সরকারি ত্রাণ বণ্টিত হচ্ছে কোন নিয়মে?

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

সারা দেশে করোনা দুর্যোগে কোটি কোটি মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। সরকারিভাবে চলছে ত্রাণ সহায়তার কাজ। কিন্তু এই ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে কিসের ভিত্তিতে? একদিকে চিকিৎসা-সংকট, অন্যদিকে খাদ্যসংকট—এ দুয়ে মিলে অসহায় মানুষের জীবনে নেমে আসতে পারে আরও বিপর্যয়। সে জন্য ত্রাণকাজ খুবই পরিকল্পিতভাবে হওয়া উচিত। যেসব জেলায় দরিদ্র বেশি, সেসব জেলার সঙ্গে কম দারিদ্র্যের জেলার ত্রাণ সমান হওয়া উচিত নয়।

দেশে গরিব মানুষের পরিসংখ্যান
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী দেশে এখন দারিদ্র্যের হার ২০ দশমিক ৫ শতাংশ এবং মোট জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে ১৬ কোটি। সেই হিসাবে দেশে এখন গরিব মানুষ আছে প্রায় ৩ কোটি ৩০ লাখ।

বৈষম্যের চিত্র
সরকারের বৈষম্যনীতির ছোট দুটি পরিসংখ্যান এখানে হাজির করছি। ২০১০ সালে সারা দেশে গড় দারিদ্র্য ছিল ৩১ শতাংশ। ২০১৬ সালে সেই দারিদ্র্য নেমে এসেছে ২৪ দশমিক ৩ শতাংশে। যখন সারা দেশে দারিদ্র্য কমে, তখন রংপুর বিভাগের জেলাগুলোতে দারিদ্র্য বাড়ে। সারা দেশে যখন প্রায় ৭ শতাংশ দারিদ্র্য কমেছে, তখন কুড়িগ্রামে দারিদ্র্য ৭ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৭০ দশমিক ৮ শতাংশ। রংপুরে বিভাগে ৪২ দশমিক ৩ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ৪৭ দশমিক ২ শতাংশ।

২০১৮-১৯ অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন প্রকল্পে সরকার বরাদ্দ দিয়েছিল ১ লাখ ৭৬ হাজার ৬১৯ কোটি টাকা। এতে রংপুরের প্রায় ২ কোটি মানুষের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ১ শতাংশেরও কম। মাত্র দশমিক ৯৮ শতাংশ। উন্নয়নবৈষম্য দূর করার ক্ষেত্রে সরকারের আন্তরিকতা আর দায়িত্ববোধে কত অবহেলার, তা সহজেই অনুমেয়।

কোন জেলায় কতটুকু ত্রাণ প্রয়োজন
আক্ষরিকভাবে এই পরিসংখ্যান দেওয়া অবশ্যই কঠিন, কোন জেলায় কতজনকে ত্রাণ দিতে হবে। তবে কোন জেলার দারিদ্র্যের চিত্র কী, সেটা বিবেচনায় নেওয়া সম্ভব হলে অবশ্যই ন্যায়ভিত্তিক বরাদ্দ সম্ভব। বাংলাদেশের সবচেয়ে কম গরিব তিনটি জেলার নাম নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ ও মাদারীপুর। ২০১৪ সালে প্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী এ তিনটি জেলার জনসংখ্যা যথাক্রমে নারায়ণগঞ্জে প্রায় সাড়ে ২৯ লাখ, মুন্সিগঞ্জে প্রায় ১৫ লাখ এবং মাদারীপুরে ১২ লাখ ১২ হাজার। এ তিনটি জেলার গড় দারিদ্র্য নারায়ণগঞ্জে ২ দশমিক ৬ শতাংশ, মুন্সিগঞ্জে ৩ দশমিক ১ শতাংশ এবং মাদারীপুরে ৩ দশমিক ৭ শতাংশ। তিনটি জেলার মধ্যে নারায়ণগঞ্জে গরিব মানুষের সংখ্যা ৭৬ হাজার ৭০০, মুন্সিগঞ্জে ৪৬ হাজার ৫০০ এবং মাদারীপুরে ৪৪ হাজার ৮০০।
অন্যদিকে বাংলাদেশের সবচেয়ে গরিব তিনটি জেলার দারিদ্র্যের হার হচ্ছে কুড়িগ্রামে ৭০ দশমিক ৮, দিনাজপুরে ৬৪ দশমিক ৩ এবং বান্দরবান জেলায় ৪০ দশমিক ১ শতাংশ। ২০১১ সালের আদমশুমারি এবং ২০১৬ সালের দারিদ্র্য মানচিত্র অনুযায়ী দেশের সবচেয়ে গরিব তিনটি জেলার অবস্থা জেনে নেওয়া যাক।
কুড়িগ্রামে মোট ২০ লাখ ৬৯ হাজার মানুষের মধ্যে গরিব ১৪ লাখ ৬৪ হাজার ৮৫২; দিনাজপুরে ৩১ লাখ ৯ হাজার মানুষের মধ্যে গরিব প্রায় ২০ লাখ এবং বান্দরবানে প্রায় ৩ লাখ ৮৮ হাজার মানুষের মধ্যে গরিব ১ লাখ ৫৫ হাজার ৫৮৮। গত তিন বছরে এই পরিসংখ্যান কিছুটা বদলালেও অবস্থার খুব বেশি পরিবর্তন হওয়ার কথা নয়।

অতীতের আলোকে ত্রাণে বৈষম্যের আশঙ্কা
বাংলাদেশের সবচেয়ে গরিব জেলাগুলোর সঙ্গে ধনী জেলাগুলোর বৈষম্য দূরীকরণে কোনো পদক্ষেপ কখনোই গ্রহণ করা হয়নি। বরং বৈষম্য বৃদ্ধিতে যথাসাধ্য চেষ্টা হয়েছে। তা না হলে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে শুধু গোপালগঞ্জের মাত্র ১২ লাখ মানুষের জন্য মোট বরাদ্দের ৫ শতাংশ আর রংপুর বিভাগের ২ কোটি মানুষের জন্য দশমিক ৯৮ শতাংশ অর্থ বরাদ্দ হওয়ার কথা নয়। এই আশঙ্কা থেকে সহজেই অনুমান করা যায়, ত্রাণ বণ্টনে ন্যায় প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা খুবই কম।

কী চাই?
বর্তমানে গোটা বিশ্ব করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে একটি ভয়াবহ সময় পার করছে। বাংলাদেশও তার বাইরে নয়। সারা দেশে অসহায় মানুষগুলো সরকারের সীমিত ত্রাণের সর্বোচ্চ সুবিধা লাভ করুক, এটাই প্রত্যাশা। দিনাজপুরে গরিব মানুষের সংখ্যা ২০ লাখ আর মুন্সিগঞ্জে মাত্র ৪৬ হাজার ৫০০। এই দুই জেলায় যদি সমপরিমাণ ত্রাণ দেওয়া হয়, তাহলে সেটা অনেক বড় রাষ্ট্রীয় বঞ্চনা হবে, তা নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না। শুধু বঞ্চনা কেন, এতে করে অসহায় মানুষের জীবন চূড়ান্ত বিপন্ন হতেও বাধ্য। জেলাভিত্তিক বরাদ্দ করার সময় যদি সরকারি পরিসংখ্যান আমলে নিয়ে বরাদ্দ দেওয়া যায়, তাহলে কর্মহীন অসংখ্য অসহায় মানুষ খেয়ে বাঁচতে পারবে।

ত্রাণে সমন্বয় জরুরি
শুধু সরকারের দিকে মুখ তুলে থাকলে চলবে না। এগিয়ে আসতে হবে সামর্থ্যবানদেরও। এরই মধ্যে বিচ্ছিন্নভাবে অনেক ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, সংগঠন ত্রাণ সহায়তার কাজ করছে। যদি এই ত্রাণে সমন্বয় করা সম্ভব হয় তাহলে কেউ বারবার পাবে, কেউ একেবারেই পাবে না, এমন হবে না। এমনকি যারা খুব অসহায়, অর্থাৎ যাদের ত্রাণ পাওয়ার কথা, তারাই ত্রাণ লাভ করবে। বেসরকারিভাবে যেই ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে সেগুলো স্থানীয় জেলা-উপজেলা প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে দেওয়া প্রয়োজন। এতে সরকারি ও বেসরকারি ত্রাণের সর্বোচ্চ সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা সম্ভব।
গত ৮ জুলাই ২০১৯ সারা দেশে প্রাকৃতিক কারণে দেশব্যাপী ৬৪ জেলার জন্য ১০ হাজার ৯০০ মেট্রিক টন চাল ত্রাণ হিসেবে দেওয়া হয়েছিল। সেখানে দেখা যায়, দেশের শীর্ষ ১০ গরিব জেলার একটি গাইবান্ধায় দেওয়া হয়েছে মাত্র ১৫০ মেট্রিক টন চাল। গাইবান্ধা তখন পানির নিচে ডুবেছিল। যেসব জেলায় প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতি নামমাত্র হয়েছে, সেখানেও দেওয়া হয়েছে ২০০ মেট্রিক টন চাল। করোনা দুর্যোগে বাস্তবতা তার চেয়ে কি ভিন্ন হবে? অসহায়রাই ত্রাণ ও অন্যান্য সুবিধা ন্যায়ভিত্তিক লাভ করবে? আশা করি এখন থেকে উপযোগিতাভিত্তিক বরাদ্দই হবে।

তুহিন ওয়াদুদ, শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর এবং পরিচালক, রিভারাইন পিপল।

wadudtuhin@gmail. com