অটিজম সচেতনতা দিবস: অটিজম নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা ও বাস্তবতা

বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের চরম আতঙ্কের মধ্যে আজ পালিত হতে যাচ্ছে বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে সারা বিশ্ব যখন নাকাল, তখন অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুরা আরও বেশি নাজুক। এই সময়ে তাদের বিশেষ যত্ন ও সেবার প্রয়োজন। তাদের দিকে বেশি খেয়াল রাখা প্রয়োজন।

বাংলাদেশে এবারের অটিজম সচেতনতা দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য ‘সমবেত মমতা গড়ি, অন্তর্ভুক্তির শপথ করি’। আমরা জানি, অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার (এএসডি) বা অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুদের লক্ষণ ও উপসর্গের মাত্রা বিচিত্র। একজনের সঙ্গে আরেকজনের হুবহু মিল নেই। কেউ সবাক, কেউ বা বাক্‌শক্তি থাকা সত্ত্বেও কথা বলে না। কারও আচরণ অতি চঞ্চল, কেউ অতিরিক্ত গুটিয়ে থাকা স্বভাবের।

অটিজম বিয়য়ে অনেকের মধ্যে কিছু ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে। সেসব ভ্রান্ত ধারণা দূর করার জন্য এর বাস্তবতা তুলে ধরা যাক।

ভ্রান্ত ধারণা ১: অটিজম মানসিক অসুস্থতা
বাস্তবতা: এএসডি মস্তিষ্কের বিকাশজনিত সমস্যা। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে এএসডির বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তিদের মস্তিষ্কের দুই পাশের গঠনে এবং নিউরোট্রান্সমিটার লেভেলে অসংগতি আছে।

ভ্রান্ত ধারণা ২: শুধু ছেলেশিশুদেরই অটিজম হয়
বাস্তবতা: মেয়েশিশুদেরও অটিজম হতে পারে। বাস্তবে দেখা যায়, যেকোনো জাতি, অর্থনৈতিক অবস্থা এবং বয়সভেদেই অটিজম হয়ে থাকে। দ্য সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (সিডিসি) গবেষণায় দেখা গেছ, আট বছর বয়সী প্রতি ৬৮টি শিশুর মধ্যে একজন এএসডি বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন (৪২টা ছেলেশিশুর এবং ১৮৯টি মেয়েশিশুর মধ্যে একজন করে)। কৃষ্ণাঙ্গ শিশুর চেয়ে শ্বেতাঙ্গ শিশুদের মধ্যে এএসডি লক্ষণ ৩০ বেশি।

ভ্রান্ত ধারণা ৩: অটিজম শনাক্ত করতে মেডিকেল পরীক্ষার প্রয়োজন।
বাস্তবতা: অটিজম শনাক্ত করার জন্য কোনো মেডিকেল টেস্ট নেই। চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞরা শিশুর আচরণ মূল্যায়ন করে তা নির্ণয় করেন। যেমন চোখে চোখ না রাখা, নাম ধরে ডাকলে কোনো প্রতিক্রিয়া না করা, দুলতে থাকা এবং খেলনা দিয়ে অর্থহীনভাবে খেলা করা, বারবার একই কথা বলা, একই কাজ করা ইত্যাদি।

ভ্রান্ত ধারণা ৪: এএসডি বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুরা বুদ্ধিগতভাবে অক্ষম।
বাস্তবতা: সিডিসির রিপোর্ট অনুযায়ী এমন শিশুদের মধ্যে ২১ শতাংশের বুদ্ধিমত্তা খুব কম, ২৩ শতাংশের স্বাভাবিকের তুলনায় স্বল্প এবং ৪৬ শতাংশের বুদ্ধিমত্তা স্বাভাবিক বা স্বাভাবিকের ওপরে অবস্থান করে।

ভ্রান্ত ধারণা ৫: টিকা দেওয়ার কারণে অটিজম হয়।
বাস্তবতা: এ–জাতীয় বেশির ভাগ শিশুর ‌ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোনো কারণ শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। আগে এমন ধারণা প্রচলিত ছিল যে এমএমআরের টিকার কারণে শিশুদের অটিজম হয়ে থাকে। বিশেষজ্ঞরা এখন একমত যে এর কোনো বাস্তবতা নেই।

ভ্রান্ত ধারণা ৬: অটিজম সেরে যাওয়া সম্ভব।
বাস্তবতা: অটিজমের সুনির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই। গবেষণায় দেখা গেছে, বিহেভিয়র মডিফিকেশন টেকনিকসহ বিভিন্ন নিবিড় ও অগ্রিম পদক্ষেপের শিশুর অনেক উন্নতি করা সম্ভব।

