শুধু উপসর্গযুক্ত ব্যক্তিদের পরীক্ষা করা বিরাট ভুল

মোজাহেরুল হক।
মোজাহেরুল হক।
>

মোজাহেরুল হক। লন্ডন হসপিটাল মেডিকেল কলেজ থেকে লিগ্যাল মেডিসিন ও ডান্ডি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেডিকেল এডুকেশনে স্নাতকোত্তর। মহাখালীর ইনস্টিটিউট অব পাবলিক হেলথ এবং সেন্টার ফর মেডিকেল এডুকেশনের সাবেক পরিচালক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের সাবেক উপদেষ্টা।সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিজানুর রহমান খান

প্রথম আলো: করোনা মোকাবিলায় এই মুহূর্তে কোন পদক্ষেপটিকে আপনি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন?

মোজাহেরুল হক: সবার মাস্ক পরানো নিশ্চিত করতে হবে।

প্রথম আলো: কিন্তু এই মতও আছে যে ডাক্তার–নার্স ছাড়া অন্যদের মাস্ক পরার দরকার নেই।

মোজাহেরুল হক: মাস্ক পরার পক্ষে আমার যুক্তিটা শুনুন। প্রথম কথা হলো করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়ায় কীভাবে। এটা মানুষের মাধ্যমেই সংক্রমিত হয়। যে আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে রোগের উপসর্গ প্রকাশ পাবে, শুধু তিনিই অন্যদের যে সংক্রমিত করবেন, তা নয়। কারণ, সব সংক্রমিত ব্যক্তির উপসর্গ দৃশ্যমান হয় না। অধিকাংশ সংক্রমিত ব্যক্তি একটি পর্যায় পর্যন্ত জানবেনই না যে তিনি সংক্রমিত হয়েছেন। সুতরাং এ রকম উপসর্গহীন ব্যক্তির সংস্পর্শে গেলে, ঘনিষ্ঠ দূরত্বে কথাবার্তা বললে, তাঁর মাধ্যমে আমি বা আপনি সংক্রমিত হতে পারেন। তাহলে আমাকে কী করতে হবে? আমি তো জানি না কে সংক্রমিত, কে নয়। এই যুক্তিতে সবাই মাস্ক পরলে কিছুটা ঝুঁকি এড়ানো সম্ভব।

প্রথম আলো: রোগী শনাক্ত করার জন্য পরীক্ষা যা চলছে, তা কি সন্তোষজনক?

মোজাহেরুল হক: র‌্যাপিড অ্যান্টিবডি টেস্ট বলে একটা পরীক্ষা আছে। তিন মিনিটের মধ্যে সম্ভাব্য রোগ নির্ণয়ে সহায়ক হতে পারে। আমরা কম খরচে এটা দ্রুততম সময়ের মধ্যে করতে পারি। কেউ বলবেন, এটার ফল ফলস (ভুয়া) হতে পারে। অবশ্যই পারে। কিন্তু তবু আমি এটা সুপারিশ করব। কারণ, বসে থাকার চেয়ে আমাদের যা সামর্থ্য তা নিয়েই কাজ করে যাওয়া উচিত। যেখানে যে যেটুকু সম্ভব, তা করতে হবে। শুধু পিসিআর দিয়েই উপসর্গযুক্ত ব্যক্তিদের পরীক্ষা করব, এই ধারণায় পরিবর্তন আনতে হবে। এটা একটা বিরাট ভুল।

প্রথম আলো: দেশের বিদ্যমান ল্যাবগুলোতে কি র‌্যাপিড অ্যান্টিবডি টেস্ট করার ব্যবস্থা আছে? এটা কি ব্যবহার করা হচ্ছে?

