আয়রোজগার বন্ধ

বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে তুলনা করলে করোনাভাইরাসের বৈশ্বিক মহামারি বাংলাদেশে এখনো গুরুতর রূপ নেয়নি—এটি সরকার ও জনগণের জন্য আপাতত স্বস্তিদায়ক। সংক্রমণের মাত্রা এখনো নিম্ন পর্যায়ে। দেশবাসীর সঙ্গে আমরাও আশা করতে চাই, সরকারের সামাজিক বিচ্ছিন্নতার নীতি এবং করোনা আক্রান্ত মানুষকে শনাক্ত ও তাদের সংস্পর্শে যাঁরা এসেছেন, তাঁদের পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করার কর্মসূচি সফল হবে। 

কিন্তু করোনা সংকট দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে এখনই যে প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে এবং অর্থনীতির ওপর দীর্ঘ মেয়াদে যে প্রভাব ফেলবে, সরকার তা কীভাবে সামাল দেবে, সেটাই দুশ্চিন্তার বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অর্থমন্ত্রীর কাটছাঁট কর্মসূচি কোথায় গিয়ে ঠেকবে, বলা কঠিন। সরকার প্রথম দফায় ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল ১০ দিনের ছুটি ঘোষণা করেছিল, পরে এটি ৯ এপ্রিল পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। 

বলার অপেক্ষা রাখে না যে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে সামাজিক বিচ্ছিন্নতা বা পুরোপুরি লকডাউনই কার্যকর উদ্যোগ। বিশ্বের সব দেশই এই কৌশল নিয়েছে। কিন্তু সমস্যা হলো আমাদের দেশে এতে সবচেয়ে বেশি যাঁরা ক্ষতির মুখে পড়েছেন, তাঁরা হচ্ছেন শহর ও গ্রামের দিনমজুর, রিকশাচালক, ভ্যানচালক, ছোট দোকানদার, পরিবহনশ্রমিক, রেস্তোরাঁর শ্রমিক, গৃহকর্মী, ফেরিওয়ালা বা হকারের মতো শ্রমজীবী শ্রেণির মানুষ। বাংলাদেশে এ ধরনের মানুষের সংখ্যা দুই কোটির বেশি। 

সরকার রপ্তানিমুখী শিল্পের জন্য যে পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা তহবিল গঠনের কথা বলেছে, তার সুবিধা অনানুষ্ঠানিক খাত বা ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প পাবে না। বাংলাদেশে অনানুষ্ঠানিক খাতেই ৮৬ শতাংশ শ্রমিক কাজ করেন। ফলে সামাজিক বিচ্ছিন্নতা বা সবকিছু বন্ধ করে দেওয়ার এক সপ্তাহ পার না হতেই দরিদ্র ও কর্মহীন মানুষের মধ্যে হাহাকার শুরু হয়েছে। আয়ের অভাবে তঁাদের জীবনধারণ কঠিন হয়ে পড়েছে। সরকার সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় দরিদ্র মানুষের ঘরে ঘরে খাবার পৌঁছে দেওয়ার কথা বলেছে। কিন্তু কাজটি কতটা কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে, তা পরিষ্কার নয়। 

 স্বাভাবিক অবস্থায় দরিদ্র ও অভাবী মানুষগুলোই প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের কাছে সহায়তার জন্য যান। কিন্তু এই মুহূর্তে সেই সুযোগ নেই। নিরাপত্তার জন্য সরকারই তাদের ঘরে থাকার পরামর্শ দিয়েছে। এ অবস্থায় হতদরিদ্র ও নিম্নবিত্ত মানুষের ঘরে খাদ্যসংকটের যে খবর গণমাধ্যমে এসেছে, সেটি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। কোনো কোনো স্থান থেকে ‘অবরুদ্ধ মানুষ’ টেলিফোন করে জানিয়েছেন, তঁারা খাবারের সংকটে রয়েছেন। এরপর প্রশাসন খবর পেয়ে তঁাদের কাছে খাবার পৌঁছে দিয়েছে। 

 কিন্তু এ ধরনের বিক্ষিপ্ত ও বিচ্ছিন্ন কার্যক্রম দিয়ে বিপুলসংখ্যক দরিদ্র মানুষের ঘরে খাবার পৌঁছানো যাবে না। সরকার সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় হতদরিদ্র মানুষের কাছে খাবার পৌঁছে দেওয়ার যে পরিকল্পনা নিয়েছে, সেটি বাস্তবায়ন হবে কীভাবে? মাদারীপুরের পর সাতক্ষীরায়ও খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির চাল আত্মসাতের খবর পত্রিকায় এসেছে। রাজনৈতিক প্রভাব–প্রতিপত্তির জোরে এই চাল বিতরণের দায়িত্ব যঁারা পান, তঁাদের বেশির ভাগই আত্মস্বার্থ উদ্ধারে ব্যস্ত থাকেন। এর স্থায়ী প্রতিকার প্রয়োজন। 

অতীতে দেখা গেছে, কর্মসূচি সফল না হলে জনপ্রতিনিধিরা প্রশাসনকে আর প্রশাসন জনপ্রতিনিধিদের দোষারোপ করে থাকে। এখন দোষারোপের সময় নয়। এই মুহূর্তে হতদরিদ্র ও অভাবী মানুষের কাছে খাবারসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য পৌঁছানো জরুরি। সরকারি গুদামে প্রচুর খাদ্য মজুত থাকলেই হবে না, সেই খাদ্য হতদরিদ্র মানুষের কাছে পৌঁছানোরও ব্যবস্থা করতে হবে। অন্যথায় মানবিক বিপর্যয়ের ভয় থেকেই যাচ্ছে।