করোনা সংকটে সেবাদানকারীদের সুরক্ষা

মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে যোগ দিয়ে একজন সিভিল সার্জন বলেছেন, পিপিইসহ (পারসোনাল প্রোটেকশন ইকুইপমেন্ট) করোনাভাইরাস চিকিৎসার সব সরঞ্জাম তাঁদের কাছে আছে। কিন্তু প্রয়োজন না থাকলেও সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ এসে পিপিই চাওয়ায় তাঁরা মুশকিলে পড়েছেন।

সিভিল সার্জন সরকারপ্রধানকে খুশি করতে গিয়ে একটি ভুল তথ্য দিয়েছেন। মাঠপর্যায়ে করোনাভাইরাসের তথ্য সংগ্রহ করতে যেসব সাংবাদিককে হাসপাতাল, আইসোলেশন কেন্দ্র প্রভৃতি স্থানে যেতে হয়, তাঁদের অবশ্যই পিপিই জরুরি।

সিভিল সার্জন মহোদয় বলতে পারতেন, সাংবাদিকদের দেওয়ার মতো পিপিই বা সুরক্ষাসামগ্রী তাঁর কাছে নেই। কিংবা তিনি এ কথাও জানিয়ে দিতে পারতেন, সাংবাদিকদের সুরক্ষাসামগ্রী দেওয়ার দায়িত্ব সিভিল সার্জন অফিসের নয়। এসব তাঁদের নিজেদের সংগ্রহ করতে হবে।

আমরাও মনে করি, যে প্রতিষ্ঠানের পক্ষে মাঠপর্যায়ে সাংবাদিকেরা কাজ করেন, সেই প্রতিষ্ঠানেরই উচিত তাঁদের প্রয়োজনীয় সামগ্রী সরবরাহ করা। সিভিল সার্জন বলেছেন, সাংবাদিকদের সুরক্ষাসামগ্রীর দরকার নেই। কিন্তু আমরা এ ব্যাপারে সাংবাদিকদের আন্তর্জাতিক সংগঠন আইজেওর নির্দেশনা জেনে নিতে পারি। আইজেও বলেছে, সাংবাদিকেদের যেকোনো পিপিই বা ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রীর (যেমন ডিসপোজিবল গ্লাভস, মাস্ক, সুরক্ষিত অ্যাপ্রোন ও ডিসপোজিবল জুতার আবরণ) বিষয়ে কড়াকড়ি মেনে চলতে হবে এবং সংক্রমণের উচ্চমাত্রার ঝুঁকি থাকায় এ ব্যাপারে কোনো শিথিলতা দেখানো যাবে না।

তাদের মতে, যদি সাংবাদিকেরা স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র বা মর্গের মতো স্থানে দায়িত্ব পালন করেন, তাহলে তাঁদের ডিসপোজিবল জুতা বা পানিনিরোধক বুট পরতে হবে এবং নির্দিষ্ট স্থান থেকে বেরিয়ে আসার পরপরই তা ফেলে দিতে হবে। এসব দ্বিতীয়বার পরা যাবে না। এসব স্থানে গেলে অবশ্যই সুরক্ষিত গ্লাভস, অন্যান্য মেডিকেল সুরক্ষাসামগ্রী যেমন বডি স্যুট, পুরো মুখ ঢাকে এমন মাস্ক পরাও জরুরি।

আমরা এও জানি, ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রী না থাকার কারণেই একাধিক চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীকে আইসোলেশনে যেতে হয়েছে। কারও কারও শরীরে সংক্রমণ দেখা দেওয়ায় চিকিৎসাও নিতে হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি সচিত্র স্ট্যাটাস দেখলাম, হাসপাতাল থেকে ফিরে একজন চিকিৎসক বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে তাঁর সন্তানের সঙ্গে কথা বলছেন। ভেতরে ঢুকছেন না সন্তানের নিরাপত্তার কথা ভেবে। একইভাবে ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন নার্স, টেকনিশিয়ানসহ অন্য স্বাস্থ্যকর্মীরাও।

