প্রবৃদ্ধি ও অসমতা নিয়ে সাম্প্রতিক বিতর্ক

গত ৫ মার্চ বণিক বার্তা আয়োজিত বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশনে বাংলাদেশ সরকারের অর্থমন্ত্রী আ. হ. ম. মুস্তফা কামাল ও প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি খাত বিষয়ক উপদেষ্টা গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রেখেছিলেন। তাঁদের বক্তব্যকে চ্যালেঞ্জ করে জনাব ইব্রাহিম খালেদ (বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর) ‘মন্ত্রী ও উপদেষ্টা কতটা সঠিক বলেছেন?’ এই শিরোনামে দৈনিক প্রথম আলোর ১১ই মার্চ সংখ্যায় একটি কলাম লেখেন।

এরপর মুস্তফা কামাল সাহেব কোনো প্রত্যুত্তর না দিলেও বেসরকারি খাত বিষয়ক উপদেষ্টা জনাব সালমান রহমান ‘আমি যতটা সঠিক কথা বলেছি’ শিরোনামে একটি বিস্তৃত প্রত্যুত্তর দেন। এই উত্তর-প্রত্যুত্তরের মাঝখানে যাতে আসল বিতর্কটি না হারিয়ে যায় সে জন্যই এই লেখার অবতারণা।

প্রকৃত বিতর্কটি কী?

অর্থমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ইব্রাহিম খালিদের অভিযোগ সহজ। তিনি বলতে চেয়েছেন বাংলাদেশের ব্যাংকগুলি কোথাও ২৮-৩০ শতাংশ সুদ আরোপ করে না, ‘সুতরাং এই কাল্পনিক সুদের হারকে আক্রমণ করে যুক্তিহীন ভাবে সুদের হার ১০ শতাংশে নামিয়ে আনা সঠিক হয়নি। এই বক্তব্যের প্রথম অংশ নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। সম্ভবত অর্থমন্ত্রী কথার কথা হিসাবেই সেটা বলে থাকবেন। কারণ সরকারি আইন অনুযায়ী বর্তমানে ঋণের ওপর সর্বোচ্চ সুদ আদায় করা হয় ‘ক্ষুদ্র ঋণের’ গরিব ঋণ গ্রহীতাদের কাছ থেকে এবং সেটাও ২৪ শতাংশের বেশি নয়। সুতরাং ২৮-৩০ শতাংশ সুদের হার কোথাও থাকলে সেটা বেআইনি। মনে রাখতে হবে আমরা এখানে অনানুষ্ঠানিক আর্থিক খাত নিয়ে কথা বলছি না। সুতরাং খালিদের প্রতিবাদ সঠিক হয়েছে। তবে খালিদের বক্তব্যের দ্বিতীয়াংশ নিয়ে কথা থাকতে পারে। ১০ শতাংশ সুদে ব্যাংক টিকবে কী টিকবে না, ঋণ ব্যবস্থাপনার ন্যূনতম খরচ কত, আমানতের ওপর কত সুদ দিতে হবে, ঋণ শোধের মাত্রা কতটুকু হতে হবে, ব্যাংক কর্মচারীরা কতখানি দক্ষ হবেন, ব্যাংকের বেতন কাঠামো ও ব্যয় বিন্যাসে কোনো অপচয় আছে কি না এগুলো সবকিছু নিয়েই সুদের যুক্তি সংগত হার নির্ধারণের আগে নানা পক্ষে-বিপক্ষে বক্তব্য চালাচালি হতে পারে। কিন্তু এ কথাটি সবাইকেই মানতে হবে যে আমাদের এমন একটি সুদের হার নির্ধারণ করতে হবে যা বহন করার মতো ক্ষমতা উদ্যোক্তাদের গড় মুনাফার হারের মধ্যেই রয়েছে এবং যা দিয়ে ব্যাংকের গড় খরচ ও সামান্য বাড়তি আয়ও বজায় রাখা সম্ভব। সেই প্রতিযোগিতামূলক হারটি যথাক্রমে ব্যাংক এবং উদ্যোক্তার গড় ব্যয় দক্ষতা ও আয় দক্ষতাকে হিসাবে নিয়েই নির্ধারণ করতে হবে যাতে উভয় তরফেই কোনো ঢিলেমি প্রশ্রয় না পায়। সেটি নিয়ে তাই আরও আলোচনা অব্যাহত থাকতে পারে, ব্যষ্টিক মাত্রায় নানা ধরনের সুদের হার প্রয়োগ করে ফলাফল বিচার করে তারপর তা ধাপে ধাপে আরও প্রসারিত, আরও কার্যকরী করাও যেতে পারে। ক্ষুদ্র ঋণের সুদের হার নির্ধারণের সময়ও এ ধরনের এক্সপেরিমেন্টের প্রয়োজন হয়েছিল।

