করোনার চেয়েও ক্ষুধা ভয়ংকর

নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ
নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ

বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও বিশেষজ্ঞরা আভাস দিচ্ছেন যে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোতে করোনাভাইরাস খুব বেশি ছড়াবে না। তাঁদের এই পূর্বাভাস সঠিক হলে বাংলাদেশের মানুষ করোনার থাবা থেকে অনেকটা রক্ষা পাবে। কিন্তু ভয়টা অন্যখানে। করোনা আমাদের আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে যে বড় অভিঘাত সৃষ্টি করেছে, তা থেকে উত্তরণের উপায় খুঁজে পাওয়া কঠিন। আরও কিছুদিন চলতে থাকলে অর্থনীতির কাঠামোটি একেবারে নড়বড়ে হয়ে পড়বে।

করোনা সংকট মোকাবিলায় সরকার প্রথমে ১০ দিন ছুটি ঘোষণা করে, পরে আরও সাত দিন বাড়িয়েছে। এই দীর্ঘ সময়ে কাজ হারানো গরিব মানুষগুলো কীভাবে বাঁচবেন? কোথায় যাবেন? সরকার তঁাদের গ্রামে গেলে পুনর্বাসন করার কথা বলেছে। কিন্তু অনেকের গ্রামে বাড়িঘরই নেই। নদীভাঙন কিংবা অন্য কোনো দুর্যোগে বাস্তুভিটাটুকু হারিয়ে শহরে ঠাঁই নিয়েছিলেন। বাংলাদেশে শ্রমজীবী মানুষের ৮৫ শতাংশ কাজ করেন অনানুষ্ঠানিক খাতে। আনুষ্ঠানিক খাতে মাত্র ১৫ শতাংশ। আনুষ্ঠানিক খাত অর্থাৎ শিল্পকারখানা বন্ধ থাকলে হয়তো সরকার বা মালিকপক্ষ কিছুদিন মজুরি দেবে। কিন্তু অনানুষ্ঠানিক খাতের লাখ লাখ শ্রমিকের সেই সুযোগ নেই। ২৬ মার্চ থেকে তাঁরা কার্যত বেকার। নিরাপত্তার অজুহাতে বাড়ির মালিকেরা গৃহকর্মীদের বিদায় দিয়েছেন। গাড়ির চালক, হকার, মিস্ত্রিদের আবাসিক এলাকায় যেতে নিষেধ করেছেন।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার রাইটসের (বিলস) জরিপ অনুযায়ী, ঢাকা শহরে রিকশাচালক আছেন ১১ লাখ। এক-তৃতীয়াংশ রিকশাচালকের কোনো ভূমি নেই। ব্র্যাকের জরিপ বলছে, বস্তির ৪০ শতাংশ মানুষের জীবিকা অস্থায়ী ও তঁাদের বেশির ভাগই দিনমজুরি করেন। ২৬ মার্চের আগে মগবাজার মোড়ে প্রতিদিন সকালে দেখতাম জনাপঞ্চাশেক শ্রমিক কাজের অপেক্ষায় ভিড় জমাতেন। বাসাবাড়িতে যাঁদের টুকটাক কাজের প্রয়োজন হতো, তাঁরা নিয়ে যেতেন। কাজ শেষে মজুরি দিতেন। সেই মোড়ে এখন কোনো শ্রমিক আসেন না। স্বাভাবিক অবস্থায় ঢাকার যেকোনো সড়কে রিকশার জট লেগে যেত। এখন সড়ক একেবারে ফাঁকা। দু-একটি রিকশা থাকলেও যাত্রী নেই। কমলাপুর রেলস্টেশনে; মহাখালী, গাবতলী ও সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল কিংবা সদরঘাটে যে হকাররা এটা-ওটা বিক্রি করে কিছু আয় করতেন, এখন সেই উপায় নেই। অনেকে বলেছেন, কলা-রুটি খেয়ে দিন কাটছে। এরপর হয়তো ওই কলা-রুটি কেনার পয়সাও থাকবে না।

তৈরি পোশাক খাতে ৪৫ লাখ শ্রমিক কাজ করেন। সরকার তাঁদের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার সহায়তা তহবিল গঠন করেছে। পরিবহন খাতে কাজ করেন ৮০ লাখ শ্রমিক। তাঁদের সহায়তায় এখনো কেউ এগিয়ে আসেননি। যে নেতারা ইউনিয়নের নামে বাসের শ্রমিকদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করতেন, তাঁরাও নিশ্চুপ। এই খাতের বেশির ভাগ শ্রমিকই কাজ করেন ‘ঠিকা’ হিসেবে। ট্রিপ দিলে টাকা। ট্রিপ বন্ধ থাকলে টাকাও বন্ধ। দোকানে, রেস্তোরাঁয় যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের অবস্থাও এর থেকে ভিন্ন নয়। দোকান মালিক সমিতির দাবি, সারা দেশে ৯৭ লাখ ১৩ হাজার দোকান-কর্মচারী আছেন। সমিতি সরকারের কাছে ২০ হাজার কোটি টাকার তহবিল চেয়েছে। পোলট্রিশিল্পের সঙ্গে জড়িত যে ৪০ লাখ শ্রমিক, তাঁরাও বেকার হয়ে পড়েছেন। সরবরাহ বন্ধ তো উৎপাদনও বন্ধ।

