উচ্ছিষ্ট নষ্ট করবেন না, আশপাশের পশুপাখি কষ্টে আছে

সিলেট নগরের গোয়াইটুলার হজরত সৈয়দ চাষনিপীর (রহ.)-এর মাজার এলাকায় কয়েক শ বানরের বাস। করোনা পরিস্থিতিতে মাজারে প্রবেশ বন্ধ। এ কারণে বানরগুলো অভুক্ত হয়ে পড়েছে। এই বানরদের খাবার দিতে এগিয়ে আসছেন মানুষজন। সিলেট, ৫ এপ্রিল। ছবি: আনিস মাহমুদ
সিলেট নগরের গোয়াইটুলার হজরত সৈয়দ চাষনিপীর (রহ.)-এর মাজার এলাকায় কয়েক শ বানরের বাস। করোনা পরিস্থিতিতে মাজারে প্রবেশ বন্ধ। এ কারণে বানরগুলো অভুক্ত হয়ে পড়েছে। এই বানরদের খাবার দিতে এগিয়ে আসছেন মানুষজন। সিলেট, ৫ এপ্রিল। ছবি: আনিস মাহমুদ

কয়েক দিন ধরে যে ভাবনাটি নিয়ে ব্যক্তি পর্যায়ে আলাপ করছিলাম, তা রাজশাহী চিড়িয়াখানায় ক্ষুধার্ত কুকুরের হানা ও পাঁচটি হরিণশাবক সাবাড় করার ঘটনার (প্রথম আলো, ৩ এপ্রিল ২০২০) মধ্য দিয়ে এত তাড়াতাড়ি বাস্তব হয়ে ধরা দেবে, ভাবতে পারিনি। আমার ভাবনাটি ছিল, এ দুর্যোগে আমাদের চারপাশে বিচরণকারী প্রাণিকুলের খাদ্যব্যবস্থাও তো ভেঙে পড়েছে। ওদের কী হবে?

এর মধ্যেই রাজশাহীতে ভয়ংকর ঘটনাটি ঘটল। এটি অনেকেরই মনের চোখ খুলে দেওয়ার মতো ঘটনা।

বিশ্বব্যাপী করোনা দুর্যোগে খাদ্যনিরাপত্তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছে। নানা দেশ, জাতি ও সমাজ নিজ নিজ সামর্থ্য ও সংস্কৃতি অনুসরণ করে মানুষের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করছে। মূলত দুটি কারণে মানুষের সঙ্গে সঙ্গে অন্য প্রাণিকুলের জন্যও খাদ্য সরবরাহের বিষয়টি বাস্তবভিত্তিকভাবে নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

প্রথম কারণ হচ্ছে, আমাদের সমাজে গৃহপালিত ও পোষা পশুপাখির পাশাপাশি অন্য অনেক প্রাণীর অবস্থান ও অস্তিত্ব রয়েছে, যারা সাধারণত মানুষের উচ্ছিষ্ট খেয়ে বাঁচে। তারা গৃহপালিত বা পোষা না হলেও আমাদের গৃহের আশপাশেই থাকে। এখন যেহেতু মানব খাদ্যের উচ্ছিষ্ট হ্রাস পেয়েছে, তাই তারা স্বাভাবিকভাবেই অভুক্ত ও ক্ষুধার্ত থাকছে। ক্ষুধা মানুষ-পশু সবাইকে কাতর ও ক্ষুব্ধ করে। রাজশাহীতে চারটা কুকুর যা করেছে, তাতে সাময়িক বিস্মিত হলেও এটি অভাবিত নয়।

বনের না হলেও আবাসস্থলের কাছাকাছি থাকা শিয়ালের সংঘবদ্ধ দল কর্তৃক গোয়ালঘর, মুরগির খামার এবং মানবশিশু আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা আছে। আছে ক্ষুধায় মরিয়া হয়ে বাঘ, বানর-হনুমানের আক্রমণ। তাই এখন শহরে হোটেল-রেস্তোরাঁ বন্ধ থাকায় রাস্তাঘাট ও ডাস্টবিনে উচ্ছিষ্ট হ্রাস পেয়েছে। তাই আশপাশের ঘুরে বেড়ানো কুকুর-বিড়াল নিঃসন্দেহে খাদ্যসংকটে পড়েছে। তাদের নিয়েও একটু ভাবতে হবে।

