সংবাদ, ভুয়া সংবাদ এবং গুজব

ছবি: রয়টার্স
ছবি: রয়টার্স

খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে গ্রিক নাট্যকার ইসকাইলাস বলেছিলেন, যেকোনো যুদ্ধে সত্য হচ্ছে প্রথম বলি। এ কথা শুধু যুদ্ধের সময় নয়, সব সংকটকালেও প্রযোজ্য। যুদ্ধের সময় সত্যকে চাপিয়ে রাখা হয় কৌশলগত কারণে, জনতাকে ভাঁওতা দেওয়ার জন্য আর শত্রুকে বিভ্রান্ত করার জন্য। কিন্তু অন্যান্য সংকটের সময় সত্য গোপন রাখার পেছনে থাকে হয় রাজনৈতিক কারণ, না হয় অজ্ঞানতা। সত্য গোপন বা চাপিয়ে রাখার প্রবণতা সাধারণত এসব দেশেই বেশি দেখা যায়, যেখানে সরকার স্বৈরতান্ত্রিক বা ব্যক্তিকেন্দ্রিক, যেখানে কোনো সংকটকালে জনসাধারণকে সংকট সম্পর্কে যত কম জানানো যায় তত ভালো। সত্যকে চাপিয়ে রাখা যায় না সেসব দেশে, যেখানে গণতন্ত্র অবাধ, বাক্‌–স্বাধীনতায় বাধা নেই, সংবাদমাধ্যমগুলোর ওপর প্রতিবন্ধকতা নেই। তবে এ কথাটি বলে রাখা ভালো, এরপরও যে আমরা সব সময় সত্য সংবাদ পাচ্ছি, তা ঠিক নাও হতে পারে। এ সত্যতা নির্ভর করে কোথা থেকে সংবাদ পাচ্ছি আর কে এ সংবাদ দিচ্ছে।

এ কথাগুলো আজকের এই পৃথিবীময় ছড়িয়ে যাওয়া মহাসংকট করোনাভাইরাসের পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষভাবে প্রযোজ্য। এ সংকট প্রায় চার মাস আগে শুরু হয়েছিল চীনের উহান থেকে। চীন আজকের দিনে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনীতি, যার সারা গোলার্ধে বাণিজ্যিক আধিপত্য। এই মহাসংকটের আগে অনুমান করা হয়েছিল যে অতি শিগগির চীন যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যাবে দেশজ উৎপাদনে। কিন্তু যা পরিবর্তন হবে না, তা এই সুবৃহৎ দেশের রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে বা তার সংবাদমাধ্যমে যা দৃঢ় হাতে পরিচালনা করে দেশের একমাত্র এবং মহাশক্তিশালী কমিউনিস্ট পার্টি। যার ফল হলো চীনের উহান থেকে উদ্ভূত এই কালব্যাধি সম্পর্কে সারা পৃথিবীর জানতে অনেক সময় লাগল।

চীন থেকে এ রোগের খবর যখন ধীরগতিতে আসতে থাকল, তখন খবরের চেয়ে বেশি আসতে থাকল গুজব আর ভুয়া সংবাদ। এর প্রধান কারণ চীন নিজে। দেশটি প্রথম থেকেই ছিল রোগটিকে অস্বীকার মনস্তত্ত্বে ভুগছিল, কারণ এর আগে ২০০৩ সালে আর এক মারাত্মক ভাইরাসের উৎপত্তি (সার্স) চীন থেকেই হয়েছিল। আসলে যে ডাক্তার উহানে এ রোগ নিয়ে সতর্কতা অবলম্বনের আহ্বান জানিয়েছিলেন, তাঁকে চীন সরকার জেলে ঢোকায়। (ডাক্তার নিজে পরে এ রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান)। কিন্তু যত দিন না চীন সরকার এ নতুন রোগ রোধ করতে ব্যাপক ব্যবস্থা নেয়, তত দিন আমাদের সংবাদ আসে বিভিন্ন মাধ্যমে, সংবাদপত্র, টেলিভিশন, আর বর্তমান যুগের সংবাদ, ভুয়া সংবাদ আর গুজবের চারণ ভূমি, ইউটিউব, ফেসবুক, টুইটার ইত্যাদি।

কথায় আছে, সত্য যখন দুর্লভ, তখন অসত্য আর গুজব তার স্থান নেয়। নানা মুনি নানা তথ্য দিতে থাকলেন এ নতুন মহামারি সম্পর্কে, কীভাবে এটা শুরু হলো, কীভাবে ছড়াতে পারে, কী খেলে আর না খেলে এ রোগ প্রতিরোধ করা যায়। আমরা জানলাম যে চীনের উহান শহরে বিভিন্ন ধরনের জন্তু–জানোয়ার খাওয়া হয় বলে সে শহরের বাজার থেকে এ ভাইরাস এসেছে মানুষের শরীরে, তা থেকে তা ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। কিন্তু চীন তার কাজ ঠিকই করল, সংবাদ নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে এ ভাইরাস নিয়ন্ত্রণের জন্য দেশের রাষ্ট্রযন্ত্র আর পার্টিকে নিয়োজিত করল বিশাল দেশটিকে এক সুবৃহৎ কারাগার বানিয়ে। এক শহর থেকে আরেক শহর লোকজনের আনাগোনা বন্ধ তো করলই, সপ্তাহের পর সপ্তাহ প্রতিটি শহরের বাসিন্দাদের ঘরবন্দী করে রাখল। তাদের দৈনন্দিন দরকারি জিনিসপত্রের পার্টির লোক দিয়ে বাড়ি বাড়ি পৌঁছানোর বন্দোবস্ত করে দিল।

কিন্তু চীন যা করল, তা বিশ্বের আর দেশ যারা এ মারাত্মক ভাইরাসের কবলে, এখন তারা কী করবে? তাদের কাছে না আছে চীনের মতো শক্ত রাষ্ট্রযন্ত্র, না আছে চীনের মতো নিয়মানুবর্তী মানা জনবল। উন্নত দেশগুলোর কাছে আছে হয়তো বেশি সহায় সম্পদ, যা দিয়ে তারা তাদের জনসাধারণকে সাহায্য করতে পারবে, কিন্তু নিম্ন সম্বল জনবহুল দেশগুলো কী করবে?

প্রতিটি সংকটে প্রথম এবং প্রধান যারা ভুক্তভোগী, তারা হচ্ছে দেশের সাধারণ লোক। দৈব বিড়ম্বনা এই যে এ জনসাধারণই প্রতিটি সংকট মোকাবিলায় এগিয়ে আসে। তা সে দেশ উন্নত কি অনুন্নত, সম্বল সমৃদ্ধ কি অসমৃদ্ধ হোক না কেন। কিন্তু এই জনসাধারণকে সংকট সমাধানে সম্পৃক্ত করার জন্য সাহস দিতে দরকার দেশের নেতৃত্বের সততা, ন্যায়পরায়ণতা, আর সংকট মোচনে সত্যের আশ্রয় নেওয়া। জনগণকে ভুল তথ্য না দেওয়া যেমন রাষ্ট্রের দায়িত্ব, তেমনি দায়িত্ব সংবাদমাধ্যমের। সরকারের কাজে এবং কথায় যদি স্বচ্ছতা না থাকে, যদি বাস্তব দৃষ্টিতে যা জনসাধারণ দেখে তার সঙ্গে সরকারি কথায় অমিল থাকে, তাতে সরকারের প্রতি অবিশ্বাস জন্মে আর জনসাধারণ তখন গুজব আর ভুয়া সংবাদের দিকে ঝুঁকে পড়ে।

আজকের এই বিশ্বময় মহাসংকটে মানুষের যেমন এই মহামারি থেকে প্রতিষেধক প্রয়োজন, তার চেয়ে অধিক প্রয়োজন মানুষকে আতঙ্ক থেকে পরিত্রাণ দেওয়া। আর এই আতঙ্ক সৃষ্টি করে ভুয়া সংবাদ আর গুজব। এ দুটি থেকে পরিত্রাণের উপায় সরকারকে তুমুলভাবে এবং দৃশ্যত এ রোগ থেকে মানুষকে চিকিৎসা এবং রোগ নির্ণয়ের ব্যবস্থা করা আর নিয়মিতভাবে বিভিন্ন মাধ্যমে সত্য তথ্য দেওয়া। এর সঙ্গে সঙ্গে আমাদের নিয়মিত সংবাদমাধ্যমগুলো তাদের সংবাদ পরিবেশনে আরও দায়িত্বশীল হয়ে যদি সংবাদ যাচাই করে, তবে হয়তো অন্যান্য সামাজিক মাধ্যম পরিবেশিত ভুয়া সংবাদের ওপর মানুষের নির্ভরতা কমবে।

ইংরেজিতে একটি কথা, দিজ টু শ্যাল পাস। এ দুঃসময় চিরকাল থাকবে না, কোনো দিন থাকেনি। যা থাকবে, তা প্রতিটি দেশের সংকটকালীন সাহস, একাগ্রতা আর নেতৃত্বের সততার কথা। আমরা নিশ্চয়ই এ দিন অতিক্রম করব।

জিয়াউদ্দিন চৌধুরী: বিশ্বব্যাংক ও বাংলাদেশ সরকারের সাবেক কর্মকর্তা