করোনার প্রতিষেধক ও চিকিৎসা: কত দূর এগোনো গেল

রুদ্ধশ্বাসে থাকা সমগ্র বিশ্ববাসীর একটাই প্রত্যাশা—করোনা থেকে মুক্তি। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এই রোগের প্রতিষেধক বা ওষুধ এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষের যুগে যখন প্রকৃতির নানাবিধ খেয়ালকে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছে, তখন সাধারণভাবে প্রশ্ন আসে, ভাইরাসটির বিরুদ্ধে কার্যকর ওষুধ বা প্রতিষেধক তৈরির কাজটি করতে এত সময় লাগছে কেন? অ্যান্টিবায়োটিক শব্দটি বহুল পরিচিত, এটি শুধু ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে কাজ করতে পারে।

এ ছাড়া ফাঙ্গাস, প্রোটোজোয়া, স্পাইরোকেট ইত্যাদি অণুজীবের বিরুদ্ধে যথাযথ ওষুধ থাকলেও ভাইরাসকে প্রতিহত করার পুরোপুরি কার্যকর ওষুধ চিকিৎসাবিজ্ঞান আজও আমাদের উপহার দিতে পারেনি। ভাইরাস আসলে জীব না জড়, সেই বিতর্কেই বৈজ্ঞানিকেরা এখনো একমত হতে পারেননি। তাত্ত্বিকভাবে এ কথা স্বতঃসিদ্ধ যে জড় পদার্থের ওপর ওষুধের প্রয়োগের বিষয়টি একেবারেই বাস্তবতাবিবর্জিত।

বিগত দিনে ভাইরাসটিতে কিছু রোগ আমাদের চৈতন্যের দ্বারে নাড়া দিয়ে গেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় সার্স, মার্স, এইডস ইত্যাদির নাম। এ ছাড়া ইবোলা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে বিশেষত আফ্রিকাতে যখন ব্যাপক লোক ক্ষয় হয়েছিল, তখনো ভাইরাস নামের অণুজীবের কাছে চিকিৎসাবিজ্ঞানের অসহায়ত্ব আরেকবার প্রস্ফুটিত হয়েছিল। উল্লেখিত ভাইরাসগুলোর ধরন পৃথক পৃথক। ভাইরাসগুলো সব সময়েই নতুন নতুন সামর্থ্য নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে। ফলে চিকিৎসক ও সংশ্লিষ্টদের নতুন কোনো ভাইরাস সম্পর্কে পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়াই মোকাবিলায় নামতে হয়। করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রেও এই ‘মহাযুদ্ধে’ নামতে হয়েছে নতুন এই ভাইরাস সম্পর্কে বিস্তারিত না জেনেই।

করোনাভাইরাস তার অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রাখার জন্য প্রতিনিয়তই ‘জিন’ তথা বংশগতি বদলাচ্ছে। এখন পর্যন্ত এই ভাইরাস অন্তত ৩৮০ বার এই কাজ করেছে। ফলে বিজ্ঞানীদের জন্য মিউটেশন বা ক্ষণে ক্ষণে নিজেকে পরিবর্তন করা ভাইরাসের প্রতিষেধক বা ওষুধ তৈরি করা জটিল হয়ে পড়েছে।

তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ বিস্তারের ফলে আমরা ইতিমধ্যে জেনেছি যে ২০১৯ সালে চীনের উহান শহরে এই রোগ প্রথম দৃষ্টিগোচর হয়। নতুন এই ব্যাধি নিউমোনিয়াসদৃশ লক্ষণ নিয়ে উপস্থাপিত হওয়ায় কিছুটা বিভ্রান্ত চিকিৎসকেরা প্রথমে এটির নাম দেন ‘নিউমোনিয়া অব আননোন অরিজিন’। বাংলায় তরজমা করলে তার অর্থ হয়তো ‘অজ্ঞাত উৎসের নিউমোনিয়া’ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে। চায়নিজ সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) ব্যাপক গবেষণার পর এই সিদ্ধান্তে আসে, এটি একটি ভাইরাসজনিত রোগ এবং করোনাভাইরাস পরিবারের সদস্য। এটি আরএনএ তথা রাইবোজোমাল নিউক্লিক অ্যাসিড ভাইরাস। অন্যান্য ভাইরাসের থেকে এটির বিশেষত্ব হলো, এর গঠনে তীক্ষ্ণ অগ্রভাগসদৃশ গজাল আছে, যাকে স্পাইক বলা হয়। স্পাইকগুলোর কারণে ভাইরাসটি অনেকটি মুকুটের মতো দেখায়। ল্যাটিন ভাষায় ‘কোরোনাম’ শব্দের অর্থ মুকুট। ভাইরাসটি যেহেতু অনেকটা মুকুটের মতো দেখতে, তাই এই শ্রেণির ভাইরাসের নামকরণ করা হলো ‘করোনা’। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এসব তথ্য–উপাত্ত বিবেচনায় নিয়ে ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২০ সালে এর নামকরণ করে কোভিড–১৯।

আজ পর্যন্ত চিকিৎসাবিজ্ঞান শুধু মাথা কুটে মরছে, কিন্তু এর ডিনামিক্সের প্রকৃত কারণ উদ্‌ঘাটন করতে সক্ষম হয়নি। তবে অনুমান করা হয়, এটি কোনো প্রাণী থেকে এসেছে। সময়ের আবর্তনে পশ্চিমা দেশগুলো শল্যচিকিৎসায় বিশেষ সাফল্য লাভ করেছে। হৃদ্‌রোগ, স্নায়ুরোগ বা মানসিক রোগ চিকিৎসায় অগ্রগতির সূচক অনেকটাই অগ্রগামী। কিন্তু তাদের আবহাওয়া, পরিচ্ছন্ন পরিবেশ, সর্বসাধারণের স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মেনে চলাসহ নানাবিধ কারণে ‘ইনফেকশন’ জাতীয় রোগ অল্পই হয়। ফলে অণুজীব দ্বারা সৃষ্ট রোগবালাইয়ে উন্নততর গবেষণায় তাদের আগ্রহ যেমন কম, তেমনই প্রায়োগিক জ্ঞান এবং সরাসরি চিকিৎসাসেবা দিয়ে রোগীকে সুস্থ করার অভিজ্ঞতাও সীমিত।

ম্যালেরিয়া একটি গ্রীষ্মমণ্ডলীয় রোগ। একে পশ্চিমারা উন্নাসিকতায় ‘নেগলেক্টেড ট্রপিক্যাল ডিজিজ’ হিসেবে অবজ্ঞা করেছে। হাইড্রোক্লোরোকুইন এবং ক্লোরোকুইন ম্যালেরিয়ার ওষুধ। হাজারো অত্যাধুনিক ওষুধ যখন রক্ত হিম করা করোনাকে পর্যুদস্ত করতে পারল না, তখন চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের এই ওষুধের শরণাপন্ন হতে হলো। ম্যালেরিয়ার জীবাণু প্লাজমোডিয়াম একটি প্রোটোজোয়া, ভাইরাস নয়। এ ছাড়া আর্থ্রাইটিস, লিউপাস রোগে এর ব্যবহার আছে। শুধু চীনেই নয়; ভারত, দক্ষিণ কোরিয়ায় করোনায় ক্লোরোকুইন এবং হাইড্রোক্লোরোকুইন ওষুধ ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। অনুমান করা হয়, এর ফলে এই সব দেশে করোনায় মৃত্যুর হার আশাব্যঞ্জকভাবে কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। তাই বলা হচ্ছে, আফ্রিকায় করোনার প্রকোপ কম হওয়ার এটি অন্যতম কারণ। পাশাপাশি ইতালিতে করোনায় ক্লোরোকুইনের ব্যবহারের চল না থাকায় বিপুলসংখ্যক প্রাণহানি ঘটেছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) ওষুধ বাজারজাতকরণের অনুমতি দিয়ে থাকে। তবে শুধু ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা নয়, প্রাণীর ওপর পরীক্ষা, সীমিতসংখ্যক ‘স্বেচ্ছাপ্রণোদিত’ রোগীর ওপর প্রয়োগ এবং সবশেষে ‘পোস্ট মার্কেটিং সার্ভিল্যান্সের’ স্তর পেরিয়ে এই সংস্থা নতুন ওষুধ বাজারজাত করার অনুমতি দেয়। এই প্রক্রিয়ায় নতুন ওষুধ বাজারজাত করতে কয়েক বছর সময় লেগে যায়। সেই ধারাবাহিকতায় করোনার যথাযথ ওষুধ আবিষ্কার এবং বাজারে আসতে যে দীর্ঘ সময় লেগে যাবে, এটি দিব্যি বোঝা যাচ্ছে।

বহু ওষুধের সঠিক ‘মেকানিজম অব অ্যাকশন’ না জানা থাকলেও সেই ওষুধগুলো দিব্যি কার্যকর। ক্লোরোকুইন বা হাইড্রোক্লোরোকুইন ঠিক কীভাবে করোনাভাইরাসের ওপর কাজ করছে, সেটি উপযুক্ত প্রামাণিক দলিল দ্বারা স্বতঃসিদ্ধ না হলেও এটিই বর্তমানে কোভিড-১৯–এর প্রতিরোধ এবং চিকিৎসায় অধিকতর কার্যকর ওষুধ হিসেবে ধরে নেওয়া যাচ্ছে। গলায়, শ্বাসতন্ত্রসহ অন্যান্য অঙ্গে সংক্রমণের বিরুদ্ধে এজিথ্রোমাইসিন নামক অ্যান্টিবায়োটিকও যুগপৎ ব্যবহার করা হচ্ছে।

প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প করোনা সম্পর্কে প্রেস ব্রিফিংয়ে এই ওষুধগুলোর নাম উল্লেখ করেন। অবশ্য তাঁর কাজ রাষ্ট্র পরিচালনা করা, প্রেসক্রিপশন লেখা নয়, এই মর্মে সংশ্লিষ্ট মহল থেকে তাঁকে থামিয়ে দেওয়া হয়েছে। ট্রাম্পের দেওয়া ভাষণের ভিডিওটি সারা বিশ্বে ভাইরাল হয়। ফলে বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশের বিপুলসংখ্যক সাধারণ জনগণ এই দুটি ওষুধকে ‘অব্যর্থ’ বিবেচনা করছে। এমনকি মুড়ি–মুড়কির মতো কিনে ঘরে মজুত করে রাখার কথা শোনা গেছে। যদিও ওষুধগুলো ‘ভাইট্রো ট্রায়াল’ বা ল্যাবরেটরিতে করোনাভাইরাসকে ধ্বংস করতে সফল হয়েছে, তবু অদ্যাবধি এফডিএ এই ওষুধ দুটিকে বাজারে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ছাড়ার অনুমতি দেয়নি। তবে আমেরিকার চিকিৎসকেরা ক্ষেত্রবিশেষে এফডিএর অনুমোদন ব্যতিরেকে বিশেষ বিশেষ ওষুধ প্রেসক্রাইব করতে পারেন। সম্প্রতি কানাডাও এই ওষুধগুলো করোনা প্রতিষেধক এবং চিকিৎসায় আনুষ্ঠানিকভাবে ব্যবহার শুরু করেছে।

যে ওষুধগুলো কেবল চিকিৎসকের পরামর্শে সেবন করতে হয়, ক্লোরোকুইন বা হাইড্রোক্লোরোকুইন সেই পরিবারেরই সদস্য। এ ধরনের ওষুধের সেফটি মার্জিন খুব ‘ন্যারো’। যে ওষুধগুলোর সেফটি মার্জিন ন্যারো, সেগুলোর ডোজ সামান্য বেশি হলেই মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। এমনকি মৃত্যুরও আশঙ্কা রয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশে অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার অনেক বিস্তৃত বর্ণালির অ্যান্টিবায়োটিককে রেজিস্ট্যান্স করে ফেলেছে। ফলে কানাডা বা মার্কিন মুলুকের মতো বাংলাদেশে এজিথ্রোমাইসিন সমভাবে কার্যকর হবে কি না, সেটি বলবার সময় এখনো আসেনি। তাই বাংলাদেশের ড্রাগ প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোভিড–১৯–এর চিকিৎসায় চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া এই দুটি ওষুধ বা যেকোনো ওষুধ সেবন না করার জন্য সতর্কবাণী গণমাধ্যমে বারবার উচ্চারণ করা হচ্ছে। করোনায় আক্রান্ত হয়েছে সেই আশঙ্কা এবং রোগটি লুকিয়ে নিজে নিজে চিকিৎসা করাতে গিয়ে প্রাণহানির খবর সোশ্যাল মিডিয়ায় সয়লাব হয়ে গেছে।

সম্প্রতি ‘প্লাজমা থেরাপি’র কথা ভাবা হচ্ছে। এতে সুস্থ হয়ে যাওয়া করোনা রোগীর রক্ত আক্রান্ত রোগীর শরীরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। বিষয়টি চিকিৎসাবিজ্ঞানে নেহাতই নতুন নয়। ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের চিকিৎসাতেও এই পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়েছিল। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অদ্যাবধি করোনা চিকিৎসার ‘গাইডলাইনে’ এই পদ্ধতির কথা উল্লেখ করেনি।

করোনার মতো সর্বগ্রাসী রোগের প্রতিষেধক বা চিকিৎসায় যতটুকু অগ্রগতি হয়েছে, সেটিকে শুধু চলমান রেখেই নয়, আরও বেগবান করে পুরোপুরি কার্যকর ওষুধ এবং প্রতিষেধক দ্রুত আবিষ্কার করা হোক। শত কষ্টে জর্জরিত ধরিত্রী মাতা করোনা চিকিৎসায় একটু আশার আলো খুঁজে পাক, এটিই সবার প্রত্যাশা। আর এই প্রত্যাশা বিকশিত হয়ে ‘প্রাপ্তি’ নামক ফুল হয়ে সৌরভ ছড়াক।

মেজর ডা. খোশরোজ সামাদ আর্মড ফোর্সেস মেডিকেল কলেজের ফার্মাকোলজি বিভাগের ক্ল্যাসিফাইড স্পেশালিস্ট