যে চার বিষয় এড়িয়ে এগোনো যাবে না

বাংলাদেশে করোনাভাইরাস পরিস্থিতির মাত্রা এবং তা মোকাবিলার ক্ষেত্রে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের প্রেক্ষাপটে চারটি বিষয় সুস্পষ্ট। এগুলো এড়িয়ে এখনকার অবস্থা এবং ভবিষ্যতে কী ধরনের পরিস্থিতি হতে পারে, তা বোঝা যাবে না। এগুলো হচ্ছে চিকিৎসাব্যবস্থা বা পাবলিক হেলথ কেয়ার সিস্টেম ভেঙে পড়া, প্রকৃত তথ্যের অভাব, অত্যন্ত স্বল্পসংখ্যক পরীক্ষা এবং অর্থনীতি বিষয়ে বাগাড়ম্বরের অসারতা।

সরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান বা পাবলিক হেলথ কেয়ার সিস্টেম, যার ওপরে বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ নির্ভর করে, তা কার্যত ভেঙে পড়েছে। লক্ষণীয় যে এর কারণ এই নয় যে বাংলাদেশে ইতিমধ্যে ব্যাপক আকারে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার ঘটনা শনাক্ত করা গেছে এবং যা মোকাবিলা করার মতো অবস্থা নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বিশেষ করে নিউইয়র্কে যা ঘটেছে, বাংলাদেশে তা হয়নি। এটা ভেঙে পড়েছে, কেননা এমনিতেই বাংলাদেশের পাবলিক চিকিৎসাব্যবস্থা অবহেলিত, দুর্বল। ধনী জনগোষ্ঠী যেহেতু কখনোই এই ব্যবস্থার ওপরে নির্ভর করেনি, সেহেতু এ নিয়ে কারোরই মাথাব্যথা হয়নি। তারা প্রাইভেট ক্লিনিকে গেছে অথবা বিদেশে। কিন্তু এটা অবশ্যম্ভাবী ছিল যে সরকারি বা পাবলিক সিস্টেমটা শক্তিশালী না হলে সামান্য চাপেই এটা ভেঙে পড়বে।

এখন কার্যত ভেঙে পড়েছে, কেননা ডাক্তারদের একটা বড় অংশ সরকারের দেওয়া তথ্যের ওপর ভরসা রাখতে পারছে না। প্রাইভেট হাসপাতালগুলো এমনকি সাধারণ রোগ, বিশেষ করোনাভাইরাসের উপসর্গ আছে তেমন লোকদের পর্যন্ত চিকিৎসা দিতে রাজি নয়। তার অন্যতম কারণ হচ্ছে বিপদের আশঙ্কা, আস্থার অভাব এবং সরকারের রোষানলে পড়ার ভীতি। অথচ দেশের অধিকাংশ প্রাইভেট হাসপাতালে বেড খালি আছে। বলা হচ্ছে যে এখন আর পিপিইর অভাব নেই কিন্তু রোগীরা আসছে না। আর অসুস্থদের কাছ থেকে জানা যাচ্ছে যে হাসপাতাল তাদের রাখছে না। এগুলো হচ্ছে শহরের খবর। ভয়াবহ অবস্থা হচ্ছে গ্রাম-গ্রামান্তরে। সেখানে সরকারি অপ্রতুল স্বাস্থ্যকেন্দ্রের পক্ষে এই অবস্থা মোকাবিলার উপায় নেই।

সরকারি ডাক্তাররা সরকারি ভাষ্যের ওপরে আস্থা রাখছেন না, এটা আমাদের বোঝা দরকার। গ্রামের স্বাস্থ্যকাঠামোর এই অবস্থা হবে, সেটা কি নীতিনির্ধারকেরা বুঝতে পারেননি? আমি তাঁদের যোগ্যতা বিষয়ে প্রশ্ন তুলতে নারাজ। দেশের ভেতরে যানবাহন চলাচল অব্যাহত রেখে কথিত ‘সাধারণ ছুটি’ ঘোষণার মাধ্যমে ঢাকা থেকে প্রায় এক-দেড় কোটি মানুষকে গ্রামের ও ছোট শহরের স্বাস্থ্যব্যবস্থার মধ্যে ঠেলে দেওয়ার কারণে কেবল যে কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের পথ উন্মুক্ত করা হয়েছে তা–ই নয়, তাদের অদৃশ্য করে ফেলা গেছে। রাজধানীতে উপস্থিত নাগরিকদের মধ্যে লোকজন আক্রান্ত হলে সেই সময়ে সরকারি এই বক্তব্য দেওয়া দুরূহ হতো যে গতকাল কেউ আক্রান্ত হয়নি। এই ছুটির সিদ্ধান্ত সেই কারণেই রাজনৈতিক বিবেচনাপ্রসূত এবং সরকারের বিব্রত না হওয়ার ব্যবস্থা মাত্র। এতে গ্রামাঞ্চলের স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপরে আরও চাপ তৈরি হয়েছে, মানুষ এখন ‘রোগে’ মারা যাচ্ছে না, ‘উপসর্গে’ মারা যাচ্ছে। আর এই মৃত্যুর সংখ্যা কত তা সবাই জানতেও পারছে না। এমন মনে করা কি একেবারেই অবাস্তব যে রাজধানীর হাসপাতালের চাপ কমালে ধনী ও প্রভাবশালীরা সহজেই চিকিৎসা পাবেন, এমন বিবেচনাও থাকতে পারে? কেননা এটা তো ঠিক, দেশে যে পাঁচ শ ভেন্টিলেটর আছে তার বড়সংখ্যক আছে ঢাকার হাসপাতালগুলোতেই।

সরকারের দেওয়া তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। সরকার ও নাগরিকদের দূরত্ব এত ব্যাপক যে তারা এমনকি জীবন–মৃত্যুর হিসাবের ব্যাপারেও আর সরকারের কথায় আস্থা রাখতে পারছে না। এটা কেবল জনস্বাস্থ্যের বিষয় নয়। দীর্ঘদিন ধরে জবাবদিহিহীন রাজনীতি ও শাসনের এটাই হচ্ছে অনিবার্য পরিণতি। অস্বচ্ছতা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে সরকারের বক্তব্যকে গ্রহণ করার উপায় ক্ষমতাসীনেরা রাখেননি। সরকার বলছে যে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা অত্যন্ত কম। কিন্তু গত কয়েক দিনের সংবাদমাধ্যমের খবরে দেখা যাচ্ছে, এ ধরনের কথার সঙ্গে বাস্তবের মিল সামান্যই।

সরকারের দেওয়া তথ্য নিয়ে কি প্রশ্ন করার সুযোগ আছে, যখন উচ্চপর্যায় থেকে বলাই হচ্ছে সবকিছু ‘স্বাভাবিক’ আছে? প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ভিডিও বৈঠকে রাজশাহীর বিভাগীয় কমিশনার বলেছেন, তাঁর বিভাগ ‘করোনামুক্ত’। সেখানে তখনো ব্যাপকভাবে পরীক্ষাও শুরু হয়নি; তবে তিনি বলেছেন, কীভাবে তিনি এই সাফল্য অর্জন করেছেন। তথ্যের অভাব মানে হচ্ছে মানুষের মধ্যে বিপদের মাত্রা বিষয়ে ধারণা তৈরিতে বাধা দেওয়া। তারা তাদের বিপদ বুঝতে পারবে না। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত পরীক্ষা হয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে কম। সর্বশেষ হিসাবে তা হাজার দুয়েকের চেয়েও কম। ইতিমধ্যে ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে বেশ কিছু জায়গায় পরীক্ষা শুরু হয়েছে। সরকার বলছে যে দেশে করোনাভাইরাস নির্ণয়ের জন্য কিটের সংকট নেই, কিন্তু তা সত্ত্বেও কেন এত স্বল্পসংখ্যক পরীক্ষা করা হচ্ছে এবং পরীক্ষা করতে বিভিন্ন ধরনের যাচাই–বাছাইয়ের ভেতর দিয়ে যেতে হচ্ছে? এগুলো থেকে এই ধারণাই জন্মায় যে কম পরীক্ষার কারণে কম আক্রান্ত প্রতীয়মান হলে কেবল পরিস্থিতির ওপরে সরকারের নিয়ন্ত্রণই প্রমাণ করবে।

করোনাভাইরাস দেশের অর্থনীতির ওপরে যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলবে তার ভার কাকে বেশি বইতে হবে, তার লক্ষণ ইতিমধ্যে দেখা যাচ্ছে। সংকটের মাত্র সূচনা অথচ দেশের দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত মানুষেরা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। তাঁদের সামনে জীবন না জীবিকা—এই প্রশ্ন এসে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সাফল্যের যে মাপকাঠি ব্যবহার করা হয় তা হচ্ছে জিডিপি। এর প্রবৃদ্ধির হার নিয়ে অনেকেই গর্বিত। কিন্তু এই প্রবৃদ্ধি যে সমাজে বৈষম্য কোন পর্যায়ে নিয়ে গেছে, যাদের ওপরে ভর করে এই প্রবৃদ্ধি এসেছে তাদের জন্য যে কোনো ধরনের নিরাপত্তাব্যবস্থা বা সেফটি নেট তৈরি করা হয়নি, সেটা দৃশ্যমান।

রাষ্ট্রের তৈরি করা সেফটি নেট অপ্রতুল, সে কারণে ব্যক্তিগত উদ্যোগে ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে। সরকার এখন পর্যন্ত এই ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করে সাহায্য করাকেই যথেষ্ট ভাবছে। কিন্তু এখনই এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ না নিলে ভবিষ্যতে কী ধরনের অবস্থা হবে, তা অনুমান করা যায় মাত্র। মধ্যবিত্ত এবং সীমিত আয়ের মানুষেরা যে কতটা অসহায়, তা তাঁদের জিজ্ঞাসা করলেই জানা যায়।

জিডিপির সাড়ে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধির ছায়ায় গত কয়েক বছরে লুটপাটের মহোৎসব হয়েছে; বলা হয়েছে দেশে হতদরিদ্র নেই, মধ্যবিত্ত ভালো আছে, দেশ অচিরেই ধনী দেশের তালিকায় নাম লেখাবে। তারপরও যদি এই অবস্থা হয়, তবে সেই প্রবৃদ্ধি যখন সাড়ে ৩ শতাংশে নেমে আসবে, তখন কী পরিস্থিতি হবে, অনুমান করতে পারা যায়?

আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর