নারীর আপন ভাগ্য গড়ে তোলার সহযাত্রী

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান পেরিয়ে এ দেশের মানুষ যখন স্বাধীনতার জন্য উন্মুখ, পুরুষের পাশাপাশি নারীর পদচারণে রাজপথ মুখর, সেই প্রেক্ষাপটে ১৯৭০ সালের ৪ এপ্রিল প্রতিষ্ঠিত হয় নারীদের গণমুখী সংগঠন ‘পূর্ব পাকিস্তান মহিলা পরিষদ’। এর অঙ্গীকার ছিল নারী-পুরুষের সমতাভিত্তিক রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠা। মহিলা পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভানেত্রী ছিলেন কবি সুফিয়া কামাল এবং সাধারণ সম্পাদক মালেকা বেগম। তাঁদের সঙ্গে আরও একঝাঁক লড়াকু নারী যুক্ত হয়েছিলেন।

এই সংগঠনের সদস্যরা মহিলা সংগ্রাম পরিষদের ব্যানারে উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে যেমন বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছিলেন, তেমনি সত্তরের ঘূর্ণিঝড়ে বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। সর্বোপরি তাঁরা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশ নিয়েছেন।

স্বাধীনতার পর ‘পূর্ব পাকিস্তান মহিলা পরিষদ’ রূপান্তরিত হয় ‘বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ’–এ। এই রূপান্তর কেবল নামের নয়, সংগঠনটি সত্যিকার অর্থেই নারী-পরুষের সমতাভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের দুরূহ ও দুর্গম পথচলা শুরু করে। মহিলা পরিষদই প্রথম সংসদে সরাসরি ভোটে নারী সদস্যদের নির্বাচন করার দাবি জানিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছিল।

মহিলা পরিষদ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যের কথা বলতে গিয়ে মালেকা বেগম একটি নিবন্ধে লিখেছেন, ‘সাধারণ সম্পাদিকা হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় জেলায় জেলায়, পাড়ায় পাড়ায় সাধারণ নারীদের আকুলতা ব্যাকুলতা, কর্মস্পৃহায় অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম।’

যাত্রারম্ভ থেকে মহিলা পরিষদ ক্ষমতাশ্রয়ী সংগঠন না হয়ে এ দেশের নারী সমাজের আশা–আকাঙ্ক্ষার বাহক হতে চেয়েছিল। সেই লক্ষ্যে ৫০ বছর ধরে কাজ করে আসছে। ভবিষ্যতেও তাদের এ যাত্রা অব্যাহত থাকবে আশা করি। কবি সুফিয়া কামালের মৃত্যুর পর এর সভানেত্রী হয়েছিলেন নারী নেত্রী হেনা দাস। বর্তমানে আয়শা খানম ও মালেকা বানু সংগঠনের সভানেত্রী ও সাধারণ সম্পাদিকা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

রোকেয়ার ভাবাদর্শে লালিত ও সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত মহিলা পরিষদ এমন সমাজের স্বপ্ন দেখেছে, যেখানে নারী-পুরুষের বৈষম্য থাকবে না। মহিলা পরিষদ মনে করে, নারীর অধিকার মানেই মানবাধিকার। তাঁদের গঠনতন্ত্র ও কার্যক্রম কখনো পুরুষদের চ্যালেঞ্জ করেনি; বরং পুরুষদের সঙ্গে নিয়ে তারা সংগ্রামকে চূড়ান্ত লক্ষ্যের দিকে নিয়ে যেতে চেয়েছে। তারা চ্যালেঞ্জ করেছে পুরুষতন্ত্রকে, সমাজের পশ্চাৎপদ চিন্তাকে। সমাজে, রাজনীতিতে ও অর্থনীতিতে নারীর সমান অংশীদারত্ব নিশ্চিত করবে। বাংলাদেশ উত্তরাধিকার সূত্রে অনেক বৈষম্যপূর্ণ ও নারী অধিকারবিরোধী আইন বহন করে আসছিল। মহিলা পরিষদ এসব আইনের সংস্কার ও বাতিলে দাবিতে আন্দোলন করেছে। তাদের এবং আরও অনেকের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বেশ কিছু আইন সংস্কার হয়েছে। নারী নির্যাতনবিরোধী আইন, যৌতুকবিরোধী আইন সংসদ পাস হয়েছে। কিন্তু আইন পাস হলেও এর যথাযথ প্রয়োগ নেই। এ কারণেই আমরা দেখি ধর্ষণ, গণধর্ষণ ও যৌন হয়রানির মামলায় মাত্র ৩ শতাংশ অভিযুক্ত ব্যক্তি শাস্তি পায়। বাকিরা আইনের ফাঁকফোকর কিংবা আইনের রক্ষকদের দুর্নীতি ও গাফিলতির সুযোগে পার পেয়ে যায়।