চা-শিল্পে নিয়োজিত কয়েক লাখ শ্রমিকের জীবনও অনিশ্চিত। অনেক বাগানে মজুরি বকেয়া পড়েছে। কৃষিতে এখনই বড় অভিঘাত না পড়লেও বিপদে পড়েছেন দুধের খামারিরা। কেবল সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরেই ২৫ হাজার খামারি আছেন, যাঁরা দিনে ১০ লাখ টন দুধ উৎপাদন করতেন। পরিবহন বন্ধ থাকায় তাঁরা খামারিদের কাছ থেকে দুধ কিনতে পারছেন না। ফলে খামারিদের মাথায় হাত।

যাঁদের নিশ্চিত আয় আছে, তাঁরা ১৫ দিন থেকে এক মাস ‘ঘরবন্দী’ থাকলেও ক্ষতি নেই। কিন্তু গরিব মানুষগুলোর তো এক দিনও ঘরে থাকার উপায় নেই। এই রোজগার হারানো মানুষগুলোর কাছে করোনার চেয়েও ভয়ংকর হলো ক্ষুধা। এ কারণে কোথাও ত্রাণসামগ্রী দেওয়ার খবর পেলে তাঁরা হুমড়ি খেয়ে পড়েন। স্বাস্থ্যবিধির ধার ধারেন না।

চট্টগ্রাম শহরে ত্রাণের জন্য বিক্ষোভ হয়েছে। বুধবার নগরের জিইসি এলাকায় কয়েক শ মানুষ বিক্ষোভ করেছেন। তাঁরা সরকারি-বেসরকারি কোনো সংস্থা থেকেই ত্রাণসামগ্রী পাননি। কীভাবে পাবেন? কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) তথ্যমতে, চট্টগ্রামে সাড়ে ১৪ লাখ বস্তিবাসীসহ ৩০ লাখ মানুষ ত্রাণ পাওয়ার যোগ্য। সরকারিভাবে মাত্র সাড়ে ১৭ হাজার মানুষকে ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে। 

এই চিত্র কেবল চট্টগ্রামের নয়, সারা দেশের। গত মঙ্গলবার ঢাকা-১০ আসনের নবনির্বাচিত এমপি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন ব্যক্তিগত উদ্যোগে ডিএসসিসির ১৪ ও ১৫ নম্বর ওয়ার্ডে ত্রাণ বিতরণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। খবর পেয়ে বিপুলসংখ্যক অভাবী মানুষ সেখানে জড়ো হন। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা ঠিকই করতে পারেননি কাকে বাদ দিয়ে কাকে দেবেন। দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করে সাহায্যপ্রার্থীরা ফিরে যান। রাতে গলিতে গলিতে ঘুরে কিছু বাড়িতে ত্রাণসামগ্রী দেওয়া হয়েছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) পক্ষ থেকে প্রতিটি ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কাছে ৫০০ জন নিম্ন আয়ের মানুষের তালিকা চাওয়া হয়। তাঁরা তালিকাও দিয়েছেন। কিন্তু তালিকার বিপরীতে প্রয়োজনীয় ত্রাণসামগ্রী পৌঁছায়নি। একজন কাউন্সিলর বলেছেন, তাঁর ওয়ার্ডের এক কল্যাণপুর বস্তিতেই আছে ২ হাজার ৬০০ পরিবার। অথচ সিটি করপোরেশন ৫০০ জনের তালিকা দিতে বলেছে।  এই যদি আলো ঝলমলে ঢাকা শহরের অবস্থা হয়, দেশের অনন্য জায়গার চিত্রটা অনুমান করা কঠিন নয়। গড়ে একটি ইউনিয়নে দেড় টনের মতো ত্রাণসামগ্রী দেওয়া হয়েছে; যা দিয়ে দেড় শ মানুষকে ত্রাণ দেওয়া সম্ভব। বাকিদের কী হবে? 

বাংলাদেশে এখনো ২২ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। সংখ্যার হিসাবে প্রায় চার কোটি। মৌলিক চাহিদার অনেক কিছুই তাদের অপূর্ণ থেকে যায়। হাড়ভাঙা পরিশ্রমের বিনিময়ে কোনোরকমে খেয়ে-পরে বেঁচে থাকে। করোনা সংকট তাদের রোজগারের পথ বন্ধ করে দিয়েছে। সরকার যে পরিমাণ ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করছে, তাতে চাহিদার ২৫ শতাংশও মিটবে না। ৭৫ শতাংশ বঞ্চিত থেকে যাবে।

অবিলম্বে সরকারের ত্রাণ পরিকল্পনায় আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। যত দিন করোনা সংকট থাকবে, তত দিন কাজ হারানো সব অভাবী মানুষের কাছে চালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যগুলো পৌঁছাতে হবে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকার যদি প্রত্যেক মানুষকে ছয় মাস বিনা পয়সায় চাল দিতে পারে, আমরা কেন পারব না?

সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]