করোনা সংকটের গতিপ্রকৃতি ও আমাদের প্রস্তুতি

চলমান করোনা সংকটের গতিধারা নিয়ে দুটো অনুমান আছে আমার কাছে। প্রথমটি আমার স্ত্রীর দেওয়া। তিনি বলছেন, বাংলাদেশে করোনাভাইরাস খুব একটা সুবিধা করতে পারবে না, কারণ বাঙালি প্রতিনিয়ত রোগজীবাণুর সঙ্গে লড়াই করে টিকে আছে। প্রাকৃতিকভাবেই তাই আমাদের মধ্যে প্রতিরোধের ক্ষমতা বেশি। আমাদের মতো বয়স্ক কিছু লোক মারা যাবে হয়তো, তবে তা মহামারি রূপ নেবে না, এ ব্যাপারে তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাসী।

দ্বিতীয় অনুমানটা সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী লি শিয়েন লুংয়ের। গত সোমবার সিএনএনের ফরিদ জাকারিয়ার জিপিএস অনুষ্ঠানের অতিথি ছিলেন তিনি। করোনা নিয়ন্ত্রণে উল্লেখযোগ্য সাফল্য দেখিয়েছে সিঙ্গাপুর। কিন্তু এটাকে ‘সাফল্য’ বলতে নারাজ লি। তাঁর মতে, সিঙ্গাপুর এখনো করোনা সমস্যার একটি স্তর পার করছে এবং সত্যিকারের ‘সাফল্য’, অর্থাৎ সম্পূর্ণ মুক্তি আসতে আরও কয়েক মাস লাগবে। তাঁর অনুমানটা এল এরপর। তিনি বললেন, সিঙ্গাপুর, চীন, জাপান ও কোরিয়া সংক্রমণের সর্বোচ্চ স্তর পার হয়ে এখন ঢালের নিচে পৌঁছেছে। ইউরোপের দেশগুলো পৌঁছাচ্ছে সর্বোচ্চ স্তরে। এ স্তরে খানিক অবস্থানের পর তা কমতে শুরু করবে। যুক্তরাষ্ট্রের ঢাল সবে যাত্রা করেছে ঊর্ধ্বমুখে। সর্বোচ্চ স্তর থেকে নিম্ন ধাপে পৌঁছাতে সময় লাগবে অন্তত তিন মাস। ভারত, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং আফ্রিকায় এ যাত্রা সবে শুরু হচ্ছে (ভারত বলতে আসলে তিনি পুরো দক্ষিণ এশিয়া বুঝিয়েছেন) এবং তাদেরও এই ধাপগুলো পেরিয়ে আসতে হবে। বিশ্ব পরিক্রমা সেরে এই ভাইরাসের নিগ্রহ শেষ হতে বছর বা বেশি সময় পার হয়ে যাবে।

প্রধানমন্ত্রী লি চিকিৎসক নন, তবে সার্বিক অবস্থাদৃষ্টে তার বক্তব্যের সারবত্তা অনুভব করা যায়। ধরা যাক, আমার স্ত্রীর অনুমান সত্য হলো। বাংলাদেশের মানুষের জন্য এর চেয়ে স্বস্তির আর কিছু হতে পারে না। কিন্তু যদি তা না হয়? যদি আগামী এক মাসে ব্যাপক আকারে ছড়ায় এ রোগ? আমরা কি প্রস্তুত তা মোকাবিলা করতে?

প্রস্তুতি প্রসঙ্গে দুই মাস ধরে আমরা আশ্বাস এবং বাগাড়ম্বর শুনে আসছি বিস্তর। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল দেশের স্বাস্থ্য নেতৃত্ব সবে তাদের গভীর নিদ্রা থেকে জাগ্রত হয়ে আড়মোড়া ভাঙছেন। ১৭ কোটি লোকের দেশে হাজার দুয়েক টেস্ট কিট নিয়ে তাঁরা নিশ্চিন্তে বসেছিলেন। সম্প্রতি উপহার হিসেবে চীন সরকার ১০ হাজার এবং আলিবাবার জ্যাক মা ৩০ হাজার কিট দিয়েছেন। কিট সংগ্রহের জন্য স্বাস্থ্য বিভাগের কোনো দৌড়ঝাঁপ নজরে পড়ল না। কিট ব্যবহার করে পরীক্ষা করার ব্যবস্থা গ্রহণে শ্লথগতিও দৃষ্টিকটু পর্যায়ে পৌঁছেছে। এত দিন ঢাকার মাত্র একটি ল্যাবে এই পরীক্ষা করা যেত। অনেক পরে চট্টগ্রামে একটি এবং এ সপ্তাহে বোধ হয় আর দু তিনটি স্থানে এ ব্যবস্থা হচ্ছে। এমনকি প্রতি বিভাগীয় শহরেও এখনো পরীক্ষা চালু হয়নি, যেখানে আসলে প্রয়োজন অন্তত প্রতি জেলা শহরে। আইসিডিডিআরবিকে টেস্ট করার ‘অনুমতি’ দেওয়া হলো গত রোববার। মানুষ কীভাবে এই সেবা পাবে, তা-ও স্পষ্ট নয়। একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, যাঁর এক রোগী করোনায় মারা যাওয়ায় তিনি হোম কোয়ারেন্টিনে ছিলেন, টেস্ট করানোর চেষ্টা করে পদ্ধতিগত জটিলতায় বিরক্ত হয়ে বাদ দিয়েছেন।

চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষাসামগ্রীর বিষয়ে মন্ত্রী মহোদয় তো প্রথমে বললেন, লাগবেই না! তারপর যা হোক, স্বাস্থ্য বিভাগ যখন এর প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করল, তখনো তা সংগ্রহের জন্য তেমন সচেষ্ট হওয়ার লক্ষণ দেখা গেল না। অনেকটাই ব্যক্তি বা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে এর অভাব এখন পূরণ হওয়ার পথে। বাংলাদেশের ১২টি কারখানায় এখন সুরক্ষা পোশাক তৈরি হচ্ছে। চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে দেখলাম, অনেকেই নিজ উদ্যোগে সুরক্ষাসামগ্রী জোগাড় করেছেন, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পাননি।

সরকারি হিসাবে বাংলাদেশে এ পর্যন্ত করোনা শনাক্ত হয়েছ ৫১ জনের, মারা গেছেন ৫ জন। সংখ্যা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী উল্টো প্রশ্ন রেখেছেন, সংখ্যা বেশি হলে তাঁরা খুশি হতেন কি না। জি না মন্ত্রী মহোদয়, সেটা হলে কেউই খুশি হতো না, সবাই চায় সংখ্যাটা ছোটই হোক। সেই সঙ্গে আরও যেটা চায় তা হচ্ছে, সংখ্যাটা যে প্রকৃতই ছোট, এ ব্যাপারে নিশ্চিত হতে। পত্রিকায় জ্বর, শ্বাসকষ্ট নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে মৃত্যুর খবর প্রকাশিত হচ্ছে। তারা করোনায় মারা গেছেন কি না, আর গিয়ে থাকলে তাদের সংস্রবে কারা এসেছিলেন, তার কোনো তথ্য নেই। কারণ সেটা পরীক্ষা করার কার্যকর ব্যবস্থা আপনার বিভাগ করতে পারেনি। সরকারের পরিসংখ্যান নিয়ে সন্দেহ এ কারণেই।

এরপর আসে চিকিৎসার প্রশ্ন। কয়েকটি হাসপাতালকে করোনা চিকিৎসার জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে। একমাত্র কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী ছাড়া কোনোটাই এখনো প্রস্তুত নয়। তবে সবচেয়ে বিভ্রান্তিকর হচ্ছে, করোনা চিকিৎসা বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরামর্শ। লক্ষণ দেখা দিলে আলাদা করার কথা আছে। অবস্থা গুরুতর হলে সদর হাসপাতালে যোগাযোগের পরামর্শ আছে। কিন্তু টেস্ট কোথায় কীভাবে করা যাবে, গুরুতর অবস্থায় চিকিৎসা কোথায় পাওয়া যাবে, তার কোনো কথা নেই। নেত্রকোনা বা পঞ্চগড়ের শ্বাসকষ্টের রোগীকে কী বলবেন সদর হাসপাতালের চিকিৎসক? কোন ব্যবস্থা আছে তাঁর কাছে রোগ নিরাময় বা চিকিৎসা দেওয়ার?

সাধারণ চিকিৎসাও দেশজুড়ে ব্যাহত হচ্ছে করোনা আতঙ্কে। অনেক প্রাইভেট হাসপাতাল বন্ধ, চিকিৎসকদের অনেকে বসছেন না তাঁদের চেম্বারে। জীবন সবার কাছেই মূল্যবান, তাই কাউকে দোষারোপ করা হয়তো যাবে না। তবে চিকিৎসা পেশা কিন্তু আর দশটা পেশার মতো নয়। এই বিপদের দিনে মানুষের ভরসা চিকিৎসকেরাই। তাঁদের সুরক্ষার জন্য সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নিতে হবে অবশ্যই, তবে পাশাপাশি এর পরও যেটুকু ঝুঁকি থাকবে, সেটুকু মেনে নিয়েই সেবা দিয়ে যেতে হবে তাঁদের। একটি খবরের প্রতি শুধু দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। যুক্তরাজ্যে ২০ হাজার অবসরপ্রাপ্ত ডাক্তার এবং নার্স স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে যোগ দিয়েছেন করোনা মহামারি মোকাবিলায়। দেশে চিকিৎসকদের দুটো বড় সংগঠন আছে। একটি সব চিকিৎসকের সংগঠন বিএমএ, অন্যটি আওয়ামীপন্থী চিকিৎসকদের স্বাচিপ। স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ স্বাস্থ্য সংকটে এই সংগঠন দুটির ভূমিকা হওয়া উচিত ছিল সবচেয়ে দৃশ্যমান এবং কার্যকর। কিন্তু বিস্ময়করভাবে চিকিৎসকদের নিরাপত্তা ও স্বার্থের বিষয়েও তাদের তেমন সক্রিয় দেখা যাচ্ছে না। পেশাজীবী কোনো সংগঠনে যখন রাজনীতিকীকরণ পরিপূর্ণতা লাভ করে, তখন এটাই বোধ হয় ভবিতব্য।

