জনস্বাস্থ্য শিক্ষার গুরুত্ব আমরা বুঝতে পারছি কি?

কোভিড-১৯ সংক্রমণের পর করণীয় এবং করণীয় নয়, এমন সব বিষয় নিয়ে বিস্তর আলোচনা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞেরা পরামর্শ দিচ্ছেন। চিকিৎসক, জনস্বাস্থ্যকর্মী, রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ সমাজবিদসহ হাজারো মানুষের পরামর্শ ও নির্দেশনা আমরা মিডিয়ার কল্যাণে জানতে পারছি। সবচেয়ে সরব আমাদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো। ট্রল, কার্টুন, ব্যঙ্গ ও অন্যান্য চিত্রায়ণের মাধ্যমে উপস্থাপিত উপভোগ্য পরামর্শগুলো আমরা দেখি আর আমাদের করণীয় ঠিক করি কিংবা বিভ্রান্ত হই। যা হোক, অধিকাংশ পরামর্শই সুন্দর এবং গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়।

মহামারির এই সময়টাতে যে যে প্রতিষ্ঠানের তথ্য ও পরামর্শগুলোর দিকে আমি তাকিয়ে থাকি তার একটি হলো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং অন্যটি বাংলাদেশের আইইডিসিআর। চলমান সংকটে আইইডিসিআরের ভূমিকা এবং অবদান নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে বিস্তর আলোচনা হতে পারে, যা এই লেখার মুখ্য বিষয় নয়। কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্যের মুরুব্বি বলে পরিচিত সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় অবস্থিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার করোনাভাইরাস পরিস্থিতি মোকাবিলায় করণীয় পদক্ষেপ ও পরামর্শ সব সময়ই তাৎপর্যপূর্ণ। বিশ্বের যেকোনো স্বাস্থ্য সংকটে উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় সংস্থাটি সবার আস্থা অর্জন করেছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক তেদরোস আধানোম গেব্রেয়াসুসের সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ, পরামর্শ ও নির্দেশনাগুলো গভীরভাবে আলোচনার দাবি রাখে। আমি প্রচণ্ড আগ্রহ নিয়ে ভদ্রলোকের প্রতিটি পরামর্শ অনুধাবন করার চেষ্টা করি। এক ভিডিও বার্তায় গেব্রেয়াসুস বলেন, ‘কোভিড-১৯ কিছু মানুষের জীবনে আমূল পরিবর্তন এনেছে। প্রচণ্ড ভয়াবহতার মধ্যেও ভাইরাসটি আমাদের মধ্যে আশা এবং সাহসের সঞ্চার করেছে। আইসোলেশনে থাকাকালীন তিনি প্রত্যেকের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যকে একটু ঘষামাজা করতে বলেছেন। স্বাস্থ্যগত টিপসসহ বিভিন্ন উপদেশ দিয়েছেন।

সবচেয়ে কার্যকর দিকনির্দেশনাগুলো দিয়েছেন গত ২৫ মার্চ রাতে, যেখানে বিশ্বব্যাপী লকডাউনের পদক্ষেপকে করোনা প্রতিরোধে আমাদের দ্বিতীয় সুযোগ হিসেবে বলেছেন। সত্যিকার অর্থেই তাই। আমরা প্রথম সুযোগ হাতছাড়া করেছি আর এখন দ্বিতীয় সুযোগ কাজে লাগাতে না পারলে তৃতীয় সুযোগ কত মূল্য দিয়ে পেতে হবে, সেই প্রশ্ন অনেক বড় ও ভয়াবহ। তিনি এই দ্বিতীয় সুযোগ কার্যকর করতে ছয়টি সুপারিশ করেছেন। এক. স্বাস্থ্যসেবা ও জনস্বাস্থ্যে জনবল বাড়ানো ও প্রশিক্ষণ; দুই. প্রতিটি সন্দেহভাজন রোগী শনাক্তে কার্যকর ব্যবস্থা বাস্তবায়ন; তিন. পরীক্ষার সরঞ্জাম উৎপাদন, সক্ষমতা ও সহজলভ্যতা বাড়ানো; চার. আইসোলেশন ও চিকিৎসার জায়গা চিহ্নিত করা ও পর্যাপ্ত প্রয়োজনীয় উপকরণ নিশ্চিতকরণ; পাঁচ. রোগীর সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের চিহ্নিত ও কোয়ারেন্টিন করা; ছয়. সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ ও দমনে সরকারের পুরো ব্যবস্থার পুনরায় মনোযোগী হওয়া।

একটু লক্ষ করলেই বোঝা যায়, পরামর্শগুলো সর্বজনীন। অর্থাৎ প্রতিটি সংক্রামক ব্যাধি সম্পর্কিত স্বাস্থ্যগত দুর্যোগেই এই ছয়টি বিষয় আমাদের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করবে এবং তা প্রথম সুযোগেই নিশ্চিতভাবে করবে।

