করোনাকালের সমাজ আশীর্বাদ না অভিশাপ

মানুষ আশায় বাঁচে। হতাশ সময়েও মানুষ ভরসা খোঁজে সমাজের কাছে। বিখ্যাত রাজনৈতিক তাত্ত্বিক ও দার্শনিক টমাস পেইন ‘কমনসেন্স’ নামে সাড়াজাগানো এক পুস্তিকা লিখেছিলেন ১৭৭৬ সালে। সাড়াজাগানো এই অর্থে যে সেই পুস্তিকা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতাসংগ্রামের পালে জোর হাওয়া দিয়েছিল। সেখানে টমাস পেইন বলেছিলেন, কোনো একটি সমাজ ভালো বা খারাপ যেমনই হোক না কেন, তবু সেটা আশীর্বাদ। অর্থাৎ মানুষের জীবনে সমাজের প্রয়োজনীয়তা এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে খারাপ হলেও সেটা আশীর্বাদ।

মানুষে মানুষে মিলেই সমাজ হয়। সেই মানুষেরা একে অপরের বিপদে এগিয়ে না এসে উল্টো বিপদগ্রস্তকে অবাঞ্ছিত করলে সমাজ আর আশীর্বাদ থাকে না। সেই সমাজ তখন আর সমাজও থাকে না। সমাজের এমন নিষ্ঠুর রূপ কেমন, সেটা কিশোরগঞ্জের এক অ্যাম্বুলেন্সচালক জানেন। তাঁর মতো আরও যাঁরা করোনা আক্রান্ত সন্দেহে সামাজিক জিঘাংসার মুখোমুখি, তাঁরাও সেটা জানেন। কিশোরগঞ্জের সেই অ্যাম্বুলেন্সচালক করোনার উপসর্গ নিয়ে জেলার তাড়াইল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি ছিলেন। কিন্তু স্থানীয় লোকজন তাঁকে হাসপাতাল ছেড়ে চলে যেতে বলে। তা না হলে পিটিয়ে তাঁকে এলাকাছাড়া করারও হুমকি দেয়। সেই চালক জীবন নিয়ে হাসপাতাল ছেড়ে পালিয়ে অন্য আরেকটি হাসপাতালে ভর্তি হন।

যূথবদ্ধতা ও যৌথতাই সমাজের মৌলিক ধারণা। বিপদে-আপদে যূথবদ্ধতাই সমাজের অস্তিত্ব। করোনায় সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে বলা হচ্ছে। এর মানে এই নয় যে মানুষের অন্তিম সময়েও আমরা মুখ ফিরিয়ে নেব। এটা দূরত্ব নয়, বিচ্ছিন্নতা। জনবিচ্ছিন্ন সমাজ টিকে থাকে না। সেটা হোক শহর কিংবা গ্রাম।

শহরের সমাজে সংহতি গ্রামের চেয়ে কম বলেই বেশির ভাগ মানুষের উপলব্ধি। সেটা ‘শহর’ ধারণার দোষ নয়। সমাজবিজ্ঞানী মামফোর্ড বলেছিলেন, শহর হলো ‘আ কালেক্টিভ ওয়ার্ক অব আর্ট’। বলা যায় যৌথ প্রয়াসের কৌশল। তাই দোষ শহরের নয়, দোষ হলো ভুল নীতির কারণে ভুলভাবে শহর গড়ে ওঠার। ফলে যূথবদ্ধতার জায়গায় আমাদের শহর হয়েছে জমাটবদ্ধ বিশৃঙ্খলা, সব ধরনের মানসিক বিকৃতি আর অস্বাভাবিক মানসিকতার কেন্দ্রস্থল।

হাসপাতাল ছেড়ে জ্বর-সর্দি আক্রান্ত সেই অ্যাম্বুলেন্সচালক যখন পালিয়ে যেতে বাধ্য হলেন, তখন যূথবদ্ধতা বা যৌথতার ধারণা খুঁজে পাওয়া যায়নি। খিলগাঁওয়ে করোনায় মারা যাওয়া ব্যক্তির লাশ স্থানীয় কবরস্থানে দাফন করতে দেওয়া হবে না বলে যখন ব্যানার টানিয়ে দেওয়া হয়েছিল; সেখানেও সমাজের ধারণা টেকেনি।