এই পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার কারণ, সময় থাকতে স্বাস্থ্য বিভাগের ঘুম না ভাঙা। তিন মাস আগে চীনে করোনাভাইরাস সংক্রমণের পরই অনেক বিশেষজ্ঞ দ্রুত প্রস্তুতি নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। ৮ মার্চ প্রথম বাংলাদেশে করোনার সংক্রমণ ধরা পড়ে। এরপরও তিন সপ্তাহ পার হয়ে গেছে। ১৭ কোটি মানুষের দেশে একটি মাত্র স্থানে করোনা পরীক্ষার ব্যবস্থা ছিল—আইইডিসিআরে। আইসিডিডিআরবির পরীক্ষার সামর্থ্য থাকার পরও সরকার প্রথমে তাদের অনুমতি দেয়নি। পরে দিয়েছে।

তড়িঘড়ি করে বিভিন্ন মেডিকেল কলেজে করোনাভাইরাস পরীক্ষা ও চিকিৎসার জন্য প্রস্তুত করতে গিয়ে অনেক অসংগতি ও ত্রুটি ধরা পড়ছে। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক বলেছেন, তাঁদের যেসব সুরক্ষাসামগ্রী দেওয়া হয়েছে, তা করোনাভাইরাস পরীক্ষার জন্য উপযুক্ত নয়। সাধারণ সুরক্ষা সামগ্রী দিয়ে অতি সংক্রমণপ্রবণ ভাইরাস পরীক্ষা বা রোগীর চিকিৎসা সম্ভব নয়।

বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসকেরা জ্বর, সর্দি-কাশির রোগী দেখলেই পিছিয়ে যাচ্ছেন, তার কারণও সুরক্ষা সামগ্রীর অভাব। তাঁরা তো জানেন না কে করোনায় আক্রান্ত, কে বাইরে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন, তাঁদের যথেষ্ট ভেন্টিলেটর আছে। কিন্তু সাধারণ ভেন্টিলেটর যে এই চিকিৎসায় কাজ দেবে না, সে কথা মন্ত্রী মহোদয়কে কে বোঝাবেন?

তবে সমস্যাটি শুধু বাংলাদেশে নয়, অন্যান্য দেশেও স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রীর ঘাটতি আছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরুরি কর্মসূচির নির্বাহী পরিচালক বলেছেন, ‘এই মুহূর্তে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে আছেন স্বাস্থ্যকর্মীরা। কারণ তাঁরা প্রতিদিন, প্রতি সেকেন্ডে এই ভাইরাসের সংস্পর্শে আসছেন। অথচ ভয়াবহ ব্যাপার হলো, তাঁদের জন্যই পর্যাপ্ত মাস্ক নেই।’

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে গত ২৬ মার্চ থেকে সারা দেশে কার্যত লকডাউন চলছে। প্রথমে বলা হয়েছিল ৪ এপ্রিল পর্যন্ত এটি চলবে। পরে মেয়াদ বাড়িয়ে ৯ এপ্রিল করা হয়েছে। কিন্তু মানুষের জীবন তো থেমে থাকবে না। দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে কিছু জরুরি সেবা চালু রাখতে হয়েছে। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মী ও সাংবাদিকদের সমস্যার কথা এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করলাম। এর অর্থ নয় যে এর বাইরে যাঁরা জরুরি সেবার সঙ্গে জড়িত আছেন, তাঁদের সুরক্ষা উপেক্ষিত থাকবে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যরা নিয়োজিত আছেন। আছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। আইসোলেশন কেন্দ্রে কিংবা হাসপাতালে কোনো অঘটন ঘটলে সেটি সামাল দিতে তাঁদের সেখানে ছুটে যেতে হবে। সে ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সুরক্ষাসামগ্রী দেওয়া জরুরি। বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস সরবরাহের কাজে যাঁরা যুক্ত, তাঁদেরও প্রয়োজনে হাসপাতালে, আইসোলেশন কেন্দ্রে যেতে হতে পারে।

অতএব, সংশ্লিষ্ট সবার সুরক্ষার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে। সবকিছু ঠিক আছে বলে উটপাখির মতো বালুতে মুখ লুকালে ঝড় থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে না।