দ্বিতীয় একটি কারণেও আমাদের আশপাশে লোকালয়ে বা লোকালয়ের নিকটবর্তী স্থানে থাকা পশুপাখিদের জীবাণুমুক্ত খাদ্যদানের বা খাদ্য উৎস সৃষ্টির কথা ভাবতে হবে। এখানে শুধু ‘অ্যানিমেল রাইট’ কথা নয়, মানুষের নিরাপদ জীবন ও রোগ সংক্রমণ রোধ করার জন্যও তা প্রয়োজন। পৃথিবীব্যাপী এটি স্বীকৃত যে পশু-পাখিসহ নানা প্রাণীর মাধ্যমে মানুষের মধ্যে কিছু কিছু মারাত্মক রোগের সংক্রমণ ঘটে। ইবোলা, ম্যাডকাউ, রেবিস, সালমনেলাসহ অনেক মারাত্মক রোগের সঙ্গে পশুপাখির সম্পর্ক আছে। এর মধ্যে প্রিয় গৃহপালিত বা পোষা পশুপাখিও অন্তর্ভুক্ত। পোষা পশুপাখিকে টিকা-ইনজেকশন দিয়ে নিরাপদ করা হয়, কিন্তু লোকালয়ে ঘুরে বেড়ানো প্রাণিকুলের জন্য তা করা হয় না। বর্তমানকালের করোনাভাইরাসের সঙ্গেও বন্য বাদুড়-সরীসৃপের সম্পর্কের (পুরোপুরি সমর্থিত নয়) কথা শোনা যায়।

যেসব পশুপাখি আমাদের উচ্ছিষ্ট খেয়ে জীবনধারণ করে, সে উচ্ছিষ্টগুলো (যেমন মাছের কাঁটা, মাংসের হাড়, বাসি ভাত-তরি-তরকারি, রুটি প্রভৃতি) এখনো ওই সব পশু খাবে। কিন্তু সেগুলো আমরা ময়লা আবর্জনার সঙ্গে না মিশিয়ে পচা-বাসি হওয়ার আগেই ওদের খাওয়াতে পারি। একটু সচেতন ও সংবেদনশীল হলে পচানো বা ময়লার সঙ্গে না মিশিয়ে একটি নির্দিষ্ট সময়ে একটি পাত্রে করে তাদের খেতে দিলে তারা ঠিকই খেয়ে যাবে এবং নির্দিষ্ট সময়েই এসে খেয়ে যাবে। আমাদের কাছে অখাদ্য উচ্ছিষ্ট হলেও সেগুলোই তাদের খাবার। এ খাবারগুলোকে আমরা কেন ময়লা আবর্জনার সঙ্গে মেশাব?

ময়লার সঙ্গে পচা-বাসি হাড়-কাঁটা-উচ্ছিষ্ট খেয়ে পশুরা অসুস্থ হলে সে অসুস্থতায় মানুষও আক্রান্ত হতে পারে। খাদ্যটা প্রায়ই উচ্ছিষ্ট হিসেবে হলেও পশুকুল ভালোভাবে পাক। নিরাপদ পানি পশুপাখিরা একেবারেই পায় না। তাই বাড়ির পাশে কোনো একটি নিরাপদ স্থানে একটি পানির বাটি রেখে দেওয়া যায়। কাজটি করতে আমাদের কোনো খরচ নেই, শুধু দরকার একটি সংবেদনশীল মন এবং একটি নতুন অভ্যাস সৃষ্টির চেষ্টামাত্র। তাহলে আমাদের আশপাশের ঘুরে বেড়ানো লা-ওয়ারিশ পশুগুলো ভালো থাকবে। কুকুর-বিড়াল ছাড়াও আরও কিছু পশুপাখি আছে, যারা আমাদের কাছাকাছি থাকে। তাদের খাদ্য জোগানোর প্রাকৃতিক উৎসগুলো নষ্ট না করে রক্ষা করতে হবে। কাক, ময়না, বক, মাছরাঙা, বানর, হনুমান, শিয়াল, বেজি, গুইসাপসহ এ রকম অনেক পাখি, পশু ও সরীসৃপ জাতীয় প্রাণী রয়েছে। ওদের খাবারের কিছু প্রাকৃতিক উৎস আছে, তা অপরিকল্পিতভাবে উজাড় না করে রক্ষা করতে হবে।

বন বিভাগের সহায়তায় একসময় ঢাকা সিটি করপোরেশনের পুরান ঢাকার বানরদের খাদ্য সরবরাহের একটি প্রকল্প ছিল। তেমনি যশোর অঞ্চলে হনুমানদের সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগে খাবার দেওয়া হতো। নাটোরের শ্রী যশোদন প্রামাণিক ঢাকায় বিভিন্ন অফিসে ধরনা দিতেন এবং পুরান ঢাকায় গিয়ে বানরের খাওয়া তদারক করতেন। অন্য আর কেউ এ কাজটি করছেন কি না, জানি না। অনেকে ব্যক্তি-উদ্যোগে পাখিদের মুড়ি-বিস্কুট খাওয়ান। প্রাণিকুলকে অভুক্ত দশা থেকে রক্ষার জন্য কিছু সহৃদয় ব্যক্তির উদ্যোগ এখন খুব বেশি প্রয়োজন। একটি সভ্য সমাজ যখন খাদ্যনিরাপত্তার কথা চিন্তা করে, তাতে শুধু মানুষই থাকবে তা নয়, পশুপাখিদের কথাও ভাবতে হয়। তা শুধু পশুপাখিদের প্রতি মায়াবশত নয়, নিজেদের অর্থাৎ মানুষের সার্বিক নিরাপত্তাও এর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

ড. তোফায়েল আহমেদ: শিক্ষাবিদ, স্থানীয় শাসন বিশেষজ্ঞ ও কুমিল্লার ব্রিটানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য