মাইরেন না, তাই বলে ছাইড়েনও না!

করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি উপেক্ষা করে বাইরে বের হয়েছেন লোকজন। তাঁদের ঠেকাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে পুলিশের সদস্যদের। কবি নজরুল ইসলাম সড়ক, বগুড়া শহরের, ১ এপ্রিল। ছবি: ছবি: সোয়েল রানা
করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি উপেক্ষা করে বাইরে বের হয়েছেন লোকজন। তাঁদের ঠেকাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে পুলিশের সদস্যদের। কবি নজরুল ইসলাম সড়ক, বগুড়া শহরের, ১ এপ্রিল। ছবি: ছবি: সোয়েল রানা

আমরা, মানে বাংলাদেশিরা অতিশয় সামাজিক প্রাণী। কামকাজ না থাকলে (এমনকি কাজ বাদ দিয়ে) এক জায়গায় বসে দুনিয়ার গাপচা-গাপচি, গিবত-শেকায়েত, পরনিন্দা-পরচর্চা করার ব্যাপারে আমরা মারাত্মক ওস্তাদ। এই কথা মরক্কোর ইবনে বতুতা পর্যন্ত স্বীকার করে গেছেন। রাজ–আজ্ঞাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে খেয়ালখুশি মতো চলা আর কোনো রকম একটু সুযোগ পেলেই বিদ্রোহ করার সুখ্যাতির কারণে এই তল্লাটকে গিয়াসউদ্দিন মুহম্মদ তুঘলকের মতো বাঘ-ছাগলকে এক ঘাটে জল খাওয়ানো সুলতানও ‘বুলঘকপুর’ (অরাজকতার দেশ) নাম দিয়েছিলেন। সেই ঐতিহ্যকে যে আমরা এখনো ধরে পিছমোড়া করে বেঁধে রেখেছি, তা এই করোনাকালে আবার দেখিয়ে দিয়েছি।

দুনিয়ার অন্য সবাই মহামারির ভয়ে থরথর করে কাঁপছে। একান্ত না পারলে ঘরের বাইরে পা দিতে সাহস করছে না। কমবেশি সবখানেই সামাজিক দূরত্ব মেনে চলছে। সেখানে চিরকালীন অভ্যাসমতো পাড়া–মহল্লার গলির চিপায়–চুপায় ‘মজমা’ না বসালে আমাদের ভালো লাগছে না।

দুনিয়ার সব বিজ্ঞানী, চিকিৎসকের বরাত দিয়ে প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, করোনাভাইরাস ১ জনের গা থেকে ১০০ জনের গায়ে ছড়ায়। জানে বাঁচতে চাইলে কিছুদিনের জন্য হাত মেলামেলি, ঘষাঘষি, ডলাডলি—মানে এ–জাতীয় সামাজিক কপচা-কপচি থেকে দূরে থাকুন। এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় কাজ হলো ঘরে বসে থাকা। প্রশাসন বলেছিল, নিজে বাঁচতে চাইলে কিংবা আরেকজনকে মারতে না চাইলে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখুন। একেবারে না হলেই নয়, এমন প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে যাবেন না। এ কারণে সরকার ছুটিও দিল। সরকারের এই ঘোষণার মর্মার্থ ধরতে পেরে ঢাকা শহর থেকে অন্তত ১ কোটি ১০ লাখ লোক (আরও বেশি হতে পারে। এই সংখ্যা শুধু মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর ভিত্তিতে ধরা হয়েছে) সেলফ কোয়ারেন্টিনে যাওয়ার উদগ্র বাসনায় বাসে ট্রেনে গাদাগাদি, ডলাডলি, ঢলাঢলি করে ‘ঘন সন্নিবিষ্ট তাম্রলিপির মতো’ দেশের বাড়ি চলে গেছে। যাওয়ার সময় কে কার গায়ে ডলা দিয়ে মৃত্যু-ফরমান লিখে দিয়েছেন, তা আল্লাহ পাকই জানেন।

যাহোক, দেশের বাড়ি এসেও ঘরে থাকতে তাঁদের ভালো লাগেনি। দেশের বাড়ির চাচা-চাচি, খালা-খালুসহ সব ইয়ার দোস্তরা কে কোথায় কেমন আছে, তার খোঁজখবর নেওয়া, করোনাভাইরাসের সর্বশেষ বিশ্ব পরিস্থিতি নিয়ে বিশ্লেষণধর্মী আলোচনা করা এবং সর্বোপরি করোনাপরিস্থিতি ঠেকানোর জন্য কীভাবে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে, সে বিষয়ে বিশেষ ঘরোয়া সম্মেলন করা তাঁরা শুরু করে দিলেন।

রাস্তাঘাটে উৎসবমুখর ভঙ্গিতে লোকজনকে বের হতে দেখে পুলিশের পক্ষ থেকে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া শুরু হলো। এর মধ্যে বেশ কিছু জায়গায় পুলিশের আচরণকে অনেকের কাছে বাড়াবাড়ি মনে হয়েছে। তবে অনেকে দ্বিমত পোষণ করে বলেছেন, পরিস্থিতি যে বিপর্যয়কর অবস্থার দিকে যেতে পারে, তা ঠেকানোর স্বার্থে পুলিশের এই লাঠিপেটা ও দৃশ্যত অস্বাভাবিক আচরণকে ডকট্রিন অব নেসেসিটির আলোকে কৌশলগত ও যৌক্তিক বিবেচনা করা উচিত। যে শিশুটি বুঝতে পারছে না, আর কয়েক কদম সামনে গেলেই তাঁকে খাদে পড়ে মরতে হবে, তাকে পরম আদরে গাল টিপে ‘সোনামণি সামনে যেতে নেই’ বললে কাজ হবে না। তাকে চোখরাঙানি না দিলে সে সামনে যাবে এবং মারা পড়বে।

সংবাদমাধ্যমে খবর বের হলো, পুলিশ প্রশাসনের লোক কাউকে বাড়ির বাইরে বের হতে দেখলেই কোনো রকম কথাবার্তা ছাড়াই পেটানো শুরু করেছেন। লোকজন জরুরি কাজেও বাড়ির বাইরে যেতে পারছে না। ২৭ মার্চ অগ্রজ সাংবাদিক, কবি ও কথাশিল্পী আনিসুল হক ‘ভাই পুলিশ, মাইর দিয়েন না’ শিরোনামে একটি কলাম লিখলেন। সেখানে পুলিশকে অতি আক্রমণাত্মক ভঙ্গি থেকে সংযত হয়ে রাস্তাঘাটে বের হওয়া লোকের কাছে আগে তাঁর বাইরে আসার কারণ জিজ্ঞাসা করার পরামর্শ দিয়েছিলেন তিনি। পেটের দায়ে বাজারে শাক বিক্রি করতে আসা শ্মশ্রুমণ্ডিত কয়েকজন বৃদ্ধকে মাস্ক না পরার জন্য একজন এসিল্যান্ড কান ধরে দাঁড় করানোর ঘটনাও তখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তীব্র সমালোচনার সৃষ্টি করে। হয়তো আনিস ভাইয়ের লেখা বা এ ধরনের মতামত এবং এসিল্যান্ডের কাণ্ডের সূত্র ধরে পুলিশ একটু শিথিলতা দেখিয়েছিল। ব্যস, আর যায় কোথায়! একটু ঢিলেমি দেখেই সারা দেশের ‘হাটে-বাটে-মাঠে’ ও পুরান ঢাকার অলিতে–গলিতে জটলা বেঁধে ভাই–বেরাদাররা করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে সামাজিক দূরত্বের গুরুত্বকে প্রতিপাদ্য ধরে মজমা পাতিয়ে ফেলা শুরু করলেন। আনিস ভাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রথম থেকেই কিছুক্ষণ পরপর সবাইকে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার ওপর জোর দিয়ে স্ট্যাটাস দেন। পুলিশের শিথিলতায় পাবলিকের আড্ডাপ্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় তিনি স্পষ্টতই কষ্ট পেয়েছেন। লজ্জা পেয়েছেন। নিজের ‘মাইরেন না’ কথাটিকে অনুপ্রাসে ফেলে তিনি ফেসবুকে খানিকটা বিরক্তির সঙ্গে ও বিব্রত ভঙ্গিতে পরে তিনি পুলিশকে উদ্দেশ করে লিখেছেন, ‘ছাইড়েন না!’