মোজাহেরুল হক: যার শরীরে যে রোগজীবাণু ঢুকুক না কেন, প্রাকৃতিক নিয়মে তার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের একটা প্রক্রিয়া তৈরি হয়। চিকিৎসাবিজ্ঞানের পরিভাষায়, এটাই অ্যান্টিবডি। করোনাভাইরাস যার শরীরে ঢুকবে, তার শরীরেও অ্যান্টিবডি তৈরি হবে। সে যুদ্ধ করবে, জয়ী হবে কি হবে না, সেটা পরের কথা। কিন্তু অ্যান্টিবডি তৈরি হবেই। সুতরাং এই পরীক্ষা থেকে একটা ধারণা পাওয়া যাবে। আর যার অ্যান্টিবডি পজিটিভ পাওয়া যাবে, তাকে পিসিআর পদ্ধতিতে পরীক্ষা করিয়ে নিশ্চিত হওয়া যাবে। সেই সময় পর্যন্ত তাকে আইসোলেট করে স্বেচ্ছা কোয়ারেন্টিনে রাখা যায়। বা ওই ব্যক্তি নিজে থেকেই বিচ্ছিন্ন থাকতে পারে। সুতরাং সরকার এটা একটা কৌশল হিসেবে নিতে পারে।

প্রথম আলো: আর কোনো বিষয়ে গুরুত্ব দেবেন?

মোজাহেরুল হক: কত লোক সামনে পিসিআর পরীক্ষার আওতায় আসবে, তার একটা সংখ্যা তার মাথায় থাকতে হবে। সব উপজেলায় এখনই প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিন চালু করতে হবে। নতুন যারা আসবে, তারা সেখানে যাবে। আমার ব্যক্তিগত ধারণা, বর্তমানে যে সামাজিক সংক্রমণ ঘটছে, তাতে পিসিআর দিয়ে পরীক্ষা করানোর মতো ব্যক্তির সংখ্যা ৫ লাখে পৌঁছাতে পারে। এদের মধ্যে
প্রায় ৮২ শতাংশ বাসায় চিকিৎসা নিয়ে বা না নিয়েই ভালো হয়ে যাবে। তাদের অনেকের মধ্যে জ্বর বা কাশির মতো কোনো উপসর্গও দেখা যাবে না। বাকি ১৮ শতাংশকে আইসোলেশনে নিতে হবে। তাদের আইসিইউতে রাখা বা ভেন্টিলেটরের সুবিধার আওতায় রাখতে হবে।

প্রথম আলো: স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক হাবিবুর রহমান বুধবার বলেছেন, আগের ২৪ ঘণ্টায় ১৫৭ জনের নমুনা পরীক্ষায় ৩ জনের সংক্রমণ ধরা পড়েছে। আইসোলেশনে রাখা হয়েছে ৭৩ জনকে। তারপর প্রতিদিন ১ হাজার নমুনা সংগ্রহের নির্দেশ এসেছে। এটাকে এই মুহূর্তের সক্ষমতা ধরে নিলে সম্ভাব্য চিত্রটি কী দাঁড়ায়?

মোজাহেরুল হক: দক্ষিণ কোরিয়ার স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন, তাঁরা এখন প্রতিদিন ২০ হাজার লোকের পরীক্ষা করছেন। দক্ষিণ কোরিয়া অন্যতম সাফল্য অর্জনকারী দেশ। কিন্তু আমাদের দৈনিক ২০ হাজার লোকের পরীক্ষার সামর্থ্য নেই। এটা সুখবর যে আমরা ২৮টি স্থানে ল্যাব চালু করতে যাচ্ছি। এ জন্য ল্যাব টেকনিশিয়ানদের প্রশিক্ষণ দরকার। প্রতিটি ল্যাব ১০০ করে নমুনা পরীক্ষা করলে প্রতিদিন ২ হাজার ৮০০ লোকের নমুনা পরীক্ষা সম্ভব হবে। এর মাধ্যমে একটা বড় পরিবর্তন সূচিত হতে পারে। কিন্তু আমাদের বড় ভুল, সেটা হলো উপসর্গ দেখা না দিলে আমরা পরীক্ষা করছি না।

প্রথম আলো: স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বুধবার সংবাদ সম্মেলনে করোনাভাইরাস সংক্রমণের উপসর্গ আছে এমন ব্যক্তিদের পরীক্ষা করতে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন।

মোজাহেরুল হক: এই ভুলের কথাই বলছি। ওপরে যে ৮২ শতাংশের কথা বললাম, তারা তো জানবেই না যে তাদের করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঘটেছে। তারা তো অন্যদের মধ্যে সংক্রমণ ছড়িয়ে চলতে পারে।

প্রথম আলো: ব্যক্তিপর্যায়ে কী করণীয়?

