আগে যা যা দেখেনি মানুষ

করোনাভাইরাস। প্রতীকী ছবি
করোনাভাইরাস। প্রতীকী ছবি

কখনো ১০ বছরেও কিছু বদলায় না, কখনো এক মাসে ইতিহাস এগোয় ১০টা বছর! বাংলাদেশে গত এক মাসে আমরা যা দেখেছি তা আগে দেখিনি। আগে দেখিনি মানুষ লাশ দাফনে বাধা দিচ্ছে, আগে দেখিনি জরুরি ভিত্তিতে হাসপাতাল বানানোর কাজ ভুঁইফোড় নেতারা বন্ধ করে দিচ্ছেন। মানুষ বাঁচানোর চেয়ে ক্ষমতা বাঁচানো, টাকা বানানো আগেও বড় ছিল, কিন্তু বাঁচার পথে এমন সর্বাত্মক বাধা যুদ্ধের সময় ছাড়া আর দেখা যায়নি। 

কোথায় জীবন–মৃত্যুর ম্যানেজার
মানুষই এখন মানুষের সবচেয়ে বড় ভয়, আবার মানুষই জান বাজি রেখে পাশে দাঁড়াচ্ছে মানুষের। তারপরও রোগীকে রাস্তায় ফেলে রাখছে, হাসপাতাল ফিরিয়ে দিচ্ছে, রক্তের সম্পর্কের দায় নিচ্ছে না মানুষ—আগে কখনো দেখেছি কি? আগে দেখিনি লকডাউন, দেখিনি বাড়িতে বাড়িতে লাল পতাকা উড়িয়ে কিছু পরিবারকে বিপজ্জনক বলে দাগিয়ে দেওয়া। আগে দেখিনি ঘরের ভেতর পিতা–মাতা–কন্যার মরে পড়ে থাকা, ডেকে ডেকেও কারোরই সাহায্য না পাওয়া। বিপদের দিনে চীন ও ইতালি তাদের সবচেয়ে ভালোটা বের করে এনেছে, আমরা বের করে আনছি সবচেয়ে খারাপটা। করোনা ভাইরাস কিছু মানুষ মারছে সত্য। যাদের হয়তো বাঁচানো যেত, বিনা চিকিৎসায় ও খাদ্যাভাবে তারাও যায় যায়।' জ্বর ও শ্বাসকষ্টে' মৃতদের নাম করোনায় মৃত্যুর টালিখাতায় উঠছে না। জীবন–মৃত্যুর ম্যানেজার হাত গুটিয়ে কিসের যেন ধ্যানে বসেছেন।

পৃথিবীর বুকে এক আত্মঘাতী বোমারু
চীনের দেয়াল কোনো কাজে আসছে না। ইউরো–আমেরিকাকে দুর্গের মতো সুরক্ষিত বলে ভাবারও দিন শেষ। প্রতাপশালী নেতারা হাস্যকরভাবে ব্যর্থ আর শক্তিমান দেশগুলোতে মৃত্যু হয়েছে তৃতীয় দুনিয়ার মতো সুলভ ও করুণ। ভেনিস, ফ্লোরেন্স, ভ্যাটিকান আর সুন্দর কিছু মনে করায় না, মনে করায় ১০ হাজার ছাড়িয়ে যাওয়া মৃত্যু। প্যারিসের শৈল্পিক আবেদন চাপা পড়েছে মৃত্যুর বিভীষিকায়। সবচেয়ে বেশি করোনা আক্রান্তের রেকর্ড মার্কিন গর্ব বেলুনের মতো ফাটিয়ে দিয়েছে। মঙ্গল গ্রহে অভিযানের বৈজ্ঞানিক মহিমা তুচ্ছ হয়ে যাচ্ছে সামান্য এক ভাইরাসের কাছে। এই ব্যবস্থা নিজেই এক টাইম বোমা। সময়ে–সময়ে বিস্ফোরণ ঘটছে যুদ্ধের, মহামারির, মন্দার। কিন্তু একেই বুকে নিয়ে চলতে হচ্ছে মানুষের পৃথিবীকে। বুকে বোমা পুরে যে ঘোরে, তাকে আত্মঘাতী বোমারু বলে। পুঁজিবাদ পৃথিবীর বুকে এক আত্মঘাতী বোমারুর নাম।

