চিকিৎসাসেবী কি সংক্রমণের উৎস হবেন?

খুলনা মেডিকেল কলেজের আইসিইউ ভবনের ফ্লু কর্নারে সর্দি, কাশি, জ্বরে আক্রান্ত রোগী দেখছেন চিকিৎসকেরা
খুলনা মেডিকেল কলেজের আইসিইউ ভবনের ফ্লু কর্নারে সর্দি, কাশি, জ্বরে আক্রান্ত রোগী দেখছেন চিকিৎসকেরা

দেশের সবচেয়ে বড় জনস্বাস্থ্য সংকটের সময়ে আমাদের চিকিৎসকেরা হঠাৎ করেই খলনায়ক (ভিলেন) হয়ে গেছেন। বিশ্বের অন্যান্য দেশে অবশ্য কোভিড-১৯ প্রতিরোধের লড়াইয়ের প্রথম সারিতে থাকা চিকিৎসক, নার্স, প্রাথমিক সেবাদানকারী এবং অন্যান্য 

চিকিৎসাসেবা দানকারীদের নায়কের মর্যাদা দেওয়া হচ্ছে। নিয়ম করে ঘরে ঘরে অবরুদ্ধ থাকা নাগরিকেরা রাত্রিবেলায় হাততালি দিয়ে এবং বাদ্য বাজিয়ে এসব চিকিৎসাসেবীদের ধন্যবাদ জানাচ্ছেন। 

আমাদের দেশের ছবিটা আলাদা। সাধারণ শ্বাসকষ্ট, সর্দি, কাশি ও জ্বর (শ্বাসকষ্ট) উপসর্গের কথা শুনলেই ক্লিনিকের নগর ঢাকার সব ক্লিনিক-হাসপাতাল-চেম্বারের দরজা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। চিকিৎসা না পেয়ে বেশ কয়েকজনের মৃত্যুর খবর গণমাধ্যমেও প্রকাশিত
হয়েছে। সাধারণ সময়ে ডাক্তারদের দেখা পেতে যত লম্বা লাইনে অপেক্ষা করতে হয়, কিংবা তদবিরের প্রয়োজন হয়, করোনাকালে তার চেয়েও দুষ্প্রাপ্য হয়ে গেছে চিকিৎসাসেবা। প্রশ্ন হচ্ছে এই পরিস্থিতি কীভাবে তৈরি হলো? 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সুমন চাকমার মৃত্যুর জন্য তিনি যেসব হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা পাননি, হয়তো সেসব জায়গার চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে হয়তো ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু আরও যে শত শত মানুষ চিকিৎসা পাননি, তাঁদের দুর্ভোগের দায় কে নেবে? বিষয়টি তো এমন নয় যে ডাক্তারদের সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সিদ্ধান্তে কোনো ধর্মঘটের মতো কিছু একটা ঘটেছে। দেশের হাসপাতালগুলো সরকারের আইনকানুন মানে না, তেমনও নয়। তাহলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা কী ছিল? তাদের কাছে জবাবদিহি চাইবে কে? স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সুমন চাকমার মৃত্যুর ঘটনার পর ক্লিনিক মালিকদের উদ্দেশে প্রশ্ন রেখেছেন, কেন মানুষ চিকিৎসা পাচ্ছে না। অথচ তার আগে প্রায় ১০ দিন ধরে এই অবস্থা চললেও তখন তাঁর দপ্তরের কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি। 

কোভিড-১৯ মহামারি মোকাবিলায় সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে যে পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে, তাতে বেসরকারি হাসপাতালগুলোর কোনো ভূমিকা রাখার সুযোগ রাখা হয়নি। কিন্তু করোনার লক্ষণযুক্ত রোগীদের শনাক্তকরণ পরীক্ষা এবং চিকিৎসার জন্য সরকারের নির্ধারিত হটলাইনে ফোন করা এবং নির্দিষ্ট হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। করোনার লক্ষণ যেহেতু সাধারণ শ্বাসকষ্ট এবং সর্দি-কাশি-জ্বরের মতো, সেহেতু তাঁদের চিকিৎসায় ঝুঁকি অনেক বেশি। সেই ঝুঁকির খেসারত দিতে ঢাকার একাধিক বেসরকারি হাসপাতাল লকডাউন করার ঘটনাও ঘটেছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের দুই সপ্তাহের জন্য স্বেচ্ছা অন্তরীণ থাকতে হয়েছে। ফলে অন্যরা যে একটু সাবধানতার নীতি অনুসরণ করেছেন, সেটা কি একেবারেই অযৌক্তিক? করোনার প্রকোপ দেখা দিলে বেসরকারি হাসপাতালগুলো কতটা সেবা দেবে এবং কী ধরনের সুরক্ষাব্যবস্থা নেবে, সে বিষয়ে যথাযথ নির্দেশনা দেওয়ার দায়িত্ব কার? 