তবে যে প্রধান বিতর্কটি সালমান রহমানের বক্তব্যকে কেন্দ্র করে হচ্ছে তা অপেক্ষাকৃত গুরুত্বপূর্ণ এবং সেটা নিয়েও বস্তু নিষ্ঠ আলোচনা হওয়া উচিত। সালমান রহমানের যে বক্তব্যটির বিরুদ্ধে জনাব ইব্রাহিম খালিদ আপত্তি তুলেছেন তা হচ্ছে:

‘উন্নয়ন হলে বৈষম্য বাড়বে’

এই প্রসঙ্গে সালমান রহমানের আপত্তি হচ্ছে এই বক্তব্য তার পুরো বক্তব্যের খণ্ডাংশ মাত্র এবং তা প্রসঙ্গ বহির্ভূত ভাবে উদ্ধৃত করা হয়েছে। আমরা যারা সেখানে উপস্থিত ছিলাম না তাদের স্বাভাবিক ভাবে কৌতূহল হবে সালমান রহমানের ‘প্রাসঙ্গিক ও সম্পূর্ণ বক্তব্যটি’ আসলে কী ছিল?

প্রথম আলোর প্রত্যুত্তরে সেই পূর্ণাঙ্গ বক্তব্যটি সালমান রহমান নিজেই তুলে ধরেছেন। সালমান রহমান লিখেছেন, “আমি বলেছিলাম, ‘বলা হচ্ছে যে [বাংলাদেশের] প্রবৃদ্ধি অসম। আমার কথা হোল, যেই দেশেই প্রবৃদ্ধি হবে, উন্নত দেশ হোক আর উন্নয়নশীল দেশ হোক, অসমতা থাকবেই। অসমতা বা বৈষম্য মূলত প্রবৃদ্ধির স্বাভাবিক ধর্ম। আপনি যদি চান, বৈষম্য ছাড়া প্রবৃদ্ধি হবে, এটা কিন্তু সম্ভব না। আপনাকে দেখতে হবে যে নিম্ন পর্যায়ে বৈষম্য ভালোর দিকে যাচ্ছে কি না। আর এ ক্ষেত্রে আপনারাই তো স্বীকার করেছেন যে দারিদ্র্যের হার কমেছে’। ইব্রাহিম খালেদ এ বিষয়ে অবতারণা করতে গিয়ে সুইডেন নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন। ”

এই বক্তব্যের প্রধান অসংগতিটি হচ্ছে ‘বৈষম্যকে’ প্রবৃদ্ধির স্বাভাবিক ধর্ম বা অবিচ্ছেদ্য ধর্ম ভাবা। এটি অর্থনীতিবিদরা এখন প্রত্যাখ্যান করেছেন। শুধু সেন এবং স্টিগলিৎসের-র মতো সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটরা নয়, বিশ্ব ব্যাংকও তাই মনে করে। এক সময় মনে করা হতো যে উন্নয়নের নিচু স্তরে যে সব দেশ রয়েছে, যেখানে কৃষিতে বা গ্রামে বহু উদ্বৃত্ত শ্রম রয়েছে, সেখানে শিল্পায়ন হবে কম মজুরিতে গ্রাম থেকে আসা অভিবাসী শ্রমিক নিয়োগের মাধ্যমে। এই ভাবেই পুঁজিপতিরা উদ্বৃত্ত শ্রমকে শোষণ করে মুনাফা অর্জন, মুনাফা সঞ্চয় ও তা বিনিয়োগ করে দেশকে শিল্পায়িত করবে, নিজেরাও ধনী হবে। এই ভাবে উন্নয়ন ও বৈষম্য পরস্পর সংযুক্ত ভাবে অগ্রসর হবে।

