কাদের সমর্থন-সহায়তায় ছিলেন খুনি মাজেদ?

আবদুল মাজেদ। ছবি: বাসস
আবদুল মাজেদ। ছবি: বাসস

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মস্বীকৃত ও মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত খুনি সাবেক সেনা কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন (বরখাস্ত) আবদুল মাজেদ গ্রেপ্তার হওয়ার খবরটি আশাপ্রদ। একজন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি শাস্তি ভোগ করবেন, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তাঁর গ্রেপ্তার হওয়ার পর যেই প্রশ্নটি সামনে এসেছে তা হলো, তিনি এত দিন কোথায় ছিলেন? কীভাবে ছিলেন?

আদালতে সরকারি কৌঁসুলির প্রশ্নের জবাবে আবদুল মাজেদ বলেছেন, ২৩/২৪ বছর তিনি ভারতের কলকাতায় ছিলেন। গত সোমবার গ্রেপ্তার করার পর মঙ্গলবার ফৌজদারি কার্যবিধি ৫৪ ধারায় তাঁকে ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট। পরে তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয় এবং বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। বুধবার মাজেদকে আদালতে দ্বিতীয় দফা হাজির করে মৃত্যুদণ্ডের পরোয়ানা জারি করা হয়। 


সিটিটিসি ইউনিটের ভাষ্য অনুযায়ী, রাত সাড়ে তিনটায় একটি রিকশায় তাঁকে সন্দেহজনকভাবে ঘোরাফেরা করতে দেখে পুলিশ তাঁর পরিচয় জানতে চায়। তাঁর কথাবার্তা অসংলগ্ন ছিল। পুলিশের জেরায় একপর্যায়ে স্বীকার করেন, তিনিই বঙ্গবন্ধু হত্যার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি আবদুল মাজেদ।

মাজেদ গ্রেপ্তার হওয়ার পর এখন বঙ্গবন্ধু হত্যার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পাঁচ খুনি বিদেশে পালিয়ে আছেন। তাঁরা হলেন খন্দকার আবদুর রশীদ, শরিফুল হক ডালিম, মোসলেম উদ্দিন, এস এইচ এম বি নূর চৌধুরী ও এ এম রাশেদ চৌধুরী। এর মধ্যে রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে ও নূর চৌধুরী কানাডায় আছেন। বাকি তিনজন কোথায় আছেন, সে সম্পর্কে সরকারের কাছে নিশ্চিত তথ্য নেই।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট একদল বিপথগামী সেনাসদস্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে; যার নেতৃত্বে ছিলেন কর্নেল (অব.) আবদুর রশীদ ও কর্নেল (অব.) সৈয়দ ফারুকুর রহমান। ঘাতকেরা বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্য খন্দকার মোশতাক আহমদকে রাষ্ট্রপতি পদে বাসান এবং সেনাপ্রধান কে এম সফিউল্লাহকে সরিয়ে জিয়াউর রহমানকে নতুন সেনাপ্রধান করেন। হত্যাকাণ্ডের পর মোশতাক ১৫ আগস্টের ঘাতকদের দায়মুক্তি দিয়ে (ইনডেমনিটি) অধ্যাদেশ জারি করেন। ১৯৭৯ সালে জিয়াউর রহমান সংসদে সেটি অনুমোদন করলে তা আইনে পরিণত হয়। এরপর এরশাদ ও খালেদা জিয়ার শাসনামলেও সেই আইন বহাল ছিল। ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর দায়মুক্তি আইন বাতিল করে। ফলে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের বাধা অপসারিত হয়।

উল্লেখ্য, জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় থাকাকালে বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিদের বিচার না করে বিদেশে বিভিন্ন বাংলাদেশ মিশনে চাকরি দেন। ক্যাপ্টেন মাজেদের পদায়ন হয়েছিল সেনেগালে। ১৯৮০ সালে জিয়া তাঁকে দেশে ফিরিয়ে এনে সেনাবাহিনী থেকে অবসর দিয়ে উপসচিব হিসেবে জনপ্রশাসনে নিয়োগ দেন। এরশাদ ও খালেদা জিয়ার আমলেও তিনি সরকারি চাকরিতে বহাল ছিলেন।

১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে তিনি প্রথমে আত্মগোপন করেন, পরে পালিয়ে বিদেশে চলে যান। এরপর বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার প্রক্রিয়াও শুরু হয়। ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর তৎকালীন ঢাকার দায়রা জজ কাজী গোলাম রসুল বঙ্গবন্ধুকে হত্যার দায়ে ১৫ জনকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়ে রায় দেন। ২০০০ সালের ১৪ ডিসেম্বর হাইকোর্ট দ্বিধাবিভক্ত রায় দেন। ২০০১ সালের ৩০ এপ্রিল হাইকোর্টের তৃতীয় বেঞ্চ ১২ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে তিনজনকে খালাস দেন। এরপর ১২ আসামির মধ্যে প্রথমে চারজন ও পরে এক আসামি আপিল করেন। বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর উচ্চ আদালতে বিচারপ্রক্রিয়া থেমে যায়। ২০০৭ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগের বিচারপতি মো. তাফাজ্জাল ইসলামের নেতৃত্বাধীন তিন বিচারপতির বেঞ্চ মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পাঁচ আসামির লিভ টু আপিল শুনানির জন্য গ্রহণ করেন। আপিলের অনুমতির প্রায় দুই বছর পর ২০০৯ সালের অক্টোবরে শুনানি শুরু হয়। ২০০৯ সালের ১৯ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ পাঁচ আসামির আপিল খারিজ করেন। ফলে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার দায়ে হাইকোর্টের দেওয়া ১২ খুনির মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল থাকে।

২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি দিবাগত রাতে সৈয়দ ফারুক রহমান, বজলুল হুদা, এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান ও মুহিউদ্দিন আহমেদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। ওই রায় কার্যকরের আগেই ২০০২ সালে পলাতক অবস্থায় জিম্বাবুয়েতে মারা যান আসামি আজিজ পাশা। বাকি ছয় আসামি বিদেশে পলাতক ছিলেন। সরকার বিদেশে পলাতক খুনিদের ফিরিয়ে আনার বিষয়ে কূটনৈতিক তৎপরতা চালালেও খুব সুবিধা করতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বরাবর পলাতক খুনি রাশেদ চৌধুরীকে ফেরত দেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়। অপর পক্ষের কাছ থেকে কোনো প্রতিশ্রুতি পাওয়া যায়নি। কানাডায় পলাতক নূর চৌধুরীকে ফিরিয়ে আনার বিষয়েও বিভিন্ন উদ্যোগের কথা শোনা গেছে।

বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার চূড়ান্ত রায় হয়েছিল ২০০৯ সালে। কিন্তু দীর্ঘ সময়েও ক্যাপ্টেন মাজেদ কোথায় আছেন জানা যাচ্ছিল না। বুধবার আনন্দবাজারের শিরোনাম ছিল, ‘বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী দুই দশক লুকিয়ে ছিলেন কলকাতায়; অবশেষে ঢাকায় ধরা পড়লেন।’ এতে আরও বলা হয়, নব্বই দশকের মাঝামাঝি আবদুল মাজেদ প্রথমে বাংলাদেশ থেকে ভারতে পালিয়ে যান বলে জানা গেছে, পরে ভারতের বাইরে গিয়ে আবারও ভারতে ফিরে আসেন। বিভিন্ন রাজ্যে ঘুরে কলকাতায় অবস্থান করছিলেন তিনি। কলকাতায় থাকার সময় মাজেদ তেমন কিছু করতেন না। বাংলাদেশে থাকা পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগযোগও ছিল নিয়মিত। মার্চের মাঝামাঝি ময়মনসিংহের সীমান্ত দিয়ে দেশে ফিরে আসেন তিনি। দেশে ফেরার পর মিরপুরের বাসায় ওঠেন। (আনন্দবাজার, ৮ এপ্রিল ২০২০)

ইত্তেফাকের খবর অনুযায়ী, ২০১৮ সাল পর্যন্ত পুলিশ সদর দপ্তরের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো (এনসিবি) বিভাগের কাছে মাজেদের বিষয়ে কোনো তথ্য ছিল না। অপর একটি সূত্র জানায়, আবদুল মাজেদ কলকাতায় কোথায় ছিলেন তার বিস্তারিত তথ্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সংগ্রহ করেছে। ২০১৯ সালের আগস্টে প্রথমবারের মতো এনসিবির সহকারী মহাপুলিশ পরিদর্শক (এআইজি) মহিউল ইসলাম সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, সর্বশেষ মাজেদের অবস্থান ভারত ও পাকিস্তানে ছিল বলে শোনা যায়। তখন দুই দেশকে চিঠিও দেওয়া হয়। জবাবে ভারত বলেছিল, মাজেদ তাদের দেশে নেই। তবে পাকিস্তান কোনো জবাব দেয়নি। (ইত্তেফাক, ৮ এপ্রিল, ২০২০)

