তালাবন্দী ভারত, সরকার সামলাতে পারবে তো

২৪ মার্চ সন্ধ্যায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২১ দিনের লকডাউন ঘোষণা করেন। ছবি: রয়টার্স
২৪ মার্চ সন্ধ্যায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২১ দিনের লকডাউন ঘোষণা করেন। ছবি: রয়টার্স

তল্পিতল্পা নিয়ে যানবাহনহীন হাইওয়ে ধরে হাঁটাপথে লাখ লাখ পরিযায়