আমরা এখন একটা সংকটকালে রয়েছি

মো. জাহিদুর রহমান খান।
মো. জাহিদুর রহমান খান।
>

ডা. মো. জাহিদুর রহমান খান একজন ভাইরোলজিস্ট এবং শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন দেশের বর্তমান করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি, সামনের আশঙ্কা ও পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার নানা দিক নিয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এ কে এম জাকারিয়া

প্রথম আলো: এখন পর্যন্ত আমাদের যে কজন করোনা আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন এবং মৃত্যুর যে সংখ্যা, তা বিবেচনায় নিলে আমাদের খুব শঙ্কিত হওয়ার কিছু আছে, নাকি স্বস্তির কোনো ব্যাপার আছে?

জাহিদুর রহমান: ভাইরাস সংক্রমণের পর্যায়গুলোকে চার ভাগে ভাগ করা হয়। প্রথম পর্যায়টি হচ্ছে বাইরের দেশে ভাইরাস ছড়িয়েছে কিন্তু সেটি এখনো আমাদের দেশে প্রবেশ করেনি। দ্বিতীয় পর্যায়টি হচ্ছে ভাইরাসটি বিদেশ থেকে আসা কারও মধ্যে পাওয়া গেছে। তৃতীয় পর্যায়টি হচ্ছে ভাইরাসটি বিদেশফেরত মানুষের সংস্পর্শে যারা এসেছেন, তাদেরকেও যখন সংক্রমিত করবে। যেটিকে আমরা লোকাল ট্রান্সমিশন বলে থাকি। চতুর্থ পর্যায়টি হচ্ছে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন, যখন এমন কারও দেহে ভাইরাসটি পাওয়া যায়, যার সম্প্রতি কোনো বিদেশভ্রমণের ইতিহাস নেই বা সে রকম কারও সংস্পর্শে যাওয়ার ঘটনা ঘটেনি। এটিকে আমরা কমিউনিটি ট্রান্সমিশন বলে থাকি। এই পর্যায়টিকে নিয়ন্ত্রণ করা না গেলেই সেটি মহামারিতে রূপ নেয়। আমরা এখন সীমিত পরিসরে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন পর্যায়ে আছি। কারণ, গত কয়েক দিনে কয়েকজন কোভিড-১৯ পজিটিভ রোগীদের কন্টাক্ট ট্রেসিং করে কোনো প্রবাসী বা টেস্ট পজিটিভ রোগীর সংস্পর্শে আসার ইতিহাস পাওয়া যায়নি। বিশ্বের যে দেশগুলো এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত, সেই অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নিলে আমরা দেখব যে শুরুর দিকে যে সংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন পরে তা হঠাৎ করেই অসম্ভব বেড়ে গেছে।

প্রথম আলো: আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত যে কয়েকজন সংক্রমিত হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন, সেই সংখ্যাটিকে কীভাবে দেখছেন?

জাহিদুর রহমান: দেখুন সংক্রমিত আর শনাক্ত হওয়া কিন্তু এক বিষয় নয়। কোভিড–১৯ ভাইরাসের সবচেয়ে বিপজ্জনক দিক হচ্ছে সংক্রমিত হলেও অনেক ক্ষেত্রে রোগীর মধ্যে লক্ষণ থাকে না। অনেকে বুঝতেই পারেন না যে তিনি এই ভাইরাস বহন করছেন। ফলে একজন সংক্রমিত ব্যক্তি সহজেই অন্যকে সংক্রমিত করেন। ফলে টেস্টের বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যেহেতু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুযায়ী সন্দেহভাজন সবার পরীক্ষা করতে পারিনি, সেহেতু যে কয়জন শনাক্ত হয়েছেন তা দিয়ে আক্রান্তের সংখ্যা নির্ণয় করা দুরূহ কাজ। যে কজন শনাক্ত হয়েছেন তা হয়তো একটি আইসবার্গের চূড়া মাত্র। আমাদের আশপাশেই হয়তো অনেক সংক্রমিত রোগী আছেন, টেস্ট করা হচ্ছে না বলে ধরাও যাচ্ছে না।

প্রথম আলো: ঝুঁকিটা এখন কোন মাত্রায় রয়েছে বলে মনে করেন?

জাহিদুর রহমান: আমরা এখন একটা সংকটকালে রয়েছি। বলা যায় মহামারি শুরুর প্রথম পর্যায়ে। সামনে সমূহ বিপদের আশঙ্কা রয়েছে। আগেই বলেছি অন্য দেশগুলোর অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নিলে দেখা যাবে প্রথম জন শনাক্ত হওয়ার পর পরের ২–৩ সপ্তাহ আক্রান্তের সংখ্যা খুব বেশি পাওয়া যায়নি। কিন্তু মাস দেড়েকের মাথায় হঠাৎ আক্রান্তের সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়। সেদিক থেকে দেখলে আমরা বড় ঝুঁকির মধ্যে রয়েছি।

প্রথম আলো: করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে বিশ্বে বিভিন্ন দেশ মূলত যে দুটি কৌশল নিয়েছে তা হচ্ছে লকডাউন ও ব্যাপক মাত্রায় পরীক্ষা। দুটির কোনোটিই তো আমরা যথাযথভাবে নিইনি।

জাহিদুর রহমান: আমার মনে হয় বিষয়টি আমরা যথাযথভাবে অনুধাবন করতে পারিনি। আমাদের হাতে অনেক সময় ছিল। অন্যান্য অনেক দেশ এমনকি বিশ্বের উন্নত দেশগুলোও করোনা মোকাবিলায় ভুল করেছে, শুরুতে অবহেলা করেছে। ফলে আমাদের সুযোগ ছিল সেসব ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়া। আমরা সেই অর্থে লকডাউন করিনি, ছুটি দিয়েছি। এরপর গণপরিবহন চালু ছিল। ফলে লোকজন বাড়ি চলে গেছে। লকডাউন একটি শহর, একটি এলাকা বা পুরো দেশজুড়েও হতে পারে। এর অর্থ কেউ তার নিজের জায়গা থেকে বের হতেও পারবে না, সেখানে কেউ ঢুকতেও পারবে না। আমর যদি আগের গণপরিবহন বন্ধ করে লকডাউন করতাম তা হলে সবাই যে যে যার যার জায়গায় থাকত। এতে রোগের সংক্রমণ দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি কমত।

প্রথম আলো: আমরা তা হলে কী কৌশল নিয়েছি?

জাহিদুর রহমান: এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য ডব্লিউএইচওর গাইডলাইন আছে। মনে রাখতে হবে বর্তমান পরিস্থিতিকে প্যানডেমিক বা বৈশ্বিক মহামারি ঘোষণা করা হয়েছে। এই পরিস্থিতি কোনো দেশের সরকারের পক্ষে একা সামাল দেওয়া সম্ভব নয়। আর কোনো দেশের পরিস্থিতি মোকাবিলার বিষয়টি শুধু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তরের বিষয় না। সরকারের সব মন্ত্রণালয় মিলে একযোগে কাজটি করতে হবে। এর জন্য সমন্বয় দরকার। আমরা সম্ভবত এর গুরুত্বটা বুঝতে পারিনি।

প্রথম আলো: এখন পরীক্ষা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অনেক ল্যাব করা হয়েছে।

জাহিদুর রহমান: দেখুন, আমি নিজে ভাইরোলজিস্ট। পিসিআর পদ্ধতি হিসেবে আধুনিক এবং গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড। তবে এটি দক্ষতার সঙ্গে করতে হবে। না হলে ভুল রিপোর্ট আসবে। এ জন্য স্পেশাল ট্রেনিং লাগে। এ ব্যাপারে আরও আগে থেকেই উদ্যোগ নেওয়া যেত। শুরুতে আমাদের বলা হয়েছিল যে এই পরীক্ষা করতে যে ল্যাব বা পরিবেশ লাগে তা শুধু আইইডিসিআরের আছে। অথচ আমার জানা মতে সরকারি খাতেই এমন অন্তত ১৫টি ল্যাব রয়েছে আর বেসরকারি খাতে রয়েছে অন্তত ২০টি। ভাইরোলজিস্টরা শুরু থেকেই সব প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে পরীক্ষার কাজ সম্প্রসারণের প্রস্তাব করেছিলেন। মূল নিয়ন্ত্রণটি আইইডিসিআরের হাতে থাকতে পারত। কিন্তু কাউকে ইনভলভ করা হয়নি। দেশে অন্তত ৬০ থেকে ৭০ জন ভাইরোলজিস্ট আছেন। নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে তাঁদের যথেষ্ট পরিমাণে সম্পৃক্ত করা হয়নি। দু-একজনকে করা হলেও তাঁদের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। এমনকি তাঁদের ট্রেনিংয়ের কাজেও লাগানো যেত। পিসিআর পদ্ধতিতে টেস্ট করার ক্ষেত্রে নমুনা সংগ্রহের বিষয়টিও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যাঁরা নমুনা সংগ্রহ করবেন তাঁদের জন্য বিশেষ ট্রেনিং দরকার ছিল। যেটা একেবারেই দায়সারাভাবে প্রদান করা হয়েছে, তা–ও খুবই স্বল্প পরিসরে। এখন পরীক্ষার জন্য ল্যাব বাড়ানো হয়েছে, এটা ইতিবাচক। কিন্তু এখানে আমি পরীক্ষার মান নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্ব দিতে চাই। এটা ঠিক না থাকলে উদ্দেশ্য ভেস্তে যাবে।

প্রথম আলো: একজন চিকিৎসক হিসেবে সাধারণ মানুষের প্রতি আপনার পরামর্শ কী?

জাহিদুর রহমান: প্রথমে যেটা বলতে চাই তা হচ্ছে এই ভাইরাসে আক্রান্তদের মধ্যে মৃত্যুহার কম। তবে সংক্রমণের মাত্রা বেশি এবং লক্ষণ ছাড়াই এটি অন্যকে সংক্রমণ করে। সে ক্ষেত্রে প্রথম কাজটি হচ্ছে ঘরে থাকতে হবে। নিয়মমতো হাত সাবান দিয়ে ধুতে হবে। হাত দিয়ে চোখ, মুখ নাক স্পর্শ করা যাবে না। আর বাধ্য না হলে কোনো শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে কেউ হাসপাতালে যাবেন না। প্রয়োজনে চিকিৎসকের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করবেন। জ্বর, সর্দি, কাশি হলে সার্জিক্যাল মাস্ক ব্যবহার করবেন। ৮০ ভাগ আক্রান্ত এমনিতেই ভালো হয়ে যাবে। আপনাকে এই সতর্কতা বাজায় রাখতে হবে যাতে আপনি সংক্রমিত না হন এবং হলেও অন্যকে যাতে সংক্রমিত না করেন। বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠ এবং অন্য কোনো রোগে যারা আক্রান্ত, তাঁদের একটু বিশেষভাবে বিচ্ছিন্ন রাখতে হবে। বাড়ির শিশুরা যাতে তাঁদের কাছে না যায়।

প্রথম আলো: সরকারের প্রতি আপনার কোনো আবেদন বা পরামর্শ আছে কি?

জাহিদুর রহমান: যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। এখন যা করতে হবে তা হচ্ছে, কমিউনিটি ট্রান্সমিশন যতটা সম্ভব সহনীয় পর্যায়ে রাখা লাগবে এবং মহামারি ঠেকাতে হবে। আক্রান্তদের মধ্যে অল্পসংখ্যককেই হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে, কিন্তু যাদের ভর্তি হতে হবে তাদের একটা বড় অংশের আইসিইউ সাপোর্ট লাগবে। বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৭ কোটি, ফলে হাসপাতাল পর্যন্ত যাদের যেতে হতে পারে সেই সংখ্যাটাও অনেক বড় হবে। ফলে জরুরি ভিত্তিতে ভেন্টিলেটর সংগ্রহের উদ্যোগ নিতে হবে। অক্সিজেনের সরবরাহ ব্যবস্থা যাতে ঠিক থাকে সেদিকে বাড়তি মনোযোগ দিতে হবে। বেসরকারি খাতের ভেন্টিলেটরসহ আইসিইউ সাপোর্টগুলো প্রস্তুত রাখতে হবে। তাদের সঙ্গে নিতে হবে। বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে নিয়মিত আলাপ আলোচনা করে তাঁদের পরামর্শ নিতে হবে। তাঁদের এই দুর্যোগে এগিয়ে আসতে আহ্বান জানাতে হবে।

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

জাহিদুর রহমান: ধন্যবাদ।