ভ্রান্ত ধারণা ৭: অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন মানুষের কোনো পরিবর্তন হয় না এবং তারা আত্মনির্ভরশীল হতে পারে না।
বাস্তবতা: অটিজম কোনো স্থায়ী অবস্থা নয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর ইতি বা নেতিবাচক পরিবর্তন হতে পারে। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বেশির ভাগ শিশুর মধ্যে রোগের কারণও বাড়তেও পারে। কোনো কোনো শিশুর এপিলেপ্সি দেখা দিতে পারে। বয়ঃসন্ধিকালে এমন শিশুরা বিষণ্নতায় ভুগতে পারে। তাদের মধ্যে আচরণগত সমস্যা দেখা দিতে পারে। এদের অনেকেই নিজের কাজ করতে পারে এবং আত্মনির্ভরশীল হয়ে বেঁচে থাকতে পারে।

ভ্রান্ত ধারণা ৮: এ–জাতীয় শিশু ও প্রাপ্তবয়স্করা একা থাকতে পছন্দ করে। তারা সামাজিকভাবে যোগাযোগ করতে চায় না।
বাস্তবতা: তারা প্রায়ই সামাজিকভাবে যোগাযোগ করতে চায়, কিন্তু সামাজিক যোগাযোগে প্রায়োগিক দক্ষতার অভাবে তারা তা করতে পারে না। কখনো কখনো তারা বন্ধুত্বও তৈরি করতে পারে। তবে এসব ক্ষেত্রে কিছুটা সমস্যাও দেখা যায়।

ভ্রান্ত ধারণা ৯: অটিজমের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশু ও প্রাপ্তবয়স্করা সামাজিক দক্ষতা রপ্ত করতে পারে না।
বাস্তবতা: বিশেষ নির্দেশনা ও প্রশিক্ষণ পেলে তারা সামাজিক কাজেকর্মে দক্ষতা অর্জন করতে পারে।

ভ্রান্ত ধারণা ১০: এই শিশুরা ভালোভাবে মিশতে পারে না। চোখে চোখ রেখে তাকানো কিংবা ভালোভাবে কথা বলার ক্ষেত্রেও তাদের সমস্যা থাকে।
বাস্তবতা: অটিজমের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন কোনো কোনো শিশু ও প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি কথা বলতে পারে এবং অন্যের সঙ্গে মিশতেও পারে। চোখে চোখ রাখার ব্যাপারে তাদের উন্নতি করা সম্ভব। তাদের বাচনিক অথবা অবাচনিক যোগাযোগের দক্ষতাও বাড়ানো সম্ভব। বুদ্ধিমত্তার দিক থেকে তারা মেধাবী, সাধারণ বুদ্ধিসম্পন্ন এবং চিন্তর দিক থেকে তারা সক্ষম থাকতে পারে।

ভ্রান্ত ধারণা ১১: এই শিশুদের বৈশিষ্ট্য সবার ক্ষেত্র একই রকম।
বাস্তবতা: এমন শিশু ও প্রাপ্তবয়স্কদের শনাক্তকারী বৈশিষ্ট্যে মিল থাকলেও তারা প্রত্যেকে স্বতন্ত্র ও আলাদা।

ভ্রান্ত ধারণা ১২: অটিজমের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তিরা জীবনে অসফল হয় এবং সমাজে অবদান রাখতে পারে না।
বাস্তবতা: সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন অনেকেই জীবনে সফল হতে এবং সমাজে অবদান রাখতে পারে।

ভ্রান্ত ধারণা ১৩: অটিজমের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তির অনুভূতিহীন। অন্যের প্রতি তারা স্নেহ বা সহানুভূতি দেখাতে পারে না।
বাস্তবতা: এমন ব্যক্তিরা অন্যকে সহানুভূতি দেখাতে পারে। নিজেও অন্যের কাছ থেকে স্নেহ পেতে চায়। তবে সংবেদনশীলতার প্রক্রিয়াগত কারণে এবং সামাজিক বিষয় বোঝার পার্থক্যহেতু সাধারণের চেয়ে তাদের প্রকাশভঙ্গি কিছুটা ভিন্ন।

ভ্রান্ত ধারণা ১৪: পিতা–মাতার দুর্বল অভিভাবকত্ব সন্তানের অটিজমের জন্য দায়ী।
বাস্তবতা: এ ধারণা অজ্ঞতাপ্রসূত ও ভুল। অনিরূপিত অটিজমের ক্ষেত্রে সচেতনতামূলক পদক্ষেপ নেওয়া না হলে উন্নতি পিছিয়ে যায়। তবে তার অর্থ এই নয় যে জন্ম-পরবর্তী সময়কার দুর্বল অভিভাবকত্ব শিশুর অটিজমের জন্য দায়ী ছিল।

ভ্রান্ত ধারণা ১৫: অটিজমের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুদের সবারই শেখার ক্ষেত্রে সমস্যা হয়।
বাস্তবতা: এমন শিশুদের মধ্যে কারও কারও কোনো কিছু বোঝার ও শেখার সমস্যা থাকে। তবে কেউ কেউ, বিশেষত অ্যাসপারজার সিনড্রোম শিশুদের অনেকেই গণিতের মতো বিষয়ে অন্য শিশুদের সমান দক্ষতা অর্জন করতে পারে।

ভ্রান্ত ধারণা ১৬: এমন শিশুদের জন্য বিশেষ ধরনের খাবার প্রয়োজন।
বাস্তবতা: এটা সত্য, এ–জাতীয় শিশুদের অনেকেই দুধ বা দুগ্ধজাত এবং গ্লুটেনযুক্ত খাবারের প্রতি অ্যালার্জিক। চিনিযুক্ত যেসব খাবারে অ্যাসিডের পরিমাণ বেশি, সেসবও তাদের কারও কারও উত্তেজনা বা খিটখিটে মেজাজ বাড়িয়ে দিতে পারে। তবে এসব উদাহরণ কোনো সাধারণ সিদ্ধান্ত দেয় না।

ভ্রান্ত ধারণা ১৭: এ সমস্যা সাময়িক, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেরে যায়। কোনো বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়ার তাই দরকার নেই।
বাস্তবতা: এ শিশুদের সমস্যা কখনোই পুরোপুরি দূর হয় না। তবে নিবিড় পরিচর্যার মাধ্যমে কমিয়ে আনা। স্বল্প মাত্রায় অটিজম, যেমন এসপারজার সিনড্রোম অথবা হাই-ফাংশনিং অটিজমের ক্ষেত্রে যথাযথ সহযোগিতা, সমর্থন ও শিক্ষার মধ্য দিয়ে শিশু পরিণত বয়সে আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠতে পারে। উচ্চমাত্রায় অটিজমের ক্ষেত্রে পরিণত বয়সেও স্বনির্ভর দৈনন্দিন জীবনযাপন সম্ভব নাও হতে পারে।

ভ্রান্ত ধারণা ১৮: একই পরিবারে অটিজম থাকার ঘটনা একবারের বেশি ঘটে না।
বাস্তবতা: অটিজমের সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ এখনো সুপ্রমাণিত নয়। তবে জিনগত সমস্যা অটিজমের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে বলে ধারণা করা হয়। বিভিন্ন পর্যবেক্ষণে একই পরিবারে ভাইবোনদের মধ্যে একাধিকজনের এবং যমজ সন্তানদের উভয়ের মধ্যে অটিজমের প্রবণতা দেখা গেছে।

ভ্রান্ত ধারণা ১৯: শিশুর কথা বলতে দেরি হলে বুঝতে হবে তার অটিজম আছে।
বাস্তবতা: কথার পাশাপাশি শিশুরা অঙ্গভঙ্গি দিয়েও ‘আলাপচারিতায়’ অংশ নিতে পারে। কথা বলতে দেরি হলেও বহু শিশু এটি করতে পারে। দুই বছর বা তারও কম বয়স থেকেই মুখের অভিব্যক্তি, হাত নাড়া বা কাঁধ ঝাঁকানোর মাধ্যমে তারা অনেক কিছু বোঝাতে পারে। শিশু সবার সঙ্গে মিশলে, ডাকে সাড়া দিলে, চোখে চোখ রেখে কথা শুনলে বা প্রতিক্রিয়া দেখালে দুশ্চিন্তার তেমন কিছু নেই।

ভ্রান্ত ধারণা ২০: অটিজম থাকলে অন্য কোনো ডিজঅর্ডার থাকে না।
বাস্তবতা: এমন শিশুদের ‌এপিলেপসি (খিঁচুনি), অন্ধত্ব, বধিরতা, বুদ্ধিপ্রতিবন্ধিতা, ডাউন সিনড্রোম কিংবা অন্য শারীরিক সমস্যাও থাকতে পারে।

প্রাথমিক পর্যায়ে যথাযথ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অটিজমের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুদের অবস্থার উত্তরণ ঘটানো সম্ভব। এই শিশুরা পৃথিবীকে আপনার-আমার চেয়ে আলাদাভাবে দেখে। এরা খুব ভালো পর্যবেক্ষক। আশপাশের বহু কিছুই তারা পর্যবেক্ষণ করে। ভালো আচরণ, ভালোবাসা ও সহমর্মিতার মাধ্যমে তাদের সমাজের মূল ধারায় সম্পৃক্ত করা সম্ভব।


ডা. শাহীন আখতার ইনস্টিটিউট অব পেডিয়াট্রিক নিউরো-ডিজঅর্ডার অ্যান্ডন্ড অটিজমের (ইপনা) পরিচালক এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশু নিউরোলজি বিভাগের অধ্যাপক