ডাক্তার এবং চিকিৎসাসেবীদের এই সাবধানতার বিষয়টি কি শুধুই স্বার্থপরতা? অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন যে ডাক্তাররা সুরক্ষা সামগ্রী (পিপিই) না পাওয়ার অজুহাতে চিকিৎসা না করে তাঁদের পেশাগত শপথ ভঙ্গ করেছেন। স্বাভাবিক অবস্থায় অসুস্থকে চিকিৎসাসেবা না দিলে তাঁদের পেশাজীবনের শপথ ভঙ্গ হয় সন্দেহ নেই। কিন্তু মহামারির ক্ষেত্রে বিষয়টি কি অভিন্ন? ইতালি এবং স্পেনের অভিজ্ঞতা বলছে, চিকিৎসকেরা করোনা চিকিৎসার সময় পর্যাপ্ত এবং প্রয়োজনীয় সুরক্ষা নিশ্চিত করতে না পারায় শুধু নিজেই যে আক্রান্ত হয়েছেন, তা নয়। তাঁরা অন্যদের মধ্যে সংক্রমণেরও কারণ হয়েছেন (এঁদেরকে বলা হচ্ছে সুপারস্প্রেডার)। একজন ডাক্তার সংক্রমিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রোগ ধরা পড়বে না, পরবর্তী ১৪ দিনের যেকোনো সময় তা লক্ষণীয় হবে। কিন্তু একজন কোভিড-১৯ ভাইরাসের বাহক গড়ে প্রায় চার শ জনকে সংক্রমিত করতে পারেন এবং সেই হিসাবে একজন ডাক্তার কিংবা নার্স কতজন রোগীর মধ্যে তা ছড়াতে পারেন, তা সহজেই অনুমেয়। ডাক্তারসহ চিকিৎসাসেবীরা যাঁদের মধ্যে সংক্রমণ ঘটাবেন, তাঁরা এমনিতেই কোনো না কোনো রোগে ভুগছেন এবং সেই অসুস্থতার কারণে করোনার সংক্রমণ তাঁদের জীবনকে অনেক বেশি ঝুঁকির মধ্যে ফেলবে। এমনকি, সুস্থ হতে থাকা রোগীকেও তাঁরা নতুন করে সংক্রমণের ঝুঁকিতে ফেলতে পারেন। 

এখন সরকারি হাসপাতালগুলো, বিশেষ করে করোনা চিকিৎসার জন্য নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর চিকিৎসাসেবীদের মধ্যে যেসব ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী দেওয়া হয়েছে, সেগুলোর গুণগত মান নিয়েও গুরুতর প্রশ্ন উঠেছে। ঢাকার হাসপাতালেই অভিযোগ উঠেছে তাঁদের পিপিই নামে যা দেওয়া হয়েছে সেই গাউন এবং পায়জামায় পানি ঢাললে তা চুইয়ে পড়ে। অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা হচ্ছে এমন কাপড় বা পদার্থে এটি তৈরি হতে হবে, যার মধ্য দিয়ে কোনো তরল পদার্থ গলে যেতে পারবে না (সারা দেশে জনবলের চার গুণ পিপিই বিতরণ, প্রথম আলো, ৭ এপ্রিল, ২০২০)। এন-৯৫ মাস্ক নিয়েও একই ঘটনা ঘটেছে। ঢাকার হাসপাতালেই দেখা গেছে এন-৯৫ মাস্কের প্যাকেটে সাধারণ মানের মাস্ক। গণমাধ্যমের অনুসন্ধানে এই অনিয়মের খবর এলে বলা হয়েছে তা পাল্টে দেওয়া হবে। কিন্তু পরে বলা হয়েছে সার্জিক্যাল মাস্কেই কাজ চলবে। 

৭ এপ্রিল বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্বাস্থ্যকর্মী বিভাগের সমন্বয়কারী জর্জিও কমেটো এই পিপিইর ঘাটতিকে একটি বড় বৈশ্বিক বাজার ব্যবস্থার ব্যর্থতা বলে বর্ণনা করেছেন। আর ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল অব নার্সেসের প্রধান হাওয়ার্ড ক্যাটন বলেছেন, স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে উচ্চহারে সংক্রমণ এবং মৃত্যুর কারণ পিপিইর ঘাটতি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে স্পেনে প্রায় ৯ শতাংশ এবং ইতালিতে প্রায় ১৪ শতাংশ স্বাস্থ্যকর্মী সংক্রমণের শিকার হয়েছেন। ৩১ মার্চে পাওয়া হিসাবে ইতালিতে শুধু ডাক্তারই মারা গেছেন ৬৬ জন। 

