এই সংকটে শরীরচর্চা সহায়ক হতে পারে

প্যাট্রিসিয়া স্কটল্যান্ড
প্যাট্রিসিয়া স্কটল্যান্ড

উদ্যান, সৈকত, স্টেডিয়ামগুলো বন্ধ। সারা বিশ্বের আড়াই শ কোটি মানুষকে নজিরবিহীনভাবে বলা হয়েছে ঘরে বসে থাকতে।

সময়টা কঠিন। করোনাভাইরাস বাস্তব এবং সারা বিশ্বে নিজের বিস্তার ঘটিয়ে এটি কেড়ে নিচ্ছে মানুষের জীবন ও জীবনধারণের উপায়গুলোও। জিমসহ খেলাধুলার সব ক্ষেত্র বন্ধ করে দিয়ে মানুষকে ঘরে আবদ্ধ রাখার নীতি নেওয়ায় ব্যক্তিমানুষের চলাফেরা ও শরীরচর্চা সীমিত হয়ে পড়েছে। প্রয়োজনীয় কিন্তু যন্ত্রণাদায়ক এই পদক্ষেপের কারণে মানুষ অক্রিয় থাকতে বাধ্য হচ্ছে, যা ভয়াবহ মানসিক চাপ সৃষ্টি করছে। স্বাস্থ্যের ওপর এর দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।

ক্যামেরুনের স্যামুয়েল ইতো, ওয়েস্ট ইন্ডিজের ব্রায়ান লারা, ঘানার অলিম্পিয়ান আকওয়াসি ফ্রিমপং, কেনিয়ার ইলুইড কিপচোগে ও হেলেন ওবিরি, যুক্তরাজ্যের টম ড্যালির মতো কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর খেলোয়াড়েরা করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কমাতে এবং ঘরেই সক্রিয় থাকতে গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন তথ্য সবাইকে জানাচ্ছেন। ‘জ্যামাইকা মুভস’-এর মতো অনেকগুলো অনলাইন সিরিজ, ভার্চ্যুয়াল ক্লাস ও কনটেন্ট রয়েছে, যেখানে মানুষকে সক্রিয় থাকতে, মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে ও অসংক্রামক রোগমুক্ত থাকতে পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করা হচ্ছে।

এসব উদ্যোগ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে আমরা দ্রুতই ‘কমনওয়েলথ মুভস’ নামে একটি প্রচার শুরু করব। এর মাধ্যমে আমরা আমাদের ৫৪টি সদস্য দেশের মানুষদের সক্রিয় থাকতে ও শরীরচর্চা করতে উৎসাহিত করব, যাতে সবাই মিলে এই ভয়াবহ মহামারির চোখে চোখ রাখতে পারি।

সব প্রতিযোগিতা ও খেলার স্থানগুলো বন্ধ করে দেওয়া হলেও এই সংকটের সময়ে খেলাধুলা ও শারীরিক ক্রিয়া হতে পারে শক্তিশালী অস্ত্র। এটি একটি বৈশ্বিক ভাষা, যার রয়েছে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার ক্ষমতা। এটিই পারে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ক্ষমতায়নের সঙ্গে সঙ্গে জাতিগুলোকে পুনর্গঠন করতে।

শ্রীলঙ্কায় সিংহলি ও তামিলদের মধ্যে সংযোগ তৈরি করেছিল ক্রিকেটের প্রতি তাদের অভিন্ন ভালোবাসা। এই ক্রিকেটই ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জকে সংযুক্ত করেছিল, যা জন্ম দিয়েছিল ক্রিকেটের অন্যতম শক্তিশালী প্রতীক ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ঐক্যের। বলা যায় কমনওয়েলথ গেমসের কথা। ক্রীড়া শ্রেষ্ঠত্বের এই সাংস্কৃতিক উৎসব বৈচিত্র্য ও সমন্বয়ের শিখর হিসেবে ভাস্বর।

খেলাধুলার কল্যাণকর এই ভূমিকার স্বীকৃতি হিসেবে ছয় বছর আগে জাতিসংঘ ৬ এপ্রিলকে ‘শান্তি ও উন্নয়নের জন্য আন্তর্জাতিক ক্রীড়া দিবস’ ঘোষণা করে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ২০৩০ টেকসই উন্নয়ন (সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট) লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপায় হিসেবে শনাক্ত করে। একই সঙ্গে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সামাজিক অন্তর্ভুক্তি, নারীর ক্ষমতায়ন ও যুব উন্নয়নে এর প্রভাবের বিষয়টিকে সবার দৃষ্টিগোচর করতেও উদ্যোগ নেয়।

বহু সরকার ও প্রতিষ্ঠান তৃণমূল পর্যায়ে বিভিন্ন প্রকল্পকে পরিচয় করিয়ে দিতে খেলাধুলাকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করছে। প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ‘জাস্ট প্লে’ নামের একটি উদ্যোগ শিশুদের স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন শেখাতে ফুটবলকে ব্যবহার করছে। একইভাবে শারীরিক প্রতিবন্ধীদের নিয়ে সমাজে বিদ্যমান বদ্ধমূল ধারণাগুলো ভাঙতে খেলাধুলাকে কাজে লাগাচ্ছে সিঙ্গাপুরভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘স্পোর্ট কেয়ারস’। কমনওয়েলথ সচিবালয়ের উদ্যোগ ‘পিস অ্যাট দ্য ক্রিজ’ বিভিন্ন ধর্মবিশ্বাসী ও অবিশ্বাসীদের খেলার মাধ্যমে পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত হওয়া ও শান্তিতে সহাবস্থানের দিশা দিতে কাজ করছে, যার সুফল এরই মধ্যে দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। এ ধরনের উদ্যোগ মানুষের স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটানোর পাশাপাশি নানা গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতা ও মূল্যবোধও শেখায়। যথাযথভাবে সম্পন্ন করতে পারলে এটি বিভিন্ন সম্প্রদায়কে ঐক্যবদ্ধ করতেও সহায়তা করে।

স্থানীয় পর্যায় পেরিয়ে আরও অনেক দূর পৌঁছানোর ক্ষমতা রাখে খেলাধুলা। এটি জাতীয় নীতি ও পরিকল্পনার কেন্দ্রে থাকতে পারে এবং তা হওয়া উচিতও। যাতে ক্রীড়া ও শরীরচর্চার সুফল দরিদ্র, প্রান্তিক, শরণার্থী, দুর্যোগ ও সহিংসতার ভুক্তভোগী থেকে শুরু করে সবার কাছে সত্যিই পৌঁছাতে পারে। কিন্তু কীভাবে?

আমরা মরিশাসের সঙ্গে একটি নতুন নীতিমালা তৈরি ও বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ করেছি, যা জাতিসংঘের এসডিজি বাস্তবায়নে খেলাধুলার ভূমিকার প্রভাব খতিয়ে দেখবে। এই নীতিমালা দেশটির ২০১৮ থেকে ২০২৮ ভিশনেও যুক্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। নীতিমালাটির উদ্দেশ্য হলো, একটি স্বাস্থ্যবান জনগোষ্ঠী গড়ে তোলার মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের অসংক্রমাক রোগের ঝুঁকি কমানো এবং হাসপাতালের ওপর চাপ কমানো।

এই ব্যাপক উদ্যোগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি পাঁচজনে একজন কিশোর খেলাধুলার সঙ্গে যুক্ত থাকে না। আর আর্থিক অসচ্ছলতা, সাংস্কৃতিক বাধা ও দরকারি অবকাঠামো না থাকায় ২৫ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি খেলাধুলা অথবা কোনো ধরনের ব্যায়াম করেন না। ফলে খেলাধুলা ও শারীরিক ক্রিয়ার কারণে যেসব অর্থনৈতিক, সামাজিক ও স্বাস্থ্যগত সুফল তারা পেতে পারত, তা থেকে তারা বঞ্চিত হয়।

আমরা বিশ্বের সরকারগুলোকে এই ব্যবধান কমাতে ক্রীড়া খাতে আরও বিনিয়োগের আহ্বান জানাচ্ছি। ক্রীড়া খাতে বিনিয়োগ শুধু একটি ভালো উদ্যোগই নয়, এটি বিনিয়োগ করা অর্থেও মূল্য সংযোজন করে। সাধারণত ক্রীড়া খাতে কোনো দেশের জাতীয় বাজেটের ১ শতাংশের কম বরাদ্দ থাকে। এই সামান্য বরাদ্দই আবার জিডিপিতে কয়েক গুণ বেশি অবদান রাখে। ২০১৬ সালে ফিজি তাদের জাতীয় বাজেটের দশমিক ৫ শতাংশ খেলাধুলার পেছনে ব্যয় করে। বিনিময়ে ক্রীড়া খাতের অবদান ছিল দেশটির জিডিপির ১ দশমিক ৭ শতাংশ, যা ছিল খনি ও বনভূমি খাত থেকে আসা অংশের চেয়ে বেশি। একই বছর কানাডায় ক্রীড়া-অর্থনীতি ৩ দশমিক ২ শতাংশ বৃদ্ধি পায় এবং খাতটিতে কর্মসংস্থান বাড়ে ৪ দশমিক ৯ শতাংশ। বর্তমান স্বাস্থ্য সংকট থেকে বেরিয়ে আসার মুহূর্তে এবং অর্থনীতি পুনর্গঠনের পথে ক্রীড়া খাতের এই কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষমতা ভীষণভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

ক্রীড়াজগতে বিনিয়োগ শুধু অর্থনীতির বিষয় না। ২০১৬ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি ১ ব্রিটিশ পাউন্ড ক্রীড়াজগতে ব্যয় করায় অনেক রোগের ঝুঁকি কমে গেছে, স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটেছে, অপরাধ কমেছে। তাতে ১ দশমিক ৯ পাউন্ড আয়ও হয়েছে। ক্রীড়াজগতে বিনিয়োগের ফলাফল খুবই পরিষ্কার, এটি এসডিজি ঘোষিত লক্ষ্য বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করবে।

কমনওয়েলথের এটি নিয়ে একটি বিস্তারিত পরিকল্পনা রয়েছে। ক্রীড়াজগতে বিনিয়োগ কীভাবে বড় ধরনের ভূমিকা রাখতে পারে, তা নিয়ে আমরা জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর সঙ্গে কাজ করছি। এই উদ্যোগ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে বোঝাতে সক্ষম হবে যে, ক্রীড়া খাত ও শারীরিক শিক্ষা এসডিজি বাস্তবায়নে কতটা ভূমিকা রাখে। এসডিজির ওপর ক্রীড়াজগৎ ও শারীরিক শিক্ষার প্রভাবের বিষয়টি কাজান অ্যাকশন প্ল্যানে স্বীকৃত।

ক্রীড়াজগতে বিনিয়োগ কীভাবে কাজ করে? ধরুন, আমরা দেশগুলোকে আরও বেশি খেলার মাঠ তৈরির জন্য অনুরোধ করতে পারি, তাতে ডায়াবেটিস ও ক্যানসারের মতো অসংক্রামক রোগ থেকে মৃত্যু কমিয়ে কীভাবে এসডিজির লক্ষ্য অর্জনে অবদান রাখা যায় তার পরিকল্পনা করা সম্ভব।

জাপানসহ সাতটি দেশ এই পদ্ধতি অনুশীলন করছে। আমরা আশা করি কমনওয়েলথ নেতারা তাঁদের পরবর্তী দ্বিবার্ষিক বৈঠকে এই পদ্ধতিকে সমর্থন দেবেন।

এটা এমন একটা সময় যখন বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে, বহু ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যায় আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। এ সময় আমরা মানুষকে খেলাধুলার প্রতি উৎসাহ দিতে পারি; তাতে সুস্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে, যা একই সঙ্গে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ তৈরিতেও সহায়তা করবে।

প্যাট্রিসিয়া স্কটল্যান্ড কমনওয়েলথের মহাসচি