করোনা যেন অপরাধীদের জন্য আশীর্বাদ না হয়

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

করোনা রোগী আছে কি না, তা তল্লাশির নামে একদল যুবক একটি মেয়েকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করেছে। পুলিশ দোকান বন্ধ করতে গিয়ে ক্যাশবাক্সে হাত দিয়েছে। স্থানীয়ভাবে সংগঠিত অপরাধীরা নানা ধরনের সরকারি কর্মকর্তার ছদ্মবেশে মানুষের বাড়িঘরে ঢুকবে। হয়তো বলবে, ‘আমরা হাসপাতাল থেকে এসেছি। আপনাদের করোনা পরীক্ষা করতে হবে।’ নয়তো বলবে, ‘আমরা পুলিশ বিভাগের সদস্য। আপনার বাড়ি থেকে তাৎক্ষণিক সাহায্য চেয়ে ফোন পেয়ে এসেছি।’ বাড়ির মালিক বা কোনো সদস্য হয়তো ফোন করেননি বলার আগেই বাড়ির দখল নেবে তারা। এমনও হতে পারে, পিৎজা বা অন্যান্য খাবার ডেলিভারি সার্ভিস সদস্যের ছদ্মবেশে আসবে। সরকারি সাহায্য নিয়ে এসেছে বলতে পারে। আরও বলতে পারে, ‘আপনাদের এলাকায় একজন করোনা রোগী পাওয়া গেছে। আপনাদের বাড়িঘর জীবাণুমুক্ত করতে এসেছি। আমরা নগর কর্মকর্তা’ ইত্যাদি। নানা রকম মিথ্যা আশ্বাসে মানুষকে বিভ্রান্ত করে মিথ্যা ওষুধ বা প্রতিষেধক ব্যবসাও শুরু করতে পারে। বিশেষ হাসপাতাল সেবা দেওয়ার মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করেও মানুষকে প্রতারিত করতে পারে।

‘মাফিয়া’রা কেমন আছে? করোনা কি তাদের অপরাধ নেটওয়ার্কেও আঘাত হেনেছে? ‘মাফিয়া’ শব্দটির সহশব্দ ইতালি ও সিসিলি। ইতালির প্রধানমন্ত্রী মৃত্যুর মিছিল ঠেকাতে পারছেন না। তিনি অশ্রু আটকাতে না পেরে শূন্যে মুখ তুলে বলেন, ‘আমাদের সব শক্তি-সাহস শেষ। এখন ওপরে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আমাদের কিছু করার নেই।’ করোনার আঘাতে জার্মানির অর্থমন্ত্রী হতাশা ও বিষণ্নতা রোগের কবলে পড়ে আত্মহত্যা করেছেন। এই অবস্থায় মাফিয়াচক্রও কি ওপরের সাহায্যের জন্য হাহাকার করছে? তারাও কি বেঘোরে মারা পড়ছে না?

উত্তর ‘না’।

সংগঠিত অপরাধী চক্রের একটি সাধারণ স্বভাব মৃত্যুকে পরোয়া না করা, ভয় না পাওয়া। এ কারণে দুর্যোগ অপরাধীদের জন্য সুযোগের কাল। সের্গিও নাজারো ইতালির মাফিয়াবিরোধী সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যান। তাঁর মত ছেপেছে ফোর্বস ম্যাগাজিন। নাজারোর একটি উক্তি ছিল, ‘মাফিয়া একটি করোনাভাইরাস। যেখানেই থাকো না কেন, তোমাকে তারা পাবেই।’ ফোর্বস ম্যাগাজিনের সঙ্গে কুখ্যাত ক্যাপো কার্টেলের শীর্ষ নেতা মাইকেল ফ্রাঞ্জেসেও কথা বলেছে সম্প্রতি। ফ্রাঞ্জেসের সাফ কথা, ‘এটাই তো পাক্কা সুযোগের সময়। আমার বর্তমান ও পুরোনো সঙ্গীরা এখন রাস্তায়। তারা ব্যস্ত মানুষকে ধোঁকায় ও ফাঁদে ফেলার কাজে।’

এই সময়টিতে বিপন্ন মানুষের সব মনোযোগই করোনার দিকে। ব্যাংক, বিমা, সঞ্চয়, জমিজিরেত, সম্পদ ইত্যাদির চিন্তা জীবনের চিন্তা, সংসার-সন্তান-পরিজনের চিন্তার কাছে তুচ্ছ। ফলে অপরাধী চক্রের অপরাধ-জাল আরও বিস্তৃত করার মোক্ষম সময় এটি। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট হ্যাকিং, অন্যের ব্যক্তিগত পরিচিতি ও তথ্য চুরি, মিথ্যা ভয় দেখানো, অপহরণ, মুক্তিপণ দাবি, জাল নোট ছাপা, ইত্যাদি নানা ধরনের প্রতারণাসহ মানুষকে বিপদে ফেলা ও নিঃস্ব করার প্রক্রিয়ায় তারা সারা বছরই সচেষ্ট থাকে। এই সময়টিতে মানুষের আবেগ, আতঙ্ক ও অসতর্কতা অনেক বেশি বলে তাদের অপরাধকর্ম চালিয়ে যাওয়া অনেক বেশি সহজ।

জেনেভায় জি-আইটিওসি নামে একটি অপরাধ-নির্মূলপন্থী গবেষণার পলিসি নির্ধারণের জন্য একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা আছে। বিশ্বের বিভিন্ন সদস্য দেশের সেরা ৫০০ অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও গোয়েন্দারা জি-আইটিওসির নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত। কদিন আগে অনুষ্ঠিত তাদের একটি সম্মেলনে উপস্থাপিত মূল প্রতিবেদনের বিষয় ছিল করোনা দুর্যোগের সুযোগে কী ধরনের অপরাধ বাড়তে পারে। প্রতিবেদনটির শিরোনাম ‘করোনা ও ছোঁয়াচে রোগ—সংগঠিত অপরাধের ওপর মহামারির প্রভাব’। এর মূল বক্তব্য হলো, করোনার সুযোগে অপরাধ অস্বাভাবিক মাত্রায় ও গতিতে বাড়বে। অবশ্য গাড়ি ছিনতাইয়ের মতো কিছু দৃশ্যমান অপরাধ পরিস্থিতির কারণে কমবে। পুলিশ ও সেনা নিরাপত্তা সড়কের অপরাধের জন্য বাধা হয়ে উঠবে।

আন্তর্জাতিকভাবে সংগঠিত অপরাধী গোষ্ঠীগুলো মনোযোগ দেবে তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক অপরাধের দিকে। যেমন স্টক মার্কেটে বারবার কারসাজি হবে। এতে নিঃস্ব হবে সাধারণ লগ্নিকারীরা, যাদের কারসাজি-সম্পর্কিত ধারণা ও সতর্কতার অভাব রয়েছে। ১৭ মার্চ বিখ্যাত অ্যান্টিভাইরাস নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ক্যাসপারস্কি বলেছে, হ্যাকাররা করোনার সুযোগে প্রতিদিনই নিত্যনতুন কম্পিউটার ভাইরাস ছড়াচ্ছে। ভাইরাসগুলোর বেশির ভাগেরই উদ্দেশ্য অর্থকরী হাতানো, ব্যক্তিগত তথ্য চুরি করা, ব্ল্যাকমেল করা ইত্যাদি। অস্ট্রেলিয়া, অস্ট্রিয়া ও কানাডায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নামে ভুয়া ই–মেইল পাচ্ছে কেউ কেউ। গোপনীয় মেডিকেল তথ্যগুলো প্রকাশ করে জরুরি ভিত্তিতে গোপনীয় করোনা পরীক্ষায় অংশ নিতে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে।

উন্নত, উন্নয়নশীলসহ সব দেশেই এই সময় নানা অপরাধ সংঘটিত হতে পারে। ১৮ কোটি মানুষের দেশ বাংলাদেশে পুলিশ বা জননিরাপত্তা বিভাগের এ–সংক্রান্ত কোনো প্রস্তুতি আছে কি? আমাদের চোখে অন্তত তেমন কিছু পড়েনি। আমরা দেখতে পাচ্ছি, এসব বিভাগের সমস্ত মেধা, শক্তি ও সামর্থ্য গুজব সৃষ্টিকারীদের চিহ্নিত করার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। কিন্তু কেন? অপরাধ বেড়ে গেলে সমাজব্যবস্থার খোল নলচে সবকিছু যত সহজে নড়বড়ে হয়ে যাবে, তথাকথিত গুজবের মাধ্যমে তার ছিটেফোঁটাও হয় না। বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থায় নিরাপত্তার ধারণা প্রায় অনুপস্থিত। সরকারি কর্মকর্তা বা পুলিশ বা সেনাবাহিনী পরিচয়ের কেউ এলে সাহস করে তাদের পরিচয় জানতে চাইবে বা ঘরে ঢুকতে বাধা দেবে—এমন সাহস সাধারণ মানুষের নেই। নিরাপত্তা বিষয়ে তাদের ভরসার বিশেষ কোনো জায়গা নেই। সে জন্য বাংলাদেশে অপরাধঝুঁকি অন্যান্য দেশের চেয়ে অনেক বেশি।

গত কয়েক দিনের পত্রপত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছে বেশ কিছু অপরাধের খবর। অর্থাৎ জি-আইটিওসির পূর্বাভাস অনুযায়ী অপরাধীদের সক্রিয়তা এই দেশেও শুরু হয়েছে। কয়েকটি খবরের শিরোনাম, এক, ‘পুলিশের ভুয়া পরিচয়ে হুমকি, জনতার হাতে আটক ২’। অপরাধীরা দোকান বন্ধ করার নাম দিয়ে এবং কার কার ঘরে কতটা খাবারদাবার মজুত করা হয়েছে পরীক্ষা করতে নেমেছে জানিয়ে চাঁদা আদায় শুরু করে। দুই, ‘করোনা তল্লাশির নামে কিশোরীকে অপহরণ, ধর্ষণ’ (ঢাকা টাইমস, ৩০ মার্চ)। তিন, করোনার ওষুধ বিক্রি প্রতারকদের। চার, নিজেকে করোনা রোগী দাবি করে চাঁদা দাবি। নইলে গায়ে থুতু দেওয়ার হুমকি। দেশের বিভিন্ন এলাকায় কয়েকটি বন্ধ দোকানে চুরির খবরও এসেছে কিছু স্থানীয় পত্রিকায়।

অবশ্য বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকা ও অনলাইন সংবাদমাধ্যমে খবর হয়েছে যে বাংলাদেশে অপরাধীরা লকডাউনের কারণে বা করোনার ভয়ে ঘরে ঢুকে গেছে। এ কারণে অপরাধ ব্যাপক হারে কমেছে। বিভিন্ন স্থানের থানার কর্মকর্তাদের বরাতে এসব তথ্য ছেপেছে পত্রিকাগুলো। এতে মনে হয় থানা-পুলিশ বেশ তুষ্ট এবং বিষয়টি স্বস্তির। প্রকৃতপক্ষে বিষয়টি অস্বস্তির ও বিপদের। লকডাউন বা হোম কোয়ারেন্টিন বন্ধ হয়ে গেলে পেশাদার অপরাধীরা গৃহবন্দিত্বকালীন আয়-উপার্জনহীন দিনগুলোর ক্ষতি পুষিয়ে নিতে চাইবে। ফলে এখন সন্তুষ্টির বদলে সতর্কতা ও আগাম প্রস্তুতি বেশি দরকার। করোনার বিপদ যত দীর্ঘায়িত হবে, নানা রকম অপরাধের ঝুঁকিও ততই বাড়বে। অপরাধী দমনের যথাযথ প্রস্তুতি এখনই না নেওয়া হলে আগামী দিনগুলো হয়ে উঠতে পারে অপরাধীদের জন্য আশীর্বাদ আর সাধারণ মানুষের জন্য অভিশাপ। তা যেন না হয়।

হেলাল মহিউদ্দীন: অধ্যাপক, সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ, পলিটিক্যাল সায়েন্স অ্যান্ড সোসিওলজি; নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়