কর্তৃপক্ষ কখনোই দায়ী নয়
একটি জিনিস কিন্তু বদলায়নি। কর্তৃপক্ষ আগের মতোই দায়ী নয়। করোনার যে ভ্যাক্সিন বাংলাদেশ আবিষ্কার করেছে তা হলো করোনা রোগী শনাক্তের উদ্যোগ থেকে দুরে থাকা। যদি রোগী চিহ্নিত না হয়, তাঁর মাধ্যমে যারা আক্রান্ত হয়েছে, তাদের খুঁজে বের করে কোয়ারেন্টিন করা না হয়, তাহলে চিকিৎসা দেওয়ার দায়ও থাকে না। রোগী না থাকলে ব্যর্থতাও নেই। লকডাউনের ক্ষেত্রেও তাই। আনুষ্ঠানিকভাবে লকডাউন ঘোষণা করতে হলে জীবনধারণের উপায় হারানো মানুষদের সহায়তা করতে হয়। তাদের খাদ্য ও চিকিৎসার দায়িত্ব লকডাউন কার্যকরকারী রাষ্ট্রের ওপর আপনাতেই বর্তায়।
লকডাউন প্যাকেজের জরুরি অংশ এই ত্রাণ। যেহেতু লকডাউন ঘোষণা করা হয়নি, সেহেতু সেই দায় রাষ্ট্রের নেই। নিজ দায়িত্বে বাড়িতে বসে থাকুন। আমাদের দরকার ছিল কঠোর শৃঙ্খলা, জরুরি সেবা এবং প্রয়োজন ছাড়া কারোরই বাড়ির বাইরে না থাকা। কিন্তু শৃঙ্খলা আসেনি। স্বাস্থ্যব্যবস্থা বিশৃঙ্খল, মানুষের জীবনযাপন বিশৃঙ্খল। করোনার মৃত্যুর খবর এখন গুজব।

মোবাইল ফোন হতে পারতো সহায়
দেশের প্রতিটি পরিবারের মোবাইল আছে, সেখানে করোনা সম্পর্কে প্রতিটি তথ্য, নির্দেশনা, প্রচারের আশি ভাগই তো সফট উপায়ে ডিজিটাল পথে করার কথা। কে কোথা থেকে কোথায় যাচ্ছে তা বের করা, রোগী শনাক্ত করে তার সংস্পর্শে আসাদের মোবাইল ট্র্যাক করে বের করে তাদের মাধ্যমে আর ছড়ানো বন্ধ করা। জেলা প্রশাসন, রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও চিকিৎসকদের কাছে রোগ বিস্তারের ধরন ও করণীয় নিয়ে নিয়মিতভাবে ওয়াকিবহাল রাখা—সব ডিজিটাল উপায়েই করা সম্ভব ছিল। চীনের উহানে করোনা যখন গণহারে প্রাণ নিচ্ছিল, তখনই গণমাধ্যম, সামাজিক মাধ্যম ও মোবাইল ফোন মারফত মানুষকে সজাগ ও নতুন বিপদ সম্পর্কে শিক্ষিত করা দরকার ছিল। ধাপে ধাপে প্রস্তুতি ও তার প্রয়োগ দরকার ছিল, মোকাবিলার অর্থনৈতিক, মেডিকেল ও প্রশাসনিক আয়োজন চালানো সম্ভব ছিল। তাহলে মানুষই অনেকটা শারীরিক দূরত্ব ও আছোঁয়া থাকার জন্য তৈরি হয়ে যেত।