পুরো মার্চ মাসজুড়ে করোনার প্রকোপ মোকাবিলায় সরকার প্রস্তুত বলে দাবি করে এসেছে। কিন্তু ৬ এপ্রিল হঠাৎ করেই স্বাস্থ্যমন্ত্রী বললেন, করোনা মোকাবিলায় কোনো সমন্বয় নেই। কোথায় কী সিদ্ধান্ত হয়, তা তিনি জানেন না। তাঁর এই প্রকাশ্য স্বীকারোক্তি সংকটকালে না হয়ে স্বাভাবিক সময়ে হলে তিনি স্বপদে বহাল থাকতেন কি না সন্দেহ। এখন তাঁকে অপসারণ করলে সমন্বয়হীনতার অভিযোগটি সত্য বলে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার সম্ভাবনাই তাঁর পদের সুরক্ষা দিয়েছে কি না, এমন প্রশ্ন সহজে নাকচ করে দেওয়া যাবে না। সব সিদ্ধান্ত যে তাঁর দপ্তর কিংবা সংক্রামক রোগ প্রতিরোধের জাতীয় উপদেষ্টা কমিটিতে হয় না, তা কিন্তু অনেক আগেই আমরা জেনে গেছি। ক্ষমতাসীন দলের সহযোগী পেশাজীবী বিভিন্ন গোষ্ঠীর নানা ধরনের প্রভাবের কথাও সবারই জানা। এসব পেশাজীবী গোষ্ঠীর নেতারা দলীয় নেতাদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে টিভির পর্দায় জোর গলায় বলেছেন, করোনা বাংলাদেশের জন্য কোনো সমস্যা হবে না। করোনা মোকাবিলার সক্ষমতা তাঁদের রয়েছে। অথচ তাঁরা একটু দায়িত্বশীল হয়ে সরকারকে সৎ পরামর্শ দিলে হয়তো আরেকটু ভালো প্রস্তুতি দেখা যেত। 

এত ব্যাপক আকারের মহামারি মোকাবিলার মতো অবকাঠামো স্বাস্থ্য খাতে কোনো দেশেরই থাকার কথা নয়। সুতরাং কৌশলগত প্রস্তুতি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার যথাযথ গুরুত্ব পেলে আমাদের বেসরকারি খাতের শক্তি-সামর্থ্যকেও কাজে লাগানো প্রয়োজন। আগামী সপ্তাহগুলোতে দেশে সংক্রমণ শনাক্ত করার হার এবং নিবিড় পরিচর্যাসহ গুরুতর ও জটিল চিকিৎসাসেবা দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা বাড়বে। সংক্রমণ নাটকীয় হারে বৃদ্ধি পেলে রোগীর চাপ সামলাতে বেসরকারি উদ্যোগে বড় আকারের অস্থায়ী হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার কথা উঠেছিল। কিন্তু সেই হাসপাতালের সঙ্গে প্রয়োজন হবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্বাস্থ্যসেবী। রাতারাতি হাজার হাজার স্বাস্থ্যকর্মী তৈরি হবে না। বিশ্বের সব দেশে অবসরে যাওয়া স্বাস্থ্যকর্মীদের আবার ফিরিয়ে আনা হয়েছে। বাংলাদেশে অবশ্য ডাক্তাররা খুব একটা অবসরে যান না। সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়ে বেসরকারি খাতে কাজ করেন। তাঁদের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা কাজে লাগানোর কোনো উদ্যোগ এখনো দৃশ্যমান নয়। এটিও সমন্বয়হীনতার ফল কি না, কে জানে। 

মহামারির বিস্তার নিয়ন্ত্রণ ও মোকাবিলায় সব মানুষের অংশগ্রহণ ও সহযোগিতার জন্য প্রয়োজন সরকারের নীতিকৌশলের স্বচ্ছতা এবং অবাধ তথ্যপ্রবাহ। কিন্তু সে ক্ষেত্রেও পরিস্থিতি হতাশাজনক। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর আর আইইডিসিআরের সংবাদ সম্মেলনগুলোতে কিছু সংখ্যা প্রকাশের বাইরে তেমন কোনো প্রশ্নের জবাব মেলে না। এখন আবার সেটাও বন্ধ করে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। শুধু সংবাদ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নীতি কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। মানুষের মনে তৈরি হওয়া প্রশ্নগুলোর উত্তর না মিললে তা শুধু সন্দেহ-সংশয় এবং গুজবের প্রসার ঘটাবে। 

কামাল আহমেদ সাংবাদিক