তবে যখন দেশটিতে ধীরে ধীরে শিল্পায়নের প্রসারের ফলে শ্রমিকের ঘাটতি দেখা দেবে তখন মজুরিও বাড়তে থাকবে এবং এক সময় শিল্পপতিরা শ্রমিক নিয়োগের চেয়ে যান্ত্রিক অগ্রগতির দিকে ঝুঁকবেন। তখনো উন্নতি হবে, এবং শ্রমের উৎপাদনশীলতা ও দাম উভয়ই বাড়ার কারণে অধিকাংশের আয় উন্নতি অধিকতর দ্রুত গতিতে বাড়তে থাকবে। ফলে উন্নয়ন হবে আবার বৈষম্যও হ্রাস পেতে থাকবে। এই সূত্র অনুযায়ী বাংলাদেশ যত দিন উন্নয়নের উচ্চতর স্তরে না পৌঁছাচ্ছে তত দিন বৈষম্য বৃদ্ধি তার জন্য একটি স্বাভাবিক ভবিতব্য!

এই যুক্তিকে অনুসরণ করেই প্রণীত হয়েছিল তথাকথিত ইনভার্টেড ইউ সেপ ‘কুজনেৎস’ কার্ভ। সম্ভবত এই তত্ত্বকে অনুসরণ করেই সালমান রহমান ভাবছেন যে বাংলাদেশ যেহেতু “লিউয়িস টানিং পয়েন্ট” বা শ্রম ঘাটতির পর্যায়ে এখনো পৌঁছায়নি সেহেতু বৈষম্য বৃদ্ধি এখানে একটি স্বাভাবিক বিষয়।

কিন্তু সবিনয়ে বলতে চাই উন্নয়ন লিটারেচারে এখন কুজনেৎস কার্ভ আর সত্য বলে বিবেচিত হয় না। আগে যখন সত্য মনে করা হতো তখন কুজনেৎস সাহেব ক্রস সেকশান ডাটা ব্যবহার করে তার সত্যতা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কিন্তু টাইম সিরিজ ডাটা প্রমাণ করেছে সঠিক নীতিমালা গ্রহণ করলে একটি দেশের পক্ষে একই সঙ্গে প্রবৃদ্ধি ও বৈষম্য হ্রাস দুইই অর্জন করা সম্ভব এবং তা সম্ভব উন্নয়নের নিম্নতর স্তরে শ্রম বহুল অবস্থাতেও। প্রথম এই উদাহরণ স্থাপন করেন সুইডেন নয় বরং জাপানের বিশেষ ধরনের পুঁজিবাদী বিকাশের কৌশল। পরে দক্ষিণ কোরিয়া ও তাইওয়ানের উদাহরণ এই সম্ভাবনার বাস্তবতাকে আরও সুদৃঢ় ভাবে প্রমাণ করে। এদেরকেই সম্মিলিতভাবে” পূর্ব-এশীয় উন্নয়ন মডেল” বলা হয়। সমাজতান্ত্রিক ভিয়েতনাম ও কিউবাতেও বৈষম্যকে নিয়ন্ত্রণে রেখে প্রবৃদ্ধির হার বৃদ্ধি সম্ভব হয়েছে। এসব দেশে “কুজনেৎস এর কার্ভ” এক ধরণের “মাইল্ড ইউ কার্ভে” পরিণত হয়েছে। অর্থাৎ প্রবৃদ্ধিও হয়েছে, বৈষম্যও হ্রাস পেয়েছে। সেই কম বৈষম্য বজায় রেখেই দীর্ঘদিন প্রবৃদ্ধি অব্যাহত আছে।

এসব মডেলের প্রবৃদ্ধির দেশে ভূমির ওপর ক্ষুদ্র চাষিদের অধিকার অক্ষুণ্ন রাখা হয়েছে (বর্গাসংস্কার ও ভূমিসংস্কারের মাধ্যমে), উদ্বৃত্ত শ্রমকে দ্রুত প্রশিক্ষণ ও সু-স্বাস্থ্য সেবা প্রদান করার উদ্যোগ রাষ্ট্র থেকেই নেওয়া হয়েছে, মজুরি বেশি নিচে নামতে দেওয়া হয়নি, শ্রমিকদের জন্য কল্যাণ মূলক বিভিন্ন সেবা নিশ্চিত করা হয়েছে, গ্রামীণ শিল্পায়ন হয়েছে এবং বৃহৎ পুঁজিপতিদের আচরণে লুট-পাটের বদলে বিনিয়োগ, সঞ্চয় ও কর প্রদানের অভ্যাস বা বাধ্যবাধকতা কঠোর ভাবে রাষ্ট্র কর্তৃক বলবৎ হয়েছে। রাষ্ট্র-নাগরিকবৃন্দ এসব নীতি প্রতিপালনে এগিয়ে এসেছেন অথবা বাধ্য হয়েছেন। প্রাথমিক বিকাশ পর্বে এসব রাষ্ট্রের সঙ্গে বৃহৎ হাউসগুলির যেসব দ্বিপক্ষীয় চুক্তি গড়ে উঠেছিল তা তারা কঠোর রাষ্ট্রের চাপে মানতে বাধ্য হয়েছিল। সরকারও দুর্নীতিতে ডুবতে পারেনি। সরকার ও ব্যবসায়ী পুঁজিপতিদেরও উভয়কেই পরস্পর সমঝে চলতে হয়েছে। সুতরাং সামগ্রিক অভিজ্ঞতায় এখন এ কথা প্রমাণিত যে উল্লিখিত নীতি কাঠামো ও রাজনৈতিক দৃঢ়তা যদি বাংলাদেশে তৈরি হয় তাহলে ক্রমবর্ধমান বৈষম্য ছাড়াই প্রবৃদ্ধি সম্ভব হবে।

সবচেয়ে স্ববিরোধী যে বক্তব্য সালমান রাহ্মানের লেখায় আমি পেয়েছি তা হচ্ছে একদিকে তিনি দুঃখ করে বলছেন যে বাংলাদেশের কর ছাড় দেওয়ার জন্য এখানে কর-জিডিপি অনুপাত কম, আবার অন্যদিকে তিনি প্রশংসা করে অর্থমন্ত্রীকে সার্টিফিকেট দিচ্ছেন যে “মেগা-প্রজেক্টে” সরকার যে সব কর ছাড় দিচ্ছে তাতে নাকি আখেরে কর-জিডিপি অনুপাত বৃদ্ধিই পাবে। হাসি পায় এই ভেবে যে প্রবৃদ্ধির জন্য যে বিনিয়োগ এখনই দরকার হবে সেই বিনিয়োগের জন্য অর্থ এখনই বৃহৎ ধনীদের কাছ থেকে জোগাড় না করে সরকারকে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে তাদেরকে আরও কর ছাড় দিতে যাতে ব্যক্তি খাত বিনিয়োগে উৎসাহিত হয়। তারপর এতে প্রবৃদ্ধি হবে, তারপর কর আহরণ করে সরকার ব্যয় নির্বাহ করবেন। এই হাস্যকর পরামর্শে সময়ের উল্টো বিচার করা হয়েছে। ভবিষ্যৎ দিয়ে বর্তমানের সমাধান করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। তদুপরি এমন ভবিষ্যৎ যা কার্যকরী কত দিনে হবে এবং কত ব্যয়ে হবে-তা খুবই অনিশ্চিত। আমরা জানি ইতিমধ্যেই প্রতিটি মেগা প্রজেক্টে সময় বেড়ে গেছে এবং খরচও বহুগুণ বেড়ে গেছে। বহুদিন ধরে বৃহৎ শিল্পে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগকারীরা এগিয়ে আসছেন না, বরং এদের মধ্যে কেউ কেউ বহু টাকা খেলাপি হচ্ছেন ও কেউ কেউ টাকা বাইরে পাচার করছেন। আমরা এও জানি যে এ দেশে বৃহৎ ব্যক্তি খাত (এসব এম এই বা কৃষি নয়) যারা সরকারি ডিলগুলো থেকে বা মেগা প্রকল্প থেকে লাভবান হচ্ছেন তারা প্রকৃত উৎপাদনশীল ম্যানুফ্যাকচারিং-এ উৎসাহী নন, বরং এদের মধ্যে কেউ কেউ বহু টাকা খেলাপি হচ্ছেন-এ রকম অভিযোগ রয়েছে। এদের কারও কারও উত্থানের ইতিহাসও ন্যক্কারজনক। পুনঃ-পুনঃ ঋণ তফসিলকরণের তলায় এখন সে সব ইতিহাস অংশত চাপা পরে গেছে। সর্বোপরি তাদের থেকে সর্বদা উপযুক্ত মাত্রায় আয় ও সম্পদ কর আদায় করাও সম্ভব হচ্ছে না। অবশ্য সালমান পরামর্শ দিচ্ছেন এদের ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধির জন্য আরও ছাড় দিতে! বাংলাদেশে যে সুশাসনের সংকটের কথা এখন সর্বত্র শোনা যাচ্ছে তার গোড়াটা এখানেই নিহিত-বৃহৎ সম্পদশালীদের ক্রমাগত প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে এবং ভাবা হচ্ছে তারা ভালো হয়ে যাবেন। ১০০ কোটি টাকা খেলাপি ঋণগ্রহীতাকে মাত্র ২ কোটি টাকা শোধ করার সুযোগ দিয়ে তার ঋণ পুনঃতফসিলের করা হচ্ছে। অবৈধ কাল টাকা দিয়ে বাড়ি বা জমি কিনলে তা সাদা করে ফেলার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে।