ডিজিটাল বিপ্লব কী কাজে লাগল?
সরকারের বিভিন্ন সামাজিক সেবা কর্মসূচির আওতায় যাঁরা আছেন, তাঁদের সঙ্গে এনজিওদের তালিকা, জেলা প্রশাসনের তালিকা ধরে খুব অল্প সময়েই করোনায় আর্থিকভাবে সবচেয়ে বিপর্যস্ত জনগোষ্ঠীকে চিহ্নিত করা সম্ভব। এভাবে তালিকা করে ডিজিটাল পদ্ধতিতে তাঁদের সাহায্যের আশ্বাস দেওয়া এবং তাঁদের ঘরে খাবার পোঁছে দিলে বিশৃঙ্খলা এড়ানো যেত। সব সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে রোগীদের তথ্য নিয়ে জাতীয় পরিস্থিতির হিসাবটা হাতে আনা গেলে সে অনুযায়ী করণীয় ঠিক করা যেত। কিন্তু সবই গরল ভেল।
করোনা দমনে শৃঙ্খলা দরকার সমাজের মানুষের আর রাষ্ট্রের কর্মীদের। সেখানে শৃঙ্খলা দেখা যাচ্ছে না। ফলে করোনা দমন তো হচ্ছেই না, দমন হচ্ছে মানুষের আত্মরক্ষার চেষ্টা। কাজের কাজ এটুকুই হয়েছে; করোনা দমনকারী শক্তিকে আরও শক্তি দিয়েছে, আর মানুষকে করেছে খরচযোগ্য। করোনা ভাইরাসের এই রাজনৈতিক ব্যবহার বায়োপলিটিকস নামে পরিচিত। সমাজদার্শনিক মিশেল ফুকোর ভাষায়, মানুষের বেঁচে থাকার যে সামর্থ্য তা তার বায়োপলিটিকস। এই সামর্থ্য করোনা, দারিদ্র্য ও দমনের রাজনীতির ত্রিশূলে যখন বিদ্ধ হয়, তখন তাকেও বায়োপলিটিকস বলে। এরই জবাবে ফুকো বলেছিলেন, সোসাইটি মাস্ট বি ডিফেন্ডেড—সমাজকে বাঁচাতে হবে। সমাজ না বাঁচলে ব্যক্তিমানুষ একা হয়ে পড়ে, অসহায় হয়ে পড়ে। করোনার সহজ শিকার হয় এসব মানুষ।


এই সিস্টেমে ভাইরাস আছে
কারও জন্য সুরক্ষা আর কারও জন্য উদোম জীবন (Bare Life) কোনো বিশৃঙ্খলার ফল না, তা রাষ্ট্রের বায়োপলিটিকসেরই ফল। যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশ সবখানেই এই রাজনীতি চলছে। এটা একধরনের জরুরি অবস্থাই বটে, যখন জীবন–মৃত্যুর ম্যানেজাররা সিদ্ধান্ত নেন কাকে বাঁচানোর ব্যবস্থা থাকবে, আর কাকে বাঁচাতে কিছু করা হবে না। কিন্তু জনগণকে বাঁচানোর কথা বলেই জনগণের অনেক অধিকার 'জরুরি পরিস্থিতি'র দোহাই দিয়ে রদ করা হতে পারে। করোনা রাষ্ট্রগুলোকে সেই সুযোগ এনে দিয়েছে। অন্যদিকে মানুষকেও সুযোগ দিয়েছে আগামী দিনের উপযুক্ত সিস্টেম তৈরি করার। সেই সিস্টেম যেন প্রকৃতি ও মানুষের স্বাস্থ্যকে কেন্দ্র রেখেই হয়। প্রবৃদ্ধির মায়াহরিণের পেছনে অনেক তো ছোটা হলো, তাই না? করোনা কানে কানে বলে গেছে, প্রবৃদ্ধি তো খাওয়াও যায় না, মানুষও বাঁচায় না।
এই সিস্টেমে ভাইরাস আছে, করোনা ঠেকানোর পাশাপাশি এই সিস্টেম রিস্টার্ট নেওয়ার চিন্তাভাবনা এখনই দরকার।

ফারুক ওয়াসিফ: প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক।