শক্তিশালী স্থানীয় অর্থনীতি ছাড়া পথ নেই

করোনাভাইরাসের অভিঘাত মোকাবেলায় বিশ্ব যখন বেশ বিপর্যস্ত, বিভিন্ন দেশের সরকারগুলো যখন নিজ নিজ পুনরুদ্ধার প্রকল্পের প্রাধিকার বিবেচনায় অনেকটা হিমশিম খাচ্ছে, তখন আবার বেশ কিছু দেশে ২০০৮ সালের বিশ্বমন্দার মতো রক্ষণশীলতারও উত্থান ঘটছে বলে অনেকেই মনে করছেন।

এই মুহূর্তে এই রক্ষণশীলতা শুধু নিত্যপ্রয়োজনীয় বা জীবনরক্ষাকারী চিকিৎসা সরঞ্জাম নিয়ে। কিন্তু এটা আরও অনেক জায়গায় ছড়িয়ে যেতে পারে বলে অনেকের বিশ্বাস। ওষুধ শিল্পের তীর্থস্থান হিসেবে পরিচিত সুইজারল্যান্ড, মূলধনী বা বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি নির্মাণের কেন্দ্র জার্মানি, শিল্পের কাচামালের মহাস্থান চীন এবং উন্নত গবেষণার তীর্থস্থল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন করোনা মহামারির আঘাতে পর্যদুস্ত, তখন এমনকি বিশ্বায়ন বা বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থা বা সাপ্লাই চেইন নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। অথচ বিশ্বায়নকে আমরা অনেকটা চূড়ান্ত পরিণতি বা ‘ওয়ান ওয়ে ট্রাফিক’ হিসেবে ধরে নিয়েছিলাম। সেই বিশ্বায়নের যুগেও মাস্কের যোগান ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য জার্মানি যখন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নাখোশ কিংবা কানাডার ট্রুডো যখন যুক্তরাষ্ট্র থেকে অতিপ্রয়োজনীয় চিকিৎসা-সরঞ্জাম পাঠানোতে বাধা দেওয়ায় যতটুকু ভদ্রভাবে পারা যায় যুক্তরাষ্ট্রকে সতর্ক করতে চাচ্ছেন, তখন রক্ষণশীলতা আবার আগে-পরে দানা বাধতে পারে।

আজকে বিশ্বায়নের যুগে তাই রফতানি-জিডিপি অনুপাত ভিয়েতনামের চাইতে অনেক কম হলেও বাংলাদেশেও রফতানি খাতের প্রণোদনা বা দেশি ও আন্তর্জাতিক তারল্য সরবরাহের বিরাট প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে বা বিবেচিত হচ্ছে। একইভাবে গুরুত্বপূর্ণ অন্তঃর্মুখী রেমিট্যান্সও। সনাতনী অর্থনীতিবিদদের অনেকেই মনে করেন বা নিকট অতীত পর্যন্ত মনে করতেন, রফতানি ও রেমিট্যান্স প্রবাহ ঠিক থাকলে আর তার পরিণতিতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ঠিক থাকলে খাদ্য বা অনান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের সংকটেও মাথা উঁচু করে চলা যায়। চীনসহ সারা বিশ্বে একটি প্রতিযোগিতাপূর্ণ সরবরাহ ব্যবস্থার সহজলভ্যতাই হয়তো তার কারণ। কিন্তু অপ্রত্যাশিতভাবে করোনা মহামারির প্রাদুর্ভাব ঘটার ফলে সেই বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার অবস্থা দেখা দিয়েছে। বেশি অর্থ দিয়েও যখন পণ্যের যোগান মিলছে না, তখন স্বভাবতই একটি শক্তিশালী অভ্যন্তরীণ বা স্থানীয় অর্থনীতির গুরুত্বের বিষয়টি অনুধাবিত হচ্ছে। নীতি-বিশ্লেষকদের অধিকাংশই দৈনন্দিন সরবরাহের জন্য স্থানীয় উৎসের দিকেও মনোযোগ দিচ্ছেন।

বাংলাদেশের মতো একটি বিকাশমান দেশ কীভাবে গড়ে তুলবে সেই শক্তিশালী অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি? সে জন্য প্রয়োজন হবে একটি শক্তিধর স্থানীয় শিল্পখাত, তার উৎপাদিত পণ্য হতে হবে বিশ্বমানের। বাংলাদেশে উৎপাদিত পণ্যকে বিশ্বের যেকোনো দেশের পণ্যের সঙ্গে গণগত মানের প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকতে হবে। উৎকৃষ্ট মানের পণ্য উৎপাদন করতে হবে, কিন্তু একই সঙ্গে উৎপাদনের খরচ কমাতে হবে। কেননা উৎপাদনকারী
প্রতিষ্ঠানগুলোকে হতে হবে লাভজনক। সে জন্য প্রত্যেক শ্রমিক-কর্মচারীকে যথাযথ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করে তুলতে হবে। তাদের দক্ষতার মানদণ্ডে পরীক্ষিত হতে হবে। ইংরেজিতে একটি কথা আছে, ‘ইউ ওনলি গেট হোয়াট ইউ ডিজার্ভ’। অর্থাৎ, তুমি সেটুকুই পাবে, যেটুকু পাওয়ার যোগ্যতা তোমার আছে।

তাই আন্তর্জাতিক সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার হুমকিতে আমরা যখন একটি শক্তিশালী স্থানীয় অর্থনীতি গড়ে তুলতে চাচ্ছি, তখন আমাদের কতকগুলো মৌলিক নিয়ম-নীতি সংস্কার করতে হবে। শিক্ষা ও যথাযথ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সুদক্ষ জনবল গড়ে তোলার দিকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। সর্বাধুনিক প্রযুক্তির সদব্যবহার করে উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে এবং স্থানীয়ভাবে একটি শক্তিশালী ও দক্ষতাপূর্ণ সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে তোলার উদ্যোগ নিতে হবে। এই কাজগুলো করতে হলে এগুলোর গুরুত্ব অনুধাবন করতে হবে। উল্লিখিত প্রতিটি বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় আনতে হবে। এই সমস্ত বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় আসতে হবে । সঠিক খাতে সঠিক উৎসাহ বা প্রণোদনা প্রদান, নেতৃত্বের গুণাবলি অর্জন, অভ্যন্তরীণ সুশাসন ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার বিষয়গুলো ভুললেও চলবে না