মোজাহেরুল হক: যদি পরীক্ষার সুযোগ ও তার সহজলভ্যতা থাকে, তাহলে মানুষ নিজ থেকেই পরীক্ষা করাবে। তবে প্রাথমিকভাবে মানুষ যেন অ্যান্টিবডি টেস্ট করায়, সে বিষয়ে উদ্যোগী হতে হবে।   

প্রথম আলো: সরকারি হাসপাতালগুলোর প্রস্তুতি উল্লেখযোগ্য নয়। বেসরকারি হাসপাতালগুলো নিষ্ক্রিয়, তারা রোগী ফিরিয়ে দিচ্ছে। এর অবসান হবে কীভাবে?

মোজাহেরুল হক: সরকারের উচিত হবে বেসরকারি হাসপাতালগুলোর সঙ্গে সরকারি–বেসরকারি অংশীদারত্ব গড়ে তোলা। কোভিড–১৯ নিয়ন্ত্রণের জন্য যা যা প্রয়োজন, প্রতিটি হাসপাতালে তার সবই থাকতে হবে। অ্যানাসথেটিক ও রেসপিরেটরি মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, সব হাসপাতালের প্রশিক্ষিত জুনিয়র চিকিৎসক, আইসোলেশন, আইসিইউ ও ভেন্টিলেটরের সঙ্গে যুক্ত থাকা সব নার্স ও পিসিআর পরীক্ষার জন্য সব ল্যাব টেকনিশিয়ান, ভেন্টিলেটরদের একত্র করতে হবে। অবিলম্বে শুরু করার জন্য ইউনাইটেড হাসপাতাল বা স্কয়ার হাসপাতালকে বেছে নেওয়া যেতে পারে।

প্রথম আলো: আপনি এক টিভি চ্যানেলে বলেছেন, বাংলাদেশে এই মুহূর্তে করোনাভাইরাসে মৃত্যুর হার সর্বোচ্চ। কীভাবে?

মোজাহেরুল হক: বয়স্ক ব্যক্তির মৃত্যুর হার বাংলাদেশে সর্বোচ্চ। ছয় আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে পাঁচজনের মৃত্যু ঘটেছে। আবার সার্বিকভাবে ৪৮ আক্রান্তের মধ্যে পাঁচজনের মৃত্যুও বিশ্বে সর্বোচ্চ মৃত্যুহার। বর্তমানে বৈশ্বিক মৃত্যুহার ৩ দশমিক ৪ শতাংশ। ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, ইতালি, যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, দক্ষিণ কোরিয়া ও মালয়েশিয়ায় মৃত্যুর হার ২ শতাংশের নিচে। বাংলাদেশে এটা ১০ দশমিক ৪১ শতাংশ।

প্রথম আলো: পটুয়াখালীতে একটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে তালা ঝুলতে দেখা যায়। অন্য বহু স্থানে মানুষ হাসপাতালে গিয়ে ফিরে আসছে। চিকিৎসার জন্য রোগীদের তিন–চারটি হাসপাতাল ঘুরতে হচ্ছে। তাহলে করোনা আরও বড় পরিসরে আঘাত হানলে গ্রামের মানুষের চিকিৎসার কী হবে?

মোজাহেরুল হক: দেশের সার্বিক স্বাস্থ্য অবকাঠামো বিবেচনায় নিয়ে বলতে পারি, সরকারের উচিত হবে আর্মি মেডিকেল কোরকে প্রস্তুত রাখা। শৃঙ্খলাপরায়ণ সেনাবাহিনীই পারবে জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে। সবশেষে বলব, আমাদের পুরো স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে কাজে লাগাতে হবে এবং আরও কর্মক্ষম ও কার্যকর করতে হবে। পাশাপাশি প্রয়োজন অধিকতর ভালো সমন্বয়। সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে এই যুদ্ধে আমাদের জয় নিশ্চিত করতে হবে।  

প্রথম আলো: ধন্যবাদ আপনাকে।

মোজাহেরুল হক: আপনাকেও ধন্যবাদ।