সুখবরও আছে বেশ কিছু। অনেক মানুষ এবং প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসছেন এ ব্যাপারে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে। এ দেশ যাঁদের বিপুল বিত্ত অর্জনের সুযোগ করে দিয়েছে, তাদের কেউ কেউ দান করছেন প্রধানমন্ত্রীর তহবিলে। সুরক্ষাসামগ্রী দান করছে বেক্সিমকো; আকিজ গ্রুপ তড়িঘড়ি একটা হাসপাতাল তৈরি করছে, যেখানে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র সেবা দেবে। বসুন্ধরা বলেছে তাদের কনভেনশন সিটিতে উহানের চেয়েও বড় হাসপাতাল তৈরি করবে। মানুষ আশা করে, এদের দেখাদেখি ভাগ্যবানদের আরও অনেকে এগিয়ে আসবেন একইভাবে।

আমাদের তাহলে করণীয় কী? যেসব দেশ করোনা মোকাবিলায় সাফল্য দেখিয়েছে তাদের অনুসরণ করাই হবে আমাদের জন্য সঠিক পথ। তিনটা কাজ করেছে তারা
১। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা,
২। বড় সংখ্যায় টেস্ট করা ও আক্রান্তদের সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করা, এবং
৩। গুরুতর রোগীদের হাসপাতালে নিয়ে যথাযথ চিকিৎসা দেওয়া।

প্রথমটির ব্যাপারে সরকার পদক্ষেপ নিয়েছে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তায় তা প্রয়োগ করা হচ্ছে। বাকি দুটোর দায়িত্ব আমাদের স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের। কিন্তু এ ক্ষেত্রে গত দুই মাসে যে অভিজ্ঞতা হয়েছে তাতে খুব ভরসা পাওয়া যাচ্ছে না। বিশেষ করে তৃতীয়টির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে প্রতি জেলায় করোনা চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল নির্দিষ্ট করা এবং সেখানে সেবাদানের অবকাঠামো তৈরি করা, শ্বাসকষ্ট শুরু হলে রোগীদের ভেন্টিলেটর দেওয়া, আর এ জন্য বড় সংখ্যায় অবিলম্বে ভেন্টিলেটর সংগ্রহ করা, সেগুলো জেলায় প্রেরণ এবং প্রয়োজনীয় জনবলের দ্রুত প্রশিক্ষণ। এর সবই সম্ভব, প্রয়োজন শুধু দীর্ঘসূত্রতা পরিহার আর ন্যূনতম পারদর্শিতা।

ভারত সরকার ৪০ হাজার ভেন্টিলেটর তৈরির আদেশ দিয়েছে, যার মধ্যে ভারত ইলেকট্রনিকস তৈরি করছে ৩০ হাজার। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প অনেক গড়িমসির পর জেনারেল ইলেকট্রিককে এক লাখ ভেন্টিলেটর তৈরির আদেশ দিয়েছেন। জার্মানিতে মার্সিটিজ কোম্পানি ভেন্টিলেটর তৈরি শুরু করেছে। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক ওমর ইশরাক তার প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে ভেন্টিলেটর তৈরির কৌশল উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠান ওয়ালটন তার ভিত্তিতে ভেন্টিলেটর তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানা গেছে। এ ছাড়া আমাদের জন্য চীন সহায়ক হতে পারে। তাই প্রয়োজনে সর্বোচ্চ পর্যায়ে চীনের সঙ্গে যোগাযোগ করা যেতে পারে। অন্তত পাঁচ হাজার ভেন্টিলেটর নিয়ে প্রস্তুত থাকা দরকার বাংলাদেশের। যদি সৌভাগ্যক্রমে করোনা মহামারি আকার না-ও নেয়, এই বিনিয়োগ বৃথা যাবে না। জেলা পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবার প্রয়োজন এবং জোগানের বিদ্যমান বিশাল ফারাক পূরণে এই যন্ত্রগুলো কাজে লাগানো যাবে।

আমার মনে হয় আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এ ক্ষেত্রে একমাত্র প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি এবং সুনির্দিষ্ট নির্দেশের মাধ্যমেই ফলোদয় সম্ভব। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি বিনীত অনুরোধ, তিনি যেন এ বিষয়ে সরাসরি হস্তক্ষেপ করেন।

মো. তৌহিদ হোসেন: সাবেক পররাষ্ট্রসচিব