একটা সময় দেখা যেত, যেখানে নারীর প্রতি অন্যায় হচ্ছে, সহিংসতা হচ্ছে, মহিলা পরিষদের নেতৃত্ব ছুটে যেতেন। প্রতিবাদ করতেন। এখনো হয়তো করেন। কিন্তু ভাষাটা অনেক নরম হয়ে গেছে। এই নিষ্ঠুর সমাজে নরম ভাষায় প্রতিবাদ করে কিছু আদায় করা যায় না।

সাম্প্রতিক কালে ফেনীর নুসরাতের ঘটনায় দেশব্যাপী প্রতিবাদ হয়েছে বলে বিচার পেয়েছি। কিন্তু কুমিল্লার তনু বা চট্টগ্রামের মিতুসহ অনেক হত্যারই বিচার হয়নি। বিচারহীনতাই নারীকে আরও অনিরাপদ অবস্থানে নিয়ে যায়।

স্বাধীনতা আমাদের রাজনৈতিক রূপান্তর ঘটিয়েছে, আমরা একটি স্বাধীন দেশ পেয়েছি; কিন্তু সেই রূপান্তর সমাজে খুব বেশ বেশি প্রভাব ফেলতে পারেনি। ধর্ম, পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি, কুসংস্কার, সেকেলে চিন্তা নারীর সামনে চলার পথে এখনো বড় বাধা। নারী শিক্ষার হার বেড়েছে। কর্মক্ষেত্রে তার অংশগ্রহণ বেড়েছে; কিন্তু নিরাপত্তাহীনতা কমেনি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেটি ভয়ংকর হয়ে উঠেছে।

রাষ্ট্রের ওপর কাঠামোয় পরিবর্তন এসেছে, দেশের প্রধান নির্বাহী নারী, বিরোধী দলের নেতা নারী, জাতীয় সংসদের স্পিকার নারী। প্রশাসনের দায়িত্বশীল পদে নারীরা আছেন, সেনাবাহিনী ও পুলিশের উচ্চপদেও তাঁরা সমাসীন। কিন্তু এসব পদায়ন নারী সমাজের অগ্রগতির ধারক না হয়ে দৃষ্টান্ত হয়েছে। দেশের দুই প্রধান দলের শীর্ষ পদে দুজন নারী থাকা সত্ত্বেও রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে এখনো নারীরা অনেক পিছিয়ে। স্থানীয় সরকার তথা ইউনিয়ন পরিষদ থেকে পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন পর্যন্ত সরাসরি ভাটে এক-তৃতীয়াংশ নারী সদস্য নির্বাচনের বিধান থাকলেও জাতীয় সংসদে সেই সুযোগ দেওয়া হয়নি। প্রশাসন থেকে উচ্চবিচারালয়ে যদি নারীরা কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখতে পারে, জাতীয় সংসদে নয় কেন? মহিলা পরিষদ সরাসরি ভোট এক-তৃতীয়াংশ আসনে নারী সদস্য নির্বাচনের একটি রূপরেখাও সরকারের কাছে দিয়েছিল। কিন্তু রাষ্ট্র চলেছে আগের নিয়মেই।

বাংলাদেশের সংবিধান বলছে, আইনের চোখে নারী ও পুরুষ সমান। কোনো বৈষম্য করা যাবে না। কিন্তু এখনো অনেক বৈষম্যপূর্ণ আইন আছে। মহিলা পরিষদ আশির দশক থেকে জাতিসংঘ প্রণীত নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য বিলোপের সনদের (সিডও) পূর্ণ অনুমোদন ও বাস্তবায়নের দাবিতে আন্দোলন করে আসছে। এখানেও রাষ্ট্রযন্ত্র নীরব। কখনো তারা ধর্মের দোহাই দিয়ে, কখনো সমাজে অসন্তোষ হবে—এই ধুয়া তুলে সিডওর দুটি ধারার অনুমোদন ঠেকিয়ে রেখেছে।

আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৯৭ সালে নারী উন্নয়ন নীতিমালা প্রণয়ন করলে এ দেশের নারী সমাজ আশান্বিত হয়েছিল। মহিলা পরিষদসহ বিভিন্ন নারী সংগঠন সেই নীতিমালার প্রতি দৃঢ় সমর্থন ব্যক্ত করার পাশাপাশি আইন প্রণয়ের দাবি জানিয়েছিল। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এসে নারী উন্নয়ন নীতিমালার অনেক ধারা বাতিল করে দেয়। এরপর ২০১০ সালে আওয়ামী লীগ নতুন করে নারী উন্নয়ন নীতিমালা জারি করে। এই নীতিমালার প্রতি প্রগতিশীল শক্তি সমর্থন জানালেও ধর্মান্ধ গোষ্ঠী ফের মাঠ গরম করার চেষ্টা করে। সরকার পিছু হটে। এখন নারী উন্নয়ন নীতিমালা নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য নেই। আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করলাম, হেফাজতে ইসলাম নামে একটি সংগঠনের আবদারের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার ২০১৬ সালের মাধ্যমিক পাঠ্যবই থেকে অনেক প্রগতিশীল লেখক-কবির লেখা বাদ দিয়েছে। মহিলা পরিষদসহ বিভিন্ন সংগঠন এর প্রতিবাদ করলেও কাজ হয়নি। মৌলবাদ-জঙ্গিবাদবিরোধী আওয়ামী লীগ প্রগতিশীল লেখক–বুদ্ধিজীবীর আপত্তি উপেক্ষা করে হেফাজতের পরামর্শ আমলে নিয়েছে।

মহিলা পরিষদ তার গঠনতন্ত্রে পেশাদারি দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে সংগঠনের নেতৃত্বে বিকাশ নিশ্চিত করা, সংগঠনকে শহর ও গ্রামপর্যায়ে (তৃণমূল) বিস্তৃত করা এবং একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জকে সামনে রেখে বহুমুখী কর্মসূচি গ্রহণের কথা বলেছে। কৃষক নারী, শ্রমিক নারী, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ও পেশাজীবী নারীদের সংগঠিত করার বিষয়েও তারা অঙ্গীকারবদ্ধ। কিন্তু ঘোষণা ও অঙ্গীকারের সঙ্গে বাস্তবায়নের মধ্যে যেসব সময় মিল থাকে না, সেটিও মহিলা পরিষদকে মনে রাখতে হবে।

নারী নির্যাতন প্রতিরোধ ও নির্মূল কাজের অংশ হিসেবে মহিলা পরিষদ ১৯৮৩ সালে রোকেয়া সদন প্রতিষ্ঠা করে। এই প্রতিষ্ঠান অগণিত দুস্থ ও নির্যাতিতা নারীকে আশ্রয় দিয়েছে, আইনি লড়াইয়ে সহযোগিতা করেছে। যাঁরা জীবন সম্পর্ক আশা হারিয়ে ফেলেছিল, ফের তাঁদের বাঁচার শক্তি জুগিয়েছে। একটি সংগঠন পুরো সমাজ বদলাতে পারে না। সে জন্য সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন। কিন্তু একটি অন্যায়ের প্রতিকার কিংবা একজন পিছিয়ে পড়া মানুষকে সামনে এগিয়ে নেওয়া অনেক কাজ বলে মনে করি। ছোট ছোট জলকণাই সমুদ্র গড়ে তোলে। রোকেয়া সদনের কর্মপরিধি আরও বাড়ানো প্রয়োজন। মহিলা পরিষদ রোকেয়াচর্চাকে তৃণমূল পর্যায়ে ছড়িয়ে দিতে পারলে সমাজের অন্ধকার অনেকটাই দূর হবে।

মহিলা পরিষদ যে সমতাভিত্তিক সমাজ চেয়েছিল, তা থেকে বাংলাদেশ তখনো অনেক দূরে ছিল, এখনো দূরে। এ কারণে মহিলা পরিষদের কাছে নারী সমাজের প্রত্যাশাও বেশি। সংগঠনটি নারীর প্রতি সহিংসতা, অন্যায় বা অবিচারের কতটি ঘটনার প্রতিকার করতে পেরেছে, তার চেয়ে অনেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো আন্দোলন–সংগ্রামের মাধ্যমে নারী সমাজের মধ্যে আশা জাগিয়ে রাখা। অধিকসংখ্যক নারীকে সংগঠনের কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করা।

সাধারণ মানুষ মহিলা পরিষদকে এনজিও হিসেবে দেখতে চায় না, দেখতে চায় একটি আন্দোলনমুখর প্রতিষ্ঠান হিসেবে। নারীর আপন ভাগ্য গড়ার সহযাত্রী হিসেবে। মহিলা পরিষদ হোক বাংলাদেশের আন্দোলনকামী প্রতিটি নারীর পথচলার সঙ্গী।

মহিলা পরিষদ নারীর বিপদে পাশে দাঁড়াক, ভয়কে জয় করার সাহস জোগাক, এটাই সুবর্ণজয়ন্তীর প্রত্যাশা।