নাই।’
‘আজ দুপুরে কী খেয়েছেন?’
‘একজন ভাত খিলাছে, মামা।’
‘কে সেই একজন?’
‘মধুবাগেই থাকে। চাকরি করে।’
‘আগামীকালও খাওয়াবে?’
‘ডেলি কি খিলায়, মামা?’
‘তাহলে, কাল আপনি কী খাবেন?’
‘ভাত যদি না পাই, মামা, কী করমু? পানি খায়া থাকমু।
দুই তরুণ কখন এসে দাঁড়িয়েছে একটু দাঁড়িয়েছে, খেয়াল করিনি। একজন বলল, ‘স্যার, আমরাও গরিব মানুষ। কিছু পাই নাই।’
‘কাছে আসেন। কী পাওয়ার কথা বলছেন?’
‘চাল, ডাইল, তেল, আলু দিতাছে। আমরা পাই নাই।’
‘কী করেন আপনারা?’
‘বাংলামোটরে গাড়ির কাম করি।’
মানে, বাংলামোটরে সড়কের দুই পাশে মোটরগাড়ি মেরামত করার যে সব ‘গ্যারেজ’ আছে, সেগুলোর কোনো একটার কর্মী তাঁরা। দিনে আয় করতেন পাঁচ-ছয় শ টাকা। কয়েক দিন ধরে সব বন্ধ। একটা পয়সাও রোজগার নেই। তারা আমার কাছে জানতে চায়, আর কত দিন সবকিছু এ রকম বন্ধ থাকবে। আমি তাদের বলি, সরকার ৪ এপ্রিল পর্যন্ত সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে। তার মনে ৫ এপ্রিল থেকে সবকিছু আবার খোলার কথা।
‘আরও এক সপ্তাহ!’ তরুণদের একজন বলে, ‘স্যার, আমরা তাইলে বাঁচুম কেমনে?’
‘আপনাদের বাড়ি কোথায়?’ দুই তরুণকে জিজ্ঞাসা করি। তাঁরা বলেন, দুজনেরই জন্ম ঢাকার মিরপুরে।
‘বাড়িতে কে কে আছে?’
‘মা-বাবা সবাই আছে।’
‘বিয়ে করেছেন?’
‘নিজেই চলবার পারি না, বিয়া করুম কেমনে?’
একজন, দুজন করে লোক আসতে থাকে। আমাদের ঘিরে দাঁড়ায়। আমার হাতে নোট বই ও কলম দেখে তারা ভাবে আমি নাম লেখে নিচ্ছি।
‘আমি কিছু পাই নাই’। ‘আমিও কিছু পাই নাই।’ একজনের পর একজন এই একই বাক্য বলতে থাকে। পাঁচ-সাত মিনিটের মধ্যে আটজন রিকশাচালক তাদের খালি রিকশাসুদ্ধ দাঁড়িয়ে যায় সড়কের ধার ঘেঁষে। কেউ স্যার, কেউ মামা বলে সম্বোধন করে করুণ মিনতির সঙ্গে বলে তাঁর নামটা লিখে নিতে। তাদের ধারণা, নাম লেখা হলেই তারা সাহায্য পাবে। চাল-ডাল-তেল-আলু কিংবা নগদ টাকা।
আমি বলি যে আমি কোনো সাহায্য সংস্থার লোক নই, সরকারেরও কেউ নই; আমি একজন সাংবাদিক। তারা জানতে চায় ‘কোন চ্যানেলের’ সাংবাদিক। তাদের বলি যে আমি খবরের কাগজের সাংবাদিক। তারা বলে, তাদের নামগুলো যেন আমাদের কাগজে ছাপিয়ে দিই। সরকার যেন জানতে পারে যে তারা অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছে। তাদের খুবই জরুরি সাহায্য দরকার। আর, সরকার যেন রিকশার মালিকদের বলে দেয়, তারা যেন রিকশার জমার টাকাটা কম করে নেয়। কারণ, ‘ঢাকা শহরে এখন রিকশার পেসেনজার নাই’; খালি পেটে, খালি রাস্তায়, খালি রিকশা নিয়ে তারা ঘুরে বেড়াচ্ছে।
আর, সরকার যেন বাড়িওয়ালাদের বলে দেয় শুধু একটা মাসের বাড়ি ভাড়া যেন মাফ করে দেওয়া হয়। তারা আরও বলে, চাল-ডাল-তেল-আলু সবাইকে দিতে হবে। কেউ পাবে কেউ পাবে না তা হবে না।
এই মানুষেরা খাবার পাওয়ার অনিশ্চয়তায় এমনই কাতর যে, করোনাভাইরাস মহামারি সম্পর্কে একটা কথাও কেউ উচ্চারণ করল না। কেউ কেউ মুখে মাস্ক পরেছে। কেন পরেছে সেই খোঁজ নিতে গিয়ে জানা গেল মাস্ক না পড়লে পুলিশ পেটাতে পারে এই ভয় থেকে তারা মাস্ক সংগ্রহ করেছে।
‘করোনাভাইরাস কিন্তু সিরিয়াস রোগ,’ আমি তাদের বলি, ‘আপনারা সবাই মাস্ক পরবেন, সাবধানে থাকবেন।’
তাদের একজন বলে, ‘আমরা মামা করোনায় মরুম না। মরুম খিদায়। আমগো পুলাপানেও খিদায় মরতাছে। ঢাকা শহরের সব লোক দ্যাশে গেছে গিয়া। দ্যাশ-গেরামে সব জিনিসের দাম গেছে বাইড়া। এইখানে আমগো কামাই নাই; দ্যাশে ট্যাকা পাঠাইতে পারতাছি না; পুলাপানে না খায়া মরতাছে।’
এক দিকে করোনা, অন্য দিকে ক্ষুধা। এই দুর্দশা কত লম্বা হবে!