শিথিলতার সুযোগে সামাজিক ওঠাবসা বেড়ে যাওয়ার কারণে পুলিশ আজ আবার কড়া অবস্থায় চলে গেছে বলে মনে হলো। রিকশায় করে অফিসে আসার সময় আমাকে তিন জায়গায় দাঁড় করিয়েছে। বলেছি, আমাকে খবরের কাজে যেতে হবে। তাঁরা ঝামেলা করেননি। ছেড়ে দিয়েছেন। বিভিন্ন ব্যাংকের কর্মচারীদেরও দেখেছি ছেড়ে দিচ্ছেন। কিন্তু সদুত্তর দিতে না পারলে ফিরিয়ে দিচ্ছেন। সামনে এগোতে দিচ্ছেন না। তবে কাউকে পেটাতে দেখিনি।

সম্প্রতি একটি খবর দেখে হাঁ হয়ে গেছি। করোনাভাইরাস মোকাবিলায় ‘স্টে হোম’ কর্মসূচি ঘোষণা করে চট্টগ্রাম পুলিশ নগরের ১৬ থানায় হোম সার্ভিস চালু করেছে। সেখানে প্রতিটি থানার ওসির নম্বরসহ তিনটি মোবাইল নম্বর দেওয়া হয়েছে হট নম্বর হিসেবে। ওই নম্বরে ফোন দিয়ে নগরের যেকোনো বাসিন্দা অতি জরুরি পণ্য চাইতে পারেন। পুলিশ সেই পণ্য তাঁদের বাড়িতে পৌঁছে দেবে। এখন দেখা যাচ্ছে, লোকজন ফোন করে মাছ, মাংস, স্নো-পাউডার চাইছেন। ডবলমুরিং থানার ওসি সদীপ কুমার দাশ বলেছেন, এক লোক তাঁকে ফোন করে বলেছেন, তিনি তরকারি রান্না করবেন, এক প্যাকেট পাঁচফোড়ন তাঁর বাসায় পৌঁছে দিয়ে এলে তরকারিটা নাকি বেশ জমত। বোঝেন ‘কিয়েক্টাবস্থা’!

এ কথা বুঝতেই হবে, সরাসরি ঘোষণা দেওয়া না হলেও দেশ কার্যত ‘শাটডাউন’ অবস্থায় আছে। যাঁরা ব্যবসাপাতি করে সংসার চালান, তাঁদের আয় রোজগার বন্ধ। তাঁরা অপেক্ষাকৃত বেশি কষ্টে পড়েছেন। আর যাঁরা একেবারে ‘দিন আনি দিন খাই’ শ্রেণির মানুষ, তাঁদের মধ্যে কত লোক যে জঠরজ্বালায় কাতরাচ্ছেন, তার ঠিক নেই। এরপরও বুঝতে হবে, আগে বাঁচতে হবে। না খেয়ে দিনমজুর মানুষ কষ্ট পাচ্ছে। তাদের কষ্ট লাঘবের সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে। কিন্তু সেই জঠরজ্বালার বিষয়টিকে অজুহাত হিসেবে সামনে এনে গড়ে হরিবোলে রাস্তায় বের হয়ে গোটা জাতিকে মরার ঝুঁকিতে ফেলতে দেওয়া যাবে না। এই ক্ষেত্রে পুলিশের কাছ থেকে ‘সোনামণি, বাইরে যায় না!’ টাইপের আদুরে আলাপ শোনার আশা অন্তত কিছুদিনের জন্য বন্ধ রাখা দরকার।

পাবলিককে বলব, ‘না খেয়ে মানুষ মরে না। ভাইরে–বাপুরে, অল্প কয়টা দিন দাঁত কিড়িমিড়ি দিয়ে ঘরে পড়ে থাকেন।’

পুলিশকে বলব, ‘মাইরেন না, তাই বলে ছাইড়েনও না!’

সারফুদ্দিন আহমেদ: লেখক ও সাংবাদিক
[email protected]