তাহলে প্রশ্ন ওঠে, কীভাবে তিনি সীমান্ত পার হলেন? তিনি কি বৈধভাবে প্রবেশ করেছেন? তা হলে তিনি কোন দেশের পাসপোর্ট ব্যবহার করতেন? অবৈধভাবে ঢুকে থাকলে দুই দেশের সীমান্তরক্ষীরা কী করলেন? আবদুল মাজেদ নামে পাসপোর্ট ব্যবহারের সুযোগ নেই। তাঁর নামে ইন্টারপোলের মাধ্যমে আগেই রেড অ্যালার্ট জারি করা হয়েছিল? আবার পাসপোর্ট-ভিসা ছাড়া অন্য দেশে কারও পক্ষে দীর্ঘদিন অবস্থান করাও অসম্ভব? তাহলে কি তিনি পরিচয় গোপন করে অন্য নামে পাসপোর্ট-ভিসা করেছিলেন? কারা তাঁর এই অবৈধ কাজে সহায়তা করেছেন? তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, মাজেদ ভারতের বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার চোখ এড়িয়ে এত বছর থাকলেন কীভাবে?

বুধবার কলকাতার এক সাংবাদিককে টেলিফোন করে তাঁর সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী মাজেদ সম্পর্কে তাঁদের কিছু জানা ছিল না। তবে খবর প্রকাশিত হওয়ার পর একজন বলেছেন, তিনি বারাসাতের একটি বাসায় কিছুদিন ছিলেন বলে তাঁকে একজন জানিয়েছেন।

ভারত সরকার যদি তাঁকে পুশব্যাক করে থাকে, তাহলে এত দিন কেন করল না? এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে একাধিক সাবেক কূটনীতিক বলেন, এ রকম একজন চিহ্নিত ও ইন্টারপোলে সতর্ক করে দেওয়া ব্যক্তি সম্পর্কে ভারতের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দারা কিছুই জানতেন না, এটা বিস্ময়কর। আর তাঁদের নজর এড়িয়ে মাজেদের পক্ষে যদি এত দিন পালিয়ে থাকা সম্ভব হয়ে থাকে, তাহলে ভারতের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ফাঁক রয়ে গেছে বলেই মানতে হবে। কেননা, একজন আত্মস্বীকৃত খুনি এভাবে পালিয়ে থাকতে পারলে জঙ্গিসহ অন্য দুর্ধর্ষ অপরাধীদের অবস্থান করাও অসম্ভব নয়। নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের আসামি নুর হোসেন কলকাতায় পালিয়ে যাওয়ার কিছুদিন পরই সেখানে পুলিশের হাতে ধরা পড়েন এবং তারা পুশ ব্যাক করে। বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমদ অচেতন অবস্থায় সীমান্তে পড়ে থাকলে মেঘালয়ের পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে। এখনো তিনি সেখানে আছেন এবং তাঁর বিরুদ্ধে মামলা বিচারাধীন।

অন্য পলাতক আসামিদের মধ্যে আবদুর রশীদ পাকিস্তান বা মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশে আছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বাংলাদেশের একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে তাঁর একটি সাক্ষাৎকারের অংশবিশেষ প্রচারিত হয়েছিল। দুই পর্বে নেওয়া সাক্ষাৎকারের প্রথম পর্ব প্রচার হওয়ার পরই প্রচণ্ড প্রতিক্রিয়া দেখা দেওয়ায় দ্বিতীয় পর্ব আর প্রচারিত হয়নি। তৎকালীন ডিজিএফআইয়ের শীর্ষ কর্মকর্তার সঙ্গে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি আবদুর রশীদের মেয়ের সখ্য ছিল। সেই সুবাদে সাক্ষাৎকারটি নেওয়া হয়েছিল বলে তখন রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক গুঞ্জন ছিল।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, মাজেদের ক্ষেত্রে রায় কার্যকর করতে আইনগত কোনো বাধা নেই। সর্বোচ্চ আদালত চূড়ান্ত রায়ে তাঁকেসহ ১২ জনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন। ইতিমধ্যে আদালত মৃত্যুদণ্ডের পরোয়ানা জারি করেছেন। আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলেই রায় কার্যকর হবে। তবে আইনজীবীরা বলছেন, রায় কার্যকর করার আগে তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমাভিক্ষার সুযোগ পাবেন।