খগারহাটে পানির দরে কৃষকের জীবন

নীলফামারী জেলার ডিমলা উপজেলার খগারহাট বাজার। সপ্তাহে দুটি বারে হাট বসে। লোকে গিজগিজ করে। হাটবার ছাড়াও কম কিসে! কাঁচাবাজার, মাছ-মাংস, কাপড়, ওষুধের দোকান ছাড়াও আসে নিত্যনতুন ক্যানভ্যাসাররা। কেউ আসে জোঁকের বা সান্ডারের তেল নিয়ে, কেউ আসে স্বামী-স্ত্রীর মহব্বতবর্ধক সোলায়মানি তাবিজের ভান্ডার নিয়ে। কোনো ক্যানভাসার বা হকার বেচাকেনা কম হয়েছে বলে মুখ গোমড়া করে ফিরে গেছেন, এমন রেকর্ড অন্তত খগারহাট বাজারের নেই। খগারহাটে লোকের অভাব হয় না; কি সকাল, কি দুপুর, এমনকি রাত ১২টায়ও। এই বাজারে লোকসমাগম আর তাঁদের কর্মকাণ্ড দেখে যে কেউ দিন দশেক আগেও একে উন্নয়নের স্মারক ‘সচ্ছলতা’ বলে চালিয়ে দিতে পারতেন।

কেননা উন্নয়নের মানে এখানে বাজারে যাওয়া-আসার হিসাবের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া হচ্ছে বেশ কিছুদিন হয়। কিন্তু বাতাসভর্তি বেলুনের আকাশে ওড়ার পরিসংখ্যান দিয়ে আর যাই হোক বেলুনের ভরের হিসাব দেওয়া যায় না, বেলুনের ভর নির্ভর করে তার ভেতরে কতটুকু বাতাস সে ধারণ করতে পেরেছে, তার ওপর।

এই যেমন খগারহাটের একেবারে প্রধান রাস্তাসংলগ্ন চায়ের দোকানদার দোমাসুরের (ছদ্মনাম) কথাই ধরুন না; বেচারা মোটে পাঁচ হাজার টাকার মতো মূলধন খাটিয়ে ব্যবসা করে আসছিলেন। ঘরে বউ আর বাচ্চাকাচ্চা মিলে সাত-সাতটি পেটের অন্নের সংস্থান হয় ওই টুকু ক্ষুদ্র ব্যবসায়। দোমাসুকে কেউ ‘কেমন আছেন’ প্রশ্ন করলে হাসিমাখা জবাব আসত, চলছে আপনাদের দোয়ায়।

হ্যাঁ, চলছিল! দৈনিক তিন-চার শ টাকায়ও এ যুগে অনেকের পরিবার চলছেই তো। কিন্তু এখন গিয়ে দোমাসুকে প্রশ্ন করুন, ‘কেমন আছেন?’

কুশল বিনিময়ের এই সুযোগটা এখন ঘটবে তাঁর দোকানঘরের পেছন দিকের ভাঙা বেড়ার খানিকটা অংশ কেটে তৈরি করা নতুন দরজা দিয়ে ঢোকার পর। ‘কেমন আছেন?’ প্রশ্নের জবাবে দোমাসু এখন কুঁকড়ে যান, চোখ মিলিয়ে মৃদু কণ্ঠে যা আসবে, তাতে কেউ বুঝতে সক্ষম হতেও পারেন, না–ও হতে পারেন। আর যাঁরা দোমাসুর পরিবারের এতটুকু ইতিহাসের পাঠ কখনো জেনেছিলেন, তাঁরা তাঁর মুখাবয়ব দেখে সবটুকু বুঝে নেবেন।

স্থানীয় সরকারের চৌকিদার, মেম্বার, চেয়ারম্যানের চাপ, ওদিকে থানা-পুলিশের চাপ, সর্বোপরি ঘরে আবদ্ধ থেকে সুনাগরিক কিংবা স্বাস্থ্যসচেতন উপাধি লাভের চাপে জর্জরিত দোমাসু দোকানের সামনের ঝাঁপ খুলতে পারে না ২৬ মার্চের পর থেকে। কিন্তু ক্ষুধা, পেট, সংসারের কাছে এসব যে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা, তা দোমাসু মিয়াকে আবারও পরিস্থিতির ‘চোর’ বানিয়ে ছেড়েছে।

দোমাসু মিয়া এবার নিজেই নিজের ইজ্জত যেন চুরি করতে নেমেছেন; প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে দোকানে বসে থাকেন চোরের মতো। যেন দুটি টাকা এরই মধ্যেও বেচাকেনা হয়; অন্তত বউ-বাচ্চার মুখে মোটা চাল না হোক, একটু খুদও যেন জোটানোর কৃতিত্ব থেকে বঞ্চিত না হতে হয়।

মানবসংসারের আরেক নাম কি এই ‘কৃতিত্ব’ নয়?

খগারহাটে দোমাসু তো একজন নয়, গুনতে গেলে কিংবা তাঁদের খোঁজে নামলে তবেই যে কেউ দোমাসুদের সংখ্যার আধিক্যে হাল ছেড়ে দেবেন। আর না গুনলে কিংবা খোঁজ না রাখলে বাংলাদেশের মানচিত্রে দোমাসুরা হাওয়া হয়ে গেছে ধরে নিতে হবে।

এবার চলুন ডিমলার মরিচচাষিদের খেত কিংবা বাড়িতে যাই

খেতে গাছ আছে, মরিচ আছে, কৃষক আছে, আছে অভাব, আছে স্বপ্ন আরও অনেক কিছু...নেই শুধু মরিচের দাম! পোড়ামুখো, অসভ্য করোনা বাংলাদেশে ঢোকার আগেও মরিচ মণপ্রতি কৃষকেরা বিক্রি করতেন ১৩০০-১৪০০ টাকা। আর এখন? যেন পানির দর! ৩০০ থেকে সর্বোচ্চ ৪০০ টাকা মণ।

চৈত্র মাসের এমন দিনে পাটশাকের স্বাদে ভরপুর থাকে উত্তরবঙ্গের রান্নাঘরগুলো। তাই দামটাও থাকে চাহিদা-জোগানের সেই পুরোনো সূত্রের হাত ধরে। সপ্তাহখানেক আগেও এক জোড়া পাটশাকের আঁটি বিক্রি হচ্ছিল ২০ টাকায়। আর এখন ২০ টাকার পাটশাক বিক্রি করতে গেলে কৃষকের চোখ ভিজে যাচ্ছে।

শুধু কি মরিচ আর পাটশাক?

উত্তরবঙ্গের অগণিত কৃষক যা কিছু আবাদ করছেন মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, সন্তানের মতো স্নেহে—সবকিছু এখন পানির দরের চেয়ে নিম্নগামী। পুঁইশাক, লালশাকে অনেকে হিসাব মেলাতে চেয়েছেন সংসারের, এখন সেসব বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন চার-পাঁচ টাকা কেজি দরে। শসা কিছুদিন আগেও গ্রাম্য বাজারে ৩০ টাকার নিচে পাওয়া যেত না, এখন তিন-চার টাকায়ও ভোক্তা নাক সিটকাচ্ছেন। বেগুন গ্রাম্য বাজারে পাওয়া যাচ্ছে পাঁচ-ছয় টাকা কেজি দরে।

খগারহাটের আশপাশে অনেক ক্ষুদ্র কৃষক বেঁচে থাকার লড়াইয়ে দু-তিনটি করে দুধেল জাতের গাভিতে সবকিছু নিয়োজিত করে নিশ্বাস নেওয়ার বাড়তি সুযোগ খুঁজেছিলেন! কিন্তু শ্বাসরুদ্ধকর করোনা কিংবা তাঁর চেয়েও ভয়ংকর বাজার ব্যবস্থাপনার ত্রুটি তাঁদের সকালগুলোকে এখন সন্ধ্যা বানিয়ে ছেড়েছে। বাজার থেকে এক কিলোমিটার পূর্বে তেমনি এক কৃষক নালু মিয়ার (ছদ্মনাম) ঘরে দুটি উন্নত জাতের গাভি থেকে প্রতিদিন ২০ লিটার দুধ সংগ্রহ করা হতো। আশপাশের বাজারের চায়ের দোকানগুলোতে এই দুধ সরবরাহ করে চার সদস্যের পরিবারটির দিন গুজরান হতো।

