অস্থায়ী আইসিইউ হতে পারে জাহাজের কনটেইনারে

করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে চলমান এই যুদ্ধে জেতার জন্য একজন রোগীর দুটি জিনিস দরকার। এক. নিজের দেহে সক্রিয় অনাক্রম্যতা (অ্যাকটিভ ইমিউনিটি) এবং দুই. চিকিৎসাসংক্রান্ত সেবা। সক্রিয় অনাক্রম্যতা বয়স্ক মানুষের মধ্যে কম বিধায় সব দেশেই কোভিড-১৯–এর ফলে তাঁরা বেশি মারা যাচ্ছেন। ইতালিতে এত বেশি লোক আক্রান্ত হচ্ছে যে সরকার সবার চিকিৎসা দিতে না পেরে বয়স্ক লোকদের সেবা দেওয়া কার্যত বন্ধ রেখেছে। অপেক্ষাকৃত কম বয়সীদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য চিকিৎসায় তাদের অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে।

উন্নত দেশগুলোর মধ্যে কয়েকটির অবস্থা দেখে আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ নিয়েও আমরা সবাই শঙ্কিত। আমাদের দেশে কত লোক কোভিড-১৯–এ আক্রান্ত হয়, আমরা কেউ জানি না। কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত রোগীর এখনো কোনো কার্যকরী চিকিৎসা না থাকলেও তাদের জন্য চীন বা অন্যান্য দেশ ত্বরিতগতিতে হাসপাতালের ব্যবস্থা করেছে। এই রোগ হলে রোগীকে মোটা দাগে সবার থেকে আলাদা করে ফেলতে হয়। চিকিৎসাসংক্রান্ত সেবা, বিশেষ করে রেসপিরেটরি সিস্টেমে সাপোর্ট দিতে হয়। রেসপিরেটরি সিস্টেমে সাপোর্ট দিতে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটের (আইসিইউ) বেডের সঙ্গে ভেন্টিলেশন থাকতে হয়। দেশে সরকারি ও বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় হাজারখানেক ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিট (আইসিইউ ও আইএমসিইউ) বেড থাকলেও ২৯টি আছে সরকার নির্ধারিত ঢাকার কয়েকটি করোনা চিকিৎসা ও সহায়তা হাসপাতালে। এই হাসপাতালগুলো হলো কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, কুয়েত–বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতাল, ঢাকা মহানগর হাসপাতাল, মাতৃসদন হাসপাতাল ও রেলওয়ে হাসপাতাল। আইসিইউ বেডের সংখ্যা শিগগির আরও কিছু বাড়বে বলে আশা করা যাচ্ছে। কারণ, আকিজ গ্রুপ ৩০১ বেডের একটি হাসপাতাল কোভিড-১৯ রোগীর জন্য ঢাকার তেজগাঁও এলাকায় করছে বলে পত্রিকায় পড়েছি।

ইতালিতে লাখে ১২ দশমিক ৫টি আইসিইউ বেড অর্থাৎ ৬ কোটি মানুষের জন্য সাড়ে সাত হাজার বেড আছে এবং ইউরোপের মধ্যে সর্বোচ্চ বেড আছে জার্মানির, সেখানে লাখে ২৯টি অর্থাৎ সোয়া ৮ কোটি মানুষের জন্য ২৪ হাজার বেড আছে। এতটা সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও ইতালি বয়স্ক রোগীদের আশা–ভরসা ছেড়ে দিয়েছে নিয়তির হাতে। সেই তুলনায় আমাদের দেশে আইসিইউ বেডের অপ্রতুলতা কাটিয়ে উঠতে দেশে বিত্তশালীরা ও অনেক ছোট-বড় হাসপাতাল এগিয়ে আসতে পারে।

ইতালির কার্লো রত্তি অ্যাসোসিয়াটি ও ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) সেনসিয়েবল সিটি ল্যাব মিলে জাহাজে ব্যবহৃত ২০ ফুট লম্বা কনটেইনারের মধ্যে ২টি আইসিইউ বেড নির্মাণের একটি অভিনব পদ্ধতি আবিষ্কার করেছে। করোনার এই সংকটকালে এই পদ্ধতির আইসিইউ খুব কাজে লাগবে বলে আশা করা যায়। একটি শহরে বর্তমানে থাকা আইসিইউ বেডের ওপর চাপ কমবে। এই পদ্ধতিতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক আইসিইউ বেডের সংস্থান করা সহজেই সম্ভব। এক কনটেইনারে ২টি করে বেড থাকবে অর্থাৎ ৬০টি বেড দরকার হলে কনটেইনার লাগবে ৩০টি। মাঠে–ঘাটে যেকোনো খোলা জায়গায় এই কনটেইনার অস্থায়ী স্থাপনা হিসেবে নির্মাণ করা যায়। এটা হাসপাতালের অস্থায়ী ক্যাম্পিংয়ের মতো। এই অস্থায়ী হাসপাতালের প্ল্যানিংয়ে একটি কেন্দ্র ঠিক করতে হবে, যেখান থেকে পূর্ণ ব্যবস্থাপনার কাজটি হবে। ওই কেন্দ্র থেকে তিনটি উইং থাকবে। প্রতিটি উইংয়ের দুই ধারে পাঁচটি করে কনটেইনার থাকবে, অর্থাৎ উইংপ্রতি কনটেইনার ১০টি। ৩টি উইংয়ে মোট কনটেইনার ৩০টি অর্থাৎ আইসিইউ বেড থাকবে ৬০টি। বেডের সংখ্যা কম বা বেশি প্রয়োজন হলে উইংয়ের সংখ্যা কমিয়ে বা বাড়িয়ে এবং উইংয়ের দুই ধারে কনটেইনারের সংখ্যা কমিয়ে বা বাড়িয়ে ঠিক করা যায়। প্রয়োজনমতো ২টি, ৫টি, ১০টি, ২০টি, ৩০টি, ৬০টি, ১০০টি আইসিইউ বেডসংবলিত অস্থায়ী হাসপাতাল নির্মাণ করা সম্ভব।

কোভিড-১৯ রোগীর জন্য সেবা দিতে এই অস্থায়ী স্থাপনা আবাসিক এলাকা ও সাধারণ হাসপাতাল থেকে দূরে নির্মাণ করা সহজ। সাধারণ হাসপাতালে এই রোগ ধরা পড়লে সঙ্গে সঙ্গে অ্যাম্বুলেন্সে করে রোগীকে এই অস্থায়ী কনটেইনার হাসপাতালে স্থানান্তর করতে হবে। প্রয়োজনে এই অস্থায়ী কনটেইনার হাসপাতাল অন্যত্র বদলি করা যায়। একটি শহরের বিভিন্ন এলাকায় বা অন্য কোনো শহরে সড়কপথে, নৌপথে ও রেলপথে কনটেইনারগুলো স্থানান্তর করা যায়। এমনকি প্রয়োজনে অন্য কোনো দেশেও স্থানান্তর করা সম্ভব। ঢাকার বাইরে দেশের কোনো অঞ্চলে হঠাৎ কোভিড-১৯ রোগীর সংখ্যা বেড়ে গেলে এই কনটেইনার হাসপাতাল সেখানে নিয়ে গিয়ে সেবা দেওয়া সম্ভব হবে।

এক একটি কনটেইনারে যে দুটি আইসিইউ বেড স্থাপন করতে হবে, তার সঙ্গে স্বভাবত সব রকমের সুবিধা থাকতে হবে। অস্থায়ী পদ্ধতির হাসপাতাল হলেও বিদ্যুৎসহ সব ধরনের ব্যবস্থা, যা একটি আইসিইউ বেডের জন্য দরকার, তা থাকতে হবে। কনটেইনার, বেড ও অন্যান্য সরঞ্জাম পারতপক্ষে দেশে তৈরি করা যেতে পারে। বর্তমান সংকটকালে অন্য দেশের ওপর নির্ভর করা বাস্তবসম্মত না–ও হতে পারে। এই কনটেইনার পদ্ধতির আইসিইউ বেডের বিভিন্ন সুবিধার মধ্যে একটি হলো কনটেইনারে দুটি বেড নিয়ে ভ্রাম্যমাণ অবস্থায় সেবা দিতে পারা। তবে অবশ্যই সেই সেবা রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে থাকতে হবে, বিশেষ করে ভাইরাসজনিত রোগীর ক্ষেত্রে। দেশে যেসব সাধারণ হাসপাতাল আছে, তার মালিকেরাও ইচ্ছা করলে এই কনটেইনার হাসপাতাল নির্মাণ করে দেশের এই সংকটকালে সেবা দিতে পারেন। তাঁদের মালিকানায় থাকা সাধারণ হাসপাতালে কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হলে তাঁদেরই মালিকানায় দূরে অবস্থিত কনটেইনার হাসপাতালে সেই রোগী পাঠিয়ে দিতে পারেন। তা হলে তাঁদের সাধারণ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা অন্যান্য রোগী আতঙ্কিত হবেন না। চিকিৎসক ও নার্সদের ক্ষেত্রেও সাধারণ ও কোভিড-১৯ রোগীর সেবাদান আলাদা ব্যবস্থাপনায় করা সহজ হবে। দেশের সরকারি হাসপাতালের জন্য এমন কনটেইনার হাসপাতাল কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করে দিতে পারে, যা মূল হাসপাতাল থেকে দূরে থাকবে এবং নিয়ন্ত্রণের ভার থাকবে মূল হাসপাতালের ওপর।


ড. আলী আকবর মল্লিক কাঠামো প্রকৌশলী ও ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