করোনা সংকটে বেসরকারি উদ্যোগ

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের ফলে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও এক অভূতপূর্ব সংকটের মুখোমুখি হয়েছে। যদিও এখন পর্যন্ত শনাক্ত করোনা রোগীর সংখ্যা সরকারি হিসাবে খুব বেশি নয়, এবং যদিও এখন পর্যন্ত মৃত্যুর ঘটনা অন্য অনেক দেশের তুলনায় বেশ কম; তবু এ বিষয়ে নিশ্চিন্ত থাকার সুযোগ নেই। কারণ, বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, আর অল্প সময়ের মধ্যেই একসঙ্গে অনেক মানুষের মধ্যে করোনা সংক্রমণের লক্ষণগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠতে পারে এবং একসঙ্গে অনেক রোগীর সুচিকিৎসা নিশ্চিত করার প্রয়োজন হতে পারে। প্রতিবেশী ভারতে সর্বশেষ এক রাতে তিন শতাধিক ব্যক্তির করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার খবর আমাদের জন্য একটা আশু পূর্বাভাস হতে পারে। অর্থাৎ, আমরা এখন এক অভূতপূর্ব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। কারণ, অতিরিক্ত জনঘনত্বের এই দেশে এত উচ্চ মাত্রায় সংক্রামক কোনো ব্যাধি সামাল দেওয়ার অভিজ্ঞতা আমাদের নেই।

এই চ্যালেঞ্জ সাফল্যের সঙ্গে মোকাবিলার জন্য যে সক্ষমতা ও প্রস্তুতি প্রয়োজন, তা আমাদের সামান্যই রয়েছে। এখন পর্যন্ত করোনা রোগী শনাক্ত করা এবং তাদের চিকিৎসা দেওয়ার ব্যবস্থা প্রধানত সরকারি উদ্যোগের মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে। কিন্তু আমাদের স্বাস্থ্যসেবার সরকারি খাত দেশের পুরো জনগোষ্ঠীর মোট চাহিদার এক–তৃতীয়াংশের কিছু বেশি অংশ পূরণ করতে পারে। এ দেশে টোটাল হেলথ এক্সপেন্ডিচার (টিএইচএ) বা মোট স্বাস্থ্যব্যয়ের মাত্র ৩৪ শতাংশ আসে সরকারি খাত থেকে; বাকি ৬৬ শতাংশ ব্যয় নির্বাহ হয় রোগীদের পকেট থেকে। এই ৬৬ শতাংশের প্রায় পুরোটাই খরচ হয় বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা খাতে, যা লাভজনক একটি বাণিজ্যিক খাত।

বিশেষ কোনো রোগের ব্যাপক প্রাদুর্ভাব বা মহামারি ছাড়া সাধারণ পরিস্থিতিতেই যে সরকারি স্বাস্থ্য খাত জনসাধারণের পূর্ণ চিকিৎসা চাহিদা মেটাতে অক্ষম, মহামারির পরিস্থিতি সামলানো তার একার পক্ষে সম্ভব নয়। এ জন্য অবশ্যই বেসরকারি খাতকে এগিয়ে আসতে হবে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অনেক বড় বড় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে এই কাজে এগিয়ে এসেছে। রাজধানী ঢাকায় ও অন্যত্র অনেক বেসরকারি হাসপাতাল রয়েছে। করোনা সংকট মোকাবিলার কাজে সরকারি খাতকে সহযোগিতার জন্য তাদের অবিলম্বে এগিয়ে আসা উচিত। গণস্বাস্থ্য সংস্থা নামে একটি বেসরকারি সংস্থা করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরীক্ষার কিট তৈরির কাজে এগিয়ে এসেছে। আকিজ গ্রুপ নামের একটি ব্যবসায়ী গ্রুপ ঢাকার তেজগাঁওয়ে করোনা রোগীদের জন্য একটি হাসপাতাল স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে। বসুন্ধরা গ্রুপ সরকারের কাছে ৫ হাজার শয্যার করোনা হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দিয়েছে। বেসরকারি খাতে সরাসরি চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ বেসরকারি হাসপাতালগুলোরও এখন অবশ্যই এগিয়ে আসা উচিত।

করোনা রোগীদের পরীক্ষা করার বিষয়ে সরকারি কর্তৃপক্ষের সামর্থ্য–সক্ষমতার সীমাবদ্ধতা, শুরুর দিকে অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানকে পরীক্ষা করার অনুমতি না দেওয়া এবং রোগীদের চিকিৎসা সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য তথ্যের অভাব থাকায় করোনা সংকট মোকাবিলার ক্ষেত্রে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি পরিষ্কার নয়। বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে করোনা রোগীদের চিকিৎসা এবং এসব কার্যক্রম সম্পর্কে সঠিক ও হালনাগাদ তথ্য নিয়মিতভাবে সরবরাহ করার বিষয়ে সরকারের চিন্তাভাবনা স্বচ্ছ করা উচিত। সরকারি কর্তৃপক্ষের নেতৃত্বে বা তত্ত্বাবধানে বেসরকারি চিকিৎসা খাতকে করোনা সংকট মোকাবিলায় যুক্ত করা আশু প্রয়োজন। বেসরকারি খাতকেও আপাতত ব্যবসা ও মুনাফার ভাবনা স্থগিত রেখে মানবতার স্বার্থে এগিয়ে আসতে হবে। সরকারি–বেসরকারি সব খাতের সম্মিলিত উদ্যোগ এখন অত্যন্ত জরুরি।