দুধ থেকে গরুর খাদ্য কিনে অবশিষ্ট চালান যেত বউ-বাচ্চার জন্য; বেচারা আজ দুই সপ্তাহ ধরে ১৫-২০ টাকা দরে বাড়ি বাড়ি হাঁক ছাড়ছেন। এরপরও দৈনিক ১০ লিটারের বেশি দুধ ঘরেই থাকছে।

নালু মিয়ার সাদাসিধে বউ আজ আসন্ন দুর্ভোগের চিত্রপট কল্পনা করে একপ্রকার অবসাদে ভুগছেন। করোনাকে বিদায় নেওয়ার জন্য হাজারো দিব্যি দিচ্ছেন। তাতেও যখন কাজ হচ্ছে না, তখন করোনার চৌদ্দগুষ্টিকে উদ্দেশ করে অভিশাপ বর্ষণ করছেন ঘরে কিংবা বাইরে।

আজ উত্তরবঙ্গের এমন হাজারো দোমাসু কিংবা নালু মিয়ার মতো ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা কিংবা প্রান্তিক কৃষক চোখে শর্ষে ফুল দেখছেন। প্রশ্ন উঠবে, এ আবার নতুন কি? সারা বিশ্ব যখন দুর্যোগে নাকাল, তখন খগারহাট তো বিশ্ব মানচিত্রের বাইরে নয়।

এমন জুতসই প্রশ্ন, জিজ্ঞাসা, তির্যক মন্তব্য কিংবা দায় এড়ানোর কৌশলের কিবা জবাব আছে আমাদের পল্লিগাঁয়ের কৃষক, মুদিদোকানি কিংবা গোয়ালার। এমন প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মতো বিদ্যাজ্ঞান, শিক্ষা, ভাষা, সংগঠন, তেজ আমাদের নিম্ন আয়ের মানুষের নেই!

খরা, বন্যা, আগুন, পাহাড়ধস, কিংবা করোনাকে এদের কাছে সেই কবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছিল ন্যাচারাল ডিজাস্টার বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে! আর এসবের প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ আক্রান্তের তালিকায় তাঁরাই যে সিংহভাগ থাকবে, নানা তরিকায় এটাও যুগ যুগ থেকে বুঝিয়ে আসছিল সংশ্লিষ্ট দরবারের কর্তৃপক্ষ।

তাই এত দিনের সংস্কার ভেঙে, আমাদের কৃষক একবারও বলবেন না যে এগুলো (দুর্যোগ) কেন শুধু তাঁদেরই জ্বালায়, পোড়ায়, মারে? কে বলেছে ন্যাচারাল ডিজাস্টার বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিয়ন্ত্রণে মানুষের হাত ক্ষুদ্র থেকে অতি ক্ষুদ্র হয়েছে? বারবার প্রাকৃতিক কিংবা বৈশ্বিক সমস্যার কথা বলার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলো নিজেদের ব্যর্থতা, স্বার্থপরতা, অদক্ষতা আড়াল করছে না তো?

মাকাল ফলের মতো আমাদের ভেতরটাকে রেখে কেন আমাদের রঙিন বেলুনের মতো ফুলিয়ে ফুলিয়ে ওড়ানো হচ্ছে প্রতিনিয়ত? এসব প্রশ্ন আমাদের এখানে আসবে না, করতে আমরা চাইব না; যদিওবা করতে চায় কেউ, খুব হিম্মতের প্রয়োজন হবে।

প্রশ্নের দিকে না গিয়ে মুখস্থ উত্তর শোনার যে অভ্যস্ততায় মজে গেছি, আর ওদিকে হাজারো ছোট-বড় করোনাও প্রতিনিয়ত কুরে কুরে খাবে আমাদের মতো প্রান্তিক মানুষদের!

সেলিম রানা: নীলফামারী জেলার একজন খুদে উদ্যোক্তা ও কৃষক।