কিংবা বগুড়ার শিবগঞ্জে যে লোকটি মারা গেলেন সমাজের কোনো প্রকার সাহায্য ছাড়া, তাঁর লাশও ওই এলাকায় কবর দিতে বারবার বাধার মুখে পড়েছে। অথচ ব্যক্তিটি জ্বরে আক্রান্ত হওয়ায় রাতভর তাঁর স্ত্রী চেষ্টা করেছেন হাসপাতালে নেওয়ার জন্য। একটা অ্যাম্বুলেন্সের জন্য সেই রাতজাগা আকুতি কোনো কাজে আসেনি। কোনো প্রতিবেশী সাড়া দেয়নি। বারবার হটলাইনে ফোন করে ব্যর্থ হয়েছেন মৃত ব্যক্তির স্ত্রী।

একই স্থানে রংপুরের এক শ্রমজীবী ব্যক্তিকে ট্রাক থেকে করোনা–আতঙ্কে ফেলে যাওয়া হয়। কেউ এগিয়ে আসেনি সহায়তায়। শেষ পর্যন্ত পুলিশ খবর পেয়ে হাসপাতালে নিয়ে যায়। সমাজ না টিকলে যে আমরা কেউ টিকব না, এসব ঘটনায় তার প্রমাণ মেলে। কিশোরগঞ্জে অ্যাম্বুলেন্সচালক অবাঞ্ছিত হলেন, কিন্তু তাঁর মতোই একজন অ্যাম্বুলেন্সচালকের অভাবে বগুড়ার জ্বর আক্রান্ত ব্যক্তি মারা গেলেন।

সমাজ টিকিয়ে রাখতে রাষ্ট্রের ভূমিকা আছে। সাভারের এক লোক শ্বাসকষ্ট নিয়ে একটার পর একটা হাসপাতাল বদল করে শেষ পর্যন্ত মারা গেলেন। একজন মুক্তিযোদ্ধা ১৬ ঘণ্টা অ্যাম্বুলেন্সে ঘুরে ঘুরে বিনা চিকিৎসায় প্রাণ হারালেন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ চিকিৎসা দিতে ভয় পাচ্ছিল। হাসপাতালে ডাক্তার-নার্সরা মানুষের চিকিৎসা দিতে অস্বীকার করছেন, কারণ করোনাভীতি, পর্যাপ্ত সুরক্ষা সরঞ্জামের অভাব। অথচ সুরক্ষা সরঞ্জাম নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। করোনার সময়ে সমাজ টিকিয়ে রাখা—এটাই রাষ্ট্রের ভূমিকা হওয়ার কথা ছিল।

উত্তরার দিয়াবাড়ীতে কোয়ারেন্টিন সেন্টার খোলার বিরুদ্ধে স্থানীয় জনগণ বাধা দেয়, তেজগাঁও শিল্প এলাকায় করোনা আক্রান্ত রোগীদের জন্য বিশেষ হাসপাতাল করার বিরুদ্ধে স্থানীয় কাউন্সিলরসহ মানুষ বাধা দেয়। এসব ঘটনা সমাজের যৌথতাকে অস্বীকার করার প্রদর্শনী। সমাজ শুধু সুস্থদের নিয়ে হয় না। অসুস্থ রোগীরাও সমাজের অংশ। সমাজের এক অংশকে অস্বীকার করে সে পূর্ণ হতে পারে না। রাষ্ট্র না থাকলেও মানুষ বাঁচে, কিন্তু সমাজ না থাকলে মানুষ বাঁচে না।

মানুষে মানুষে শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার সম্পর্কই সমাজ টিকিয়ে রাখে। যশোরের মনিরামপুরে সহকারী কমিশনার (ভূমি) কয়েকজন বৃদ্ধকে কান ধরে ওঠবস করিয়েছেন বলে অভিযোগ। শাস্তিস্বরূপ তাঁকে বদলিও করা হয়েছে। কান ধরে ওঠবস করানোয় আর যা–ই হোক, শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল না। সেই সরকারি কর্মকর্তার একটি ব্যাখ্যা ফেসবুকে এসেছিল; বলেছেন যে বৃদ্ধরা নিজেরাই কান ধরেছেন, তিনি ধরতে বলেননি। কিন্তু তিনি কেন প্রবীণ কয়েকজন ব্যক্তির কথিত ‘স্বেচ্ছা’ অপদস্থ হওয়ার ছবি সরকারি ওয়েবসাইটে দিলেন, তার ব্যাখ্যা নেই।

আবার রাজশাহীর জেলা প্রশাসক (ডিসি) সামাজিক পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসাকে জয়ী করেছেন। বৃদ্ধ এক ব্যক্তি কাগজ কুড়িয়ে আয় করেন। করোনা–আতঙ্কের মধ্যেও তাঁকে রাস্তায় বের হতে হয়। ডিসিকে দেখে ভয় পেয়ে তিনি ভুল স্বীকার করে মাফ চাইতে শুরু করেন। কিন্তু ডিসি তাঁকে বুকে জড়িয়ে সাহস দিয়েছেন। বৃদ্ধ যে কোনো অন্যায় করেননি, তা বোঝাতে পেরেছেন। ডিসি তাঁকে কিছু আর্থিক সাহায্যও দিয়েছেন বলে ফেসবুক মারফত জানতে পারলাম। কিংবা চট্টগ্রামে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের কর্মীরা রাস্তার পাশে পড়ে থাকা বৃদ্ধকে পুলিশের সহায়তায় হাসপাতালে নিয়ে গেছে। সংকটকালে এভাবেই সমাজ টিকে যায়, যখন এসব ঘটনার পরিমাণ বেশি হয়।

বায়োপলিটিকস সম্পর্কে দার্শনিক মিশেল ফুকো বলে গেছেন ‘দ্য বার্থ অব বায়োপলিটিকস’ গ্রন্থে। মানুষের জীবনপ্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণের রাজনৈতিক যুক্তিই বায়োপলিটিকস। রোগের বদলে মানুষকে অস্পৃশ্য ভাবাও এর অংশ। করোনা নতুন ধরনের বায়োপলিটিকস ও বর্ণবাদ নিয়ে হাজির হয়েছে। চীনের মানুষদের বিশ্বব্যাপী অস্পৃশ্য করার ঘটনা আমরা সবাই জানি। এ বিষয়ে ১৯১২ সালে লেখা টমাস ম্যানের সেই উপন্যাসের কথা মনে পড়ে। ‘ডেথ ইন ভেনিস’ উপন্যাসে তিনি লিখেছিলেন, কীভাবে কলেরা রোগের কারণে প্রাচ্যের লোকদের অস্পৃশ্য ভাবা হতো। কারণ কলেরার উৎপত্তি প্রাচ্যের এই বঙ্গদেশে। এটাকে লেখক তাঁর উপন্যাসের নায়কের মুখ দিয়ে বলিয়েছেন ‘হরর অব ডাইভার্সিটি’ বা বৈচিত্র্যের আতঙ্ক।

ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রও এখন এই অস্পৃশ্যের তালিকায়। এসব দেশ থেকে যারাই আসছে, তাদেরই আমরা সামাজিকভাবে ‘অপর’ বানিয়ে ফেলেছি। সেই স্তর পার হয়ে এখন নিজ দেশেও যারা করোনার সন্দেহের তালিকায়, তাদের আমরা ‘অপর’ হিসেবে দেখছি। তাই তাদের জায়গা হচ্ছে না হাসপাতালে, লাশের দাফন হচ্ছে না নিজ সমাজে। সমাজের ধারণা এভাবে টিকে থাকবে না। আমরা কি কিছু বুঝতে পারছি না? এমন চলতে থাকলে একটা সময় সবাই ‘অপর’ হয়ে যাব? ‘নিজ সত্তাও’ তখন অপর হয়ে যাবে। কারণ, আমরা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারি না যে করোনা আমাকে ছোঁবে না।

এমন সংকটকালেই সবচেয়ে বেশি দরকার সমাজবদ্ধতা। সংকটকালেই মানুষ সমাজ চেনে। নগরজীবনে বছরের পর বছর পাশাপাশি থেকেও পাশের ফ্ল্যাটের প্রতিবেশীকে আমরা হয়তো চিনি না। কিন্তু দুর্যোগের সময় সবাই একে অপরের কাছাকাছি অন্তত রাস্তায় নেমে দাঁড়াই। হোক সেটা ভূমিকম্প, অগ্নিকাণ্ড কিংবা চোরের আগমন। করোনায় আমরা পাশাপাশি না দাঁড়াই, অন্তত মুখ ফিরিয়ে যেন না নিই । সংকটকালেই সমাজের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। সে সময় ব্যর্থ হলে সমাজ টেকে না। সমাজ না টিকলে মানুষ বাঁচে না। সমাজ তখন আশীর্বাদ নয়, অভিশাপ। আর তেমন হলে আমরা কেউ বাঁচব না।

খলিলউল্লাহ্‌: প্রতিচিন্তার সহকারী সম্পাদক
[email protected]