জনস্বাস্থ্যের শিক্ষক হিসেবে আমি শুধু প্রথম পরামর্শের ওপরে দৃষ্টিপাত করছি। প্রথমত, এই স্বাস্থ্যসেবা ও জনস্বাস্থ্য-সংশ্লিষ্ট জনগণ বলতে আমরা কী বুঝি? এরা কারা? কীভাবে সেবা দেয়? কোথায় এবং কখন দেয়? প্রশ্নগুলোর উত্তর বোঝা খুবই জরুরি। জনবল বাড়ানো এবং প্রশিক্ষণের বিষয়ে পরে আসছি। আলোচ্য পরামর্শটি নিঃসন্দেহে সব ধরনের জাতীয় ও বৈশ্বিক স্বাস্থ্য-সংশ্লিষ্ট সংকট এবং দুর্যোগকালীন সময়ে করণীয়র তালিকায় সব সময় এবং সর্বপ্রথম স্থান পাওয়ার যোগ্য। করোনাভাইরাস মোকাবিলায় বাংলাদেশে এই মুহূর্তে সব চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীসহ অনেকেই এখন এই জনবলের অন্তর্ভুক্ত, যাঁরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রশিক্ষণসহ কিংবা প্রশিক্ষণ ছাড়া কাজ করে যাচ্ছেন। কিন্তু তাঁরা আদৌ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান কর্তৃক কথিত স্বাস্থ্যসেবা ও জনস্বাস্থ্য জনবল এর আওতায় পড়েন না। তাঁরা পুরো স্বাস্থ্য ব্যবস্থার একটি বিশেষ শাখার প্রতিনিধিত্ব করেন। যাকে বলা হয় টারশিয়ারি হেলথ সার্ভিসেস অর্থাৎ হাসপাতালকেন্দ্রিক স্বাস্থ্যসেবা।

মানুষ যখন রোগাক্রান্ত হয় তখন হাসপাতালের দ্বারস্থ হয় আরোগ্য লাভের জন্য। আর রোগাক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে যাওয়ার আগেই প্রতিরোধের ব্যবস্থা গড়ে তুলে মোকাবিলা করাই স্বাস্থ্যসেবা এবং জনস্বাস্থ্যের মূলনীতি। আজ যে মহান চিকিৎসকেরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে করোনা মোকাবিলায় কাজ করছেন তাঁরা সবাই এই একই কথা বলবেন। তাঁরা নিশ্চিত বলবেন যে জনস্বাস্থ্যবিষয়ক কাজ আর তাঁদের কাজ এক নয়। মূল কাজ হচ্ছে কমিউনিটি লেভেলে একটি অবিচ্ছিন্ন সুন্দর স্বাস্থ্য কাঠামো তৈরি করা, যাতে পুরো দেশের জনগণের স্বাস্থ্যঝুঁকি হ্রাস ও সুস্বাস্থ্যের নির্ভুল ফর্মুলা থাকবে। গেব্রেয়াসুস স্বাস্থ্যসেবা এবং জনস্বাস্থ্য জনবল বলতে এটিই বুঝিয়েছেন।

ধরা যাক, ঢাকা শহরের যত খোলা জায়গা এবং মাঠ আছে, সব জায়গায় সর্বাধুনিক সুবিধাসহ হাসপাতাল তৈরি করা হলো। এখন প্রশ্ন হলো, এই প্রাপ্তিতে জনস্বাস্থ্য কতটুকু লাভবান হবে। এই মহাযজ্ঞে বিশাল জনগোষ্ঠীর সার্বিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা কতটুকু সম্ভব? যার উত্তর, বিদ্যমান স্বাস্থ্যসেবার ঘাটতি এবং চিকিৎসা প্রাপ্তিতে জনগণের হাহাকার এবং দীর্ঘশ্বাসের মধ্যে রয়েছে। আজকের বাংলাদেশে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে কমিউনিটি লেভেলে যাঁরা কাজ করছেন তাঁদের অধিকাংশই জনস্বাস্থ্যসংশ্লিষ্ট জনবল নয়। আর এ জন্যই হাসপাতালের বাইরে করোনা প্রতিরোধ অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং এবং চলমান যুদ্ধে আমরা আরও খারাপ পরিস্থিতির আশঙ্কা করি।

দেশে সর্বমোট কতজন জনস্বাস্থ্যকর্মী আছেন তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। জনস্বাস্থ্যকর্মী তাঁরাই হবেন, যাঁদের মধ্যে সুনির্দিষ্ট প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও প্রশিক্ষণ থাকবে। এখন প্রশ্ন হলো, দেশে বিদ্যমান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে জনস্বাস্থ্য শিক্ষার যথাযথ অবকাঠামো আছে কি না? সহজ উত্তর হলো, নেই। বেশ কিছু নামকরা হাসপাতালে নামমাত্র জনস্বাস্থ্য বিভাগ এবং বিভাগীয় কার্যক্রম থাকলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই নগণ্য। সরকারি এবং বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোরও একই অবস্থা। জনস্বাস্থ্য বিভাগ খুবই দুর্বল এবং অপেক্ষাকৃত কম মেধার জনবল নিয়ে গঠিত ও পরিচালিত।

নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে, শুধু নিপসম ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে জনস্বাস্থ্য শিক্ষা পরিচালিত হয়ে আসছে। পাশাপাশি হাতে গোনা কয়েকটি সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে জনস্বাস্থ্য শিক্ষা কার্যক্রম চলছে, যার অধিকাংশই মোটাদাগে বাণিজ্যিক। এ ক্ষেত্রে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে ব্যতিক্রমী বলা যায়, যেখানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে জনস্বাস্থ্য শিক্ষা কার্যক্রম চলছে। মোদ্দাকথা, এই সীমিতসংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয় গ্র্যাজুয়েট দিয়ে এত বিশাল জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং জনস্বাস্থ্য সেবা—দুটোই প্রায় অসম্ভব।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পাশাপাশি যে প্রতিষ্ঠানটির তথ্য-উপাত্ত, গবেষণালব্ধ বিশ্লেষণ এবং দিকনির্দেশনা সারা বিশ্বের কাছে গ্রহণযোগ্য, তার নাম জনস হপকিনস ইউনিভার্সিটির স্কুল অব পাবলিক হেলথ। কোভিড-১৯ মোকাবিলায় এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি নিরলস কাজ করে চলছে। আমাদের সরকার কেন শুধু আইইডিসিআরের ওপর নির্ভরশীল? আমাদেরও তো রয়েছে অনেক ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। কেন আমরা বৈশ্বিক দৃষ্টান্তকে উদাহরণ হিসেবে বিবেচনা করব না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান তার পরামর্শগুলোর ভেতরে প্রথম স্বাস্থ্যসেবা ও জনস্বাস্থ্যের জনবল বাড়ানোর কথা বলেছেন, তাঁদের প্রশিক্ষণের কথা বলেছেন। ওই পরামর্শকে প্রাধান্য দিন এবং অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কিছু সুদূরপ্রসারী এবং দূরদর্শীমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করুন।

এক. সব সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিকেল কলেজগুলোতে জনস্বাস্থ্য শিক্ষা বাধ্যতামূলক করুন। বিজ্ঞানভিত্তিক সব সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইনস্টিটিউট অব পাবলিক হেলথ প্রতিষ্ঠা করুন। ইউজিসি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে। এখনই সময় স্বল্প পরিসরে হলেও শুরু করতে হবে। স্নাতকোত্তর শিক্ষার পাশাপাশি স্নাতক পর্যায়েও কারিকুলাম ডেভেলপ করে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করতে হবে, যা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় অত্যন্ত সফলভাবে গত ৯ বছর ধরে করে আসছে।
জনস্বাস্থ্য শিক্ষার বিভিন্ন ডিসিপ্লিন এবং বিষয় আছে। সুতরাং, বিষয়ভিত্তিকভাবে এবং সক্ষমতার বিচারে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আলাদা করা যেতে পারে। এ জন্য প্রয়োজন একটি টাস্কফোর্স গঠন করা। ইউজিসিকে উদ্যোগী হতে হবে। সরকারি নির্দেশনার অপেক্ষায় না থেকে ইউজিসিকে দায়িত্ব নিতে হবে। মোট জনসংখ্যার অনুপাতে প্রয়োজনীয় জনস্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যা বিবেচনায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আসনসংখ্যা বণ্টন করতে হবে। সরকারি কর্ম কমিশন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে এসব গ্র্যাজুয়েটের চাকরি নিশ্চিত করতে হবে। ভবিষ্যৎ রোগ প্রতিরোধে জনস্বাস্থ্য জনবলের বিকল্প এই মুহূর্তে আর কিছুই নেই, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান অত্যন্ত সঠিকভাবে উপলব্ধি করেছেন।

দুই. এই সরকারের আমলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পঠিত সব বিষয়ের সঙ্গে বাংলা শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এটি প্রশংসাযোগ্য একটি পদক্ষেপ। পাশাপাশি ইংরেজি ও কম্পিউটার শিক্ষার একটি বেসিক কোর্স অধিকাংশ বিভাগেই পঠিত হয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এই তালিকা আরও লম্বা। মূল লক্ষ্য হলো, নিজ বিষয়ের বাইরে গিয়ে জীবনমুখী এবং রাষ্ট্রীয় ও সামাজিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ কিছু বিষয়ের শিক্ষাগ্রহণ। একে জেনারেল এডুকেশন (জিইডি) অর্থাৎ সাধারণ শিক্ষা কোর্সও বলা হয়। বাংলাদেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে পঠিত বিষয়গুলোর পাশাপাশি বাধ্যতামূলকভাবে জনস্বাস্থ্য শিক্ষার একটি পূর্ণ কোর্স রাখা যেতে পারে।

তিন. এই মুহূর্তে আমাদের একমাত্র ভরসার কেন্দ্র আইইডিসিআর। কিন্তু আইইডিসিআরের বিশ্বস্ত সহযোগী হতে পারে অনেক প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধিতে আগ্রহী হতে হবে। সরকারি-বেসরকারিভাবে বাংলাদেশে শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে যেখানে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, জিনবিজ্ঞানী, মাইক্রোবায়োলজিস্ট, ভাইরোলজিস্ট রসায়নবিদ, ফার্মাসিস্টসহ শত শত শিক্ষক ও গবেষক রয়েছেন। আমি প্রায় নিশ্চিতভাবে জানি, প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রায় প্রতিটিতে এমন গবেষণাগার ও গবেষক রয়েছেন, যেখানে এবং যাঁরা ভাইরাসটি শনাক্ত করতে সমর্থ। আরটি-পিসিআর প্রায় সব গবেষণাগারে আছে। গবেষণাগারের বায়োসেফটি লেবেল ৩ হলে এখানে রোগনির্ণয় সম্ভব। তা সম্ভব না হলেও এই বিশাল জনশক্তি আইইডিসিআরকে রোগ নির্ণয়ে সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী সহযোগিতা করতে পারে। সরকারকে আন্তরিক হতে হবে এবং এ-সংক্রান্ত গবেষণায় পারদর্শী গবেষকদের একটি তালিকা করতে হবে। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে কাজে লাগাতে হবে।

চার. জনগণের সার্বিক সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত না করে একটি জাতির উন্নয়নশীল কিংবা উন্নত হওয়ার বাস্তবতা অনেকটাই অলীক ও অর্থহীন। বিশ্বের অনেক দেশে ১৮-২১ বছর বয়সের সময় কিংবা পরে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সামরিক প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক। আমরা ভাগ্যবান যে এই প্রশিক্ষণ আমাদের নিতে হয় না। প্রশিক্ষণ ছাড়াই আমরা এ দেশকে ৯ মাসে স্বাধীন করেছি। কিন্তু সেখানে শত্রু দৃশ্যমান ছিল। অদৃশ্য শত্রু রোগজীবাণু-ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়ার সঙ্গে যুদ্ধটা একটু অন্য রকম। প্রকৃত জ্ঞান, পরিচ্ছন্ন জীবনাচার, অভিজ্ঞতা ও করণীয় জানা অত্যন্ত প্রয়োজন এই যুদ্ধে, যা নিয়মিত প্রশিক্ষণের মাধ্যমেই আয়ত্ত করা সম্ভব। বিপুল জনগোষ্ঠীর এই দেশের সবাইকে বয়সভিত্তিকভাবে কিংবা শিক্ষাগত যোগ্যতার ভিত্তিতে কিংবা জ্ঞানের প্রয়োজনীয়তার ভিত্তিতে বিভিন্ন মেয়াদে স্বাস্থ্যসেবা ও জনস্বাস্থ্যবিষয়ক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক করা।

আমি নিশ্চিত, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সারা দেশে এখন সর্বসাধারণের মানসিকতায় আতঙ্কের পাশাপাশি একটা মানসিক দৃঢ়তাও কাজ করছে। বিলম্বে হলেও মোকাবিলার প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকার। জানতে পেরেছি, ৬৪ জেলা পর্যায়ে এবং ১০০টি উপজেলার কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। ওই প্রশিক্ষণ বিদ্যমান পরিস্থিতিতে নিশ্চয়ই ভালো কিছুর ইঙ্গিত। কিন্তু নিশ্চিতভাবে বলা যায়, ওই প্রশিক্ষণ চলমান সংকটের জন্য কোনোভাবেই যথেষ্ট নয়। দুর্যোগ মোকাবিলায় আমাদের সর্বজনীন ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা রাখতে হবে, যাতে ভবিষ্যৎ যেকোনো স্বাস্থ্যঝুঁকি সফলতার সঙ্গে মোকাবিলা করা যায়। এর অংশ হিসেবে বাধ্যতামূলক জনস্বাস্থ্য শিক্ষার বিকল্প আর কিছুই নেই।

ড. মো. তাজউদ্দিন সিকদার, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিকস বিভাগের সভাপতি ও সহযোগী অধ্যাপক