ওই সভায় যখন ঋণ-খেলাপির মাত্রা নিয়ে অভিযোগ তোলা হোল, তখন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরও ভারতের ঋণ খেলাপির মাত্রার সঙ্গে বাংলাদেশের ঋণ খেলাপির মাত্রার তুলনা করলেন। ইব্রাহিম খালিদ অবশ্য সঠিক ভাবেই তার লেখায় নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়ার ভালো উদাহরণগুলি দেখিয়ে বলেছেন যে “ভারত ডুবেছে বলে কি আমরাও ডুবব। ” এই ঋণ খেলাপির দিকটা নিয়ে কোনো আলোচনা কিন্তু সালমান রহমানের লেখায় উত্থাপন করা হয়নি। তবু ইব্রাহিম খালিদের সঙ্গে আমি শুধু এটুকু যোগ করব সুশাসনের নিয়ম লঙ্ঘন করে এলিট ঋণ গ্রহীতাদের ঋণ যদি রাইট অফ বা পুনঃ পুনঃ তফসিলিকরণ না হতো তাহলে আজ ঋণ খেলাপির মাত্রা কোথায় উঠে যেত তা বলা মুশকিল। তখন নিঃসন্দেহে তা ভারতের চেয়ে অনেক ওপরে থাকত।

সালমানের লেখায় শেষে গিয়ে ওয়ার্ল্ড ডেভলাপমেন্ট ইন্ডিকেটর এর “গিনি সংক্রান্ত” আন্তর্জাতিক তুলনামূলক তথ্যের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে পৃথিবীর অনেক দেশের থেকেই বাংলাদেশের গিনি কম। সেখানে বাংলাদেশের গিনি মাত্রা দেখানো হয়েছে মাত্র .৩২। ইব্রাহিম খালিদ ও এ দেশের অর্থনীতিবিদরা, এমনকি বাংলাদেশের পরিকল্পনা কমিশনের লেখা বিভিন্ন কাগজপত্রে এটা দেখানো হয় .৪৮। সুতরাং এখানে আমরা বলব ডউও এর তথ্য নিয়ে আরেকটু গভীরে ঘেঁটে দেখতে হবে। তবে যদি বাংলাদেশের গিনি সহগের গতি প্রবণতার কথা আমরা বলি, বা পালমা অনুপাতের কথাও বলি, তাহলে কি বিশ্ব ব্যাংকের ডাব্লিউডিআই এর তথ্য, কি বিবিএস এর তথ্য, উভয় বিচারেই দেখা যাবে নিঃসন্দেহে আমাদের দেশে বৈষম্য শুধু বাড়ছে না, তা আজ সর্বত্র মানুষের চোখে দৃষ্টি কটু হয়ে যাচ্ছে। দরিদ্র লোকের দারিদ্র্য কমছে বা নিম্ন পর্যায়ে যে একবেলা খেত সে দুবেলা খাচ্ছে এই তথ্যে যারা খুশি হয়ে দাবি করেন উন্নয়ন হচ্ছে এবং নিম্ন পর্যায়ে বৈষম্য কমছে তারা আসলে চরম আয় বৃদ্ধি এবং আপেক্ষিক আয় বৃদ্ধির তফাৎটাই ঠিকমতো বোঝেন না। গরিবের আয় বৃদ্ধি পাচ্ছে ঠিকই কিন্তু শম্বুক গতিতে, আর ধনীর আয় বাড়ছে অশ্বের গতিতে, তাই বাংলাদেশে দারিদ্র্য কমলেও বৈষম্য বৃদ্ধি অব্যাহত আছে--এ কথা অনস্বীকার্য। আর এই বৈষম্য বৃদ্ধির জন্য উচ্চ প্রবৃদ্ধি দায়ী নয়, দায়ী ভুল কর নীতি, সামাজিক খাতে ব্যয় স্বল্পতা এবং সুশাসনের অভাব।