জগৎ ভরমিয়া দেখি একই মায়ের পুত

অফিস–আদালত বন্ধ, কিন্তু অনেকেরই ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে।
অফিস–আদালত বন্ধ, কিন্তু অনেকেরই ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে।

সত্তরের দশকের শেষ দিকে ঢাকা–টাঙ্গাইল মহাসড়কের পাশে এক চা–দোকানে মিশনারি ধরনের দুজন বিদেশির সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তাঁরা ইতালীয় নাগরিক। একটি প্রতিষ্ঠানের ত্রাণকর্মী। উত্তরবঙ্গের মঙ্গাকবলিত এলাকায় কাজ করেন। কথা প্রসঙ্গে আমি তাঁদের বললাম, 

ইতালির দুর্দিনেও আমরা আপনাদের সাহায্য করেছি। কথাটা শুনে তাঁরা এতটা অবাক হলেন যে চায়ের কাপে চুমুক দিতে ভুলে গেলেন। বাংলাদেশ কী করে ইতালিকে সাহায্য দেয়?

একজন জানতে চাইলেন, সে সাহায্য কবে দেওয়া হয়েছিল? বললাম, এখন থেকে এক শ বছর আগে। তা শুনে আরও তাজ্জব হলেন। এখনই যে দেশের এমন অবস্থা, এক শ বছর আগে তারা ইতালিকে সাহায্য দিয়েছিল, এ তো মাথা খারাপ লোকের কথা।

১৮৭০–এর দশকে ইতালিতে কলেরায় হাজার হাজার মানুষ মারা যায়। সঙ্গে সঙ্গে দেখা দেয় খাদ্যাভাব। নবাব স্যার সলিমুল্লাহর দাদা নবাব আবদুল গনি এক হাজার মণ চাল পাঠিয়েছিলেন ইতালিতে। কাছাকাছি সময়েই ইতালিতে ভূমিকম্পে শত শত হতাহত হয় এবং গৃহহীন হয় লাখ লাখ মানুষ। ঢাকার নবাব বাহাদুর ৪ হাজার ১০০ টাকা সাহায্য দেন ইতালি সরকারকে। সেই টাকা দিয়ে দেড় হাজার মণ চাল কিনে পাঠান।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে সবচেয়ে শক্তিশালী দেশের এক হীনচেতা পররাষ্ট্রমন্ত্রী অজ্ঞতাবশত বলেছিলেন বাংলাদেশ ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’। সবার ক্ষেত্রে উপমা–উৎপ্রেক্ষা ব্যবহার সংগত নয়। কৃষিজাত দ্রব্যে বাংলাদেশের ঝুড়ি হাজার বছর ছিল উপচে পড়ার মতো। তার অর্থ এই নয় যে এখানে গরিব মানুষ ছিল না। শায়েস্তা খাঁর সময়েও এ দেশে অনেক বাড়িতে অনেক দিন চুলা জ্বলেনি, সেটা অন্য বিষয়।

সেকালে যোগাযোগব্যবস্থা এখনকার মতো উন্নত ছিল না। আন্তর্জাতিক যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম ছিল নৌপথ অর্থাৎ সামুদ্রিক জাহাজ। তখন পৃথিবীর কোনো দেশে যদি মহামারি, দুর্ভিক্ষ বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিত, বাঙালি সাহায্য সামগ্রী নিয়ে এগিয়ে গেছে। তখন বুড়িগঙ্গা ছিল গভীর এবং ঢাকা ছিল একটি নদীবন্দর। দেড় শ বছর আগে ইরানে দুর্ভিক্ষে বহু মানুষ মারা যায়। নবাব আবদুল গনি তিন হাজার টাকা দান করেন এবং সে টাকা দিয়ে প্রায় দেড় হাজার মণ চাল পাঠানো হয়। ঢাকার নবাব আয়ারল্যান্ডকেই সবচেয়ে বেশি ত্রাণ দিয়েছেন। একবার ডাবলিনের মানুষকে বাঁচানোর জন্য ৩ হাজার ৯০ টাকার দেড় হাজার মণ চাল–আটা পাঠান।

দ্বিতীয়বার নবাব আবদুল গনি আয়ারল্যান্ডের দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের জন্য ডাচেস অব মার্লবারোকে পাঠান ৩ হাজার ৯৯ টাকা। ১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দে তুরস্কে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে নবাব খাজা আহসানউল্লাহ ৫০০ মণ চাল পাঠান। বুলগেরিয়ার দুর্ভিক্ষ–মহামারিতে ১ হাজার ৫০০ মণ চাল–গম দিয়ে জাহাজ পাঠান। ১৮৭১ সালে ফ্রান্স–জার্মানি যুদ্ধে দুই দেশেরই মানুষ না খেয়ে মারা যাচ্ছিল। নবাব আবদুল গনি পাঁচ হাজার টাকা দান করেন। সেই টাকায় আড়াই হাজার মণ চাল–গম নিয়ে কয়েকটি জাহাজ ফরাসি বন্দরে যায়। একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পশ্চিমের যেসব দেশ বাঙালি শরণার্থীদের ত্রাণ দিয়েছে, তারা জানত না এক শ বছর আগে আমরাও তাদের দিয়েছি এবং যথেষ্টই দিয়েছি।

আমাদের প্রতিবেশীদেরও আমরা সাহায্য করেছি। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব–পূর্ব চীনের দুর্ভিক্ষে ভারতবাসী তথা বাঙালি সাহায্য নিয়ে সাংহাই বন্দরে গেছে। বাঙালি কবির কথা তো কথার কথা ছিল না: ‘নানান বরন গাভিরে ভাই একই রকম দুধ,/ জগৎ ভরমিয়া দেখলাম একই মায়ের পুত।’

আজ সমগ্র পৃথিবীই এক চরম পরীক্ষার মুখোমুখি। কাকতালীয়ভাবে সবচেয়ে বেশি বিপন্ন জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ক্ষমতাধর স্থায়ী সদস্যদেশগুলো। সবাই আপন প্রাণ বাঁচাতে হিমশিম খাচ্ছে। কে কাকে সাহায্য করবে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের নিজের শক্তির ওপর নির্ভর করা ছাড়া আর কোনো ভরসা নেই। আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে যা পাওয়া যাবে, তা প্রয়োজনের তুলনায় তেমন কিছু নয়। উন্নত দেশগুলো চিকিৎসার ওপরেই জোর দিচ্ছে, আমাদের কোটি কোটি মানুষের জন্য জোর দিতে হবে পেটের ভাতের ওপর।
এক মাসেই কয়েক কোটি মানুষের অর্ধাহার–অনাহারের সমস্যা মোকাবিলা করতে হচ্ছে। সরকারের একার পক্ষে কয়েক কোটি রুজি–রোজগারহীন মানুষকে খাবার দেওয়া সম্ভব নয়।

অসুখে মৃত্যু আর অনাহারে মৃত্যু—জীবনের জন্য দুটোই সমান। তফাত হলো এই যে সংক্রামক রোগের মহামারিতে সবচেয়ে ক্ষমতাবান ও বিত্তবানও মারা যেতে পারেন, অনাহারে মারা যায় শুধু দরিদ্ররা। সে জন্য মহামারির পরপর সঞ্চয়ের বিষয়েও ভাবতে হয়।

অর্থপিশাচ, লোভী, স্বার্থপর ও আত্মপ্রচারপ্রবণ মানুষ আমাদের সমাজে চিরকাল ছিল এবং আছে। অন্যদিকে পরোপকারী ও নিঃস্বার্থ সমাজসেবায় আগ্রহী মানুষেরও অভাব নেই। বিভিন্ন দুর্যোগে আমাদের যুবসমাজের একটি শ্রেণি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এগিয়ে এসেছে। আশির দশকে বন্যায় ত্রাণকাজ চালাতে গিয়ে আমাদের কিশোর–তরুণ কেউ কেউ জীবন দিয়েছেন। করোনা প্রাদুর্ভাবের পর থেকেও বহু তরুণ ব্যক্তিগতভাবে অথবা তাঁদের ছোট সংগঠনের পক্ষ থেকে সীমিত সাধ্যে দরিদ্রদের মধ্যে মাস্ক, স্যানিটাইজার প্রভৃতি বিতরণ করছেন। এসব খুব বড় কাজ।

একশ্রেণির বাঙালি যেকোনো অস্বাভাবিক পরিস্থিতির সদ্ব্যবহার করায় দক্ষ। তের শ পঞ্চাশের দুর্ভিক্ষে লাখ লাখ মানুষ একমুঠো ভাত না পেয়ে এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যায়। রাস্তায় পড়ে থাকত হাজারো লাশ। বহু পরিবার না খেয়ে মরেনি বটে, ভিটেমাটি–ঘটিবাটি বিক্রি করে কোনোমতে জীবন ধারণ করে। কিন্তু সেই সময়ই সমাজের একটি শ্রেণি ভাগ্য গড়ে নিয়েছে। পরবর্তী জীবনে তাঁরা কেউ দানবীর বলে পরিচিতি পেয়েছেন। একাত্তরেও পাকিস্তানি জান্তার দালালদের অনেকে সোনাদানা লুট করে বিত্তবান হয়েছে।

অনেকে নাম ফাটানোর জন্য ত্রাণ দিয়ে বর্তমান করোনা দুর্যোগের সুযোগ নেবেন এবং সফল হবেন। পত্রিকায় ছবি ছাপা হবে, টেলিভিশনের পর্দায় ঝলমল করবে ছবি। মানুষ বাহবা দেবে। তাঁদের দানকে অস্বীকার করব না। কিন্তু যে ব্যক্তি সন্ধ্যার পর নিশ্চুপে ২০–৩০ পোঁটলা খিচুড়ি নিয়ে পথচারী পারাপারের ব্রিজের নিচে শুয়ে থাকা পথশিশু বা ছিন্নমূল মানুষকে দিচ্ছেন, তাঁকে তো সালাম না জানিয়ে পারা যায় না। কারণ, এর বেশি দেওয়ার শক্তি তাঁর নেই। লকডাউনের পর থেকেই এ ধরনের অনেকেই গরিব মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন সারা দেশে।

আজ যদি বাংলাদেশ করোনামুক্ত থাকত, তাহলে আমরা অতীতের মতো যথাসাধ্য ইরান, ইতালি, ফ্রান্স, স্পেনকে সাহায্য করতাম। সেখানে যাঁরা আক্রান্ত, তাঁরা আমাদের মতোই ‘একই মায়ের পুত’। কিন্তু এই মুহূর্তে যাঁদের সংগতি আছে, তাঁদের নিজেদের দেশের বিত্তহীনদের পাশে থাকাই আশু কর্তব্য।

অফিস–আদালত বন্ধ থাকায় কর্মচারী–কর্মকর্তারা ঘরে বসে থাকার সুবিধা ভোগ করছেন। অনেকের টিভি দেখে সময় কাটছে। এর মধ্যেই স্বাস্থ্যকর্মী, চিকিৎসক, নার্স, সংবাদকর্মী, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, পুলিশ, সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য, যাঁরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দায়িত্ব পালন করছেন, তাঁদের প্রতি আমাদের গভীর কৃতজ্ঞতা। তাঁরা সুস্থ থাকুন এবং দেশ দুর্যোগযুক্ত হোক, এই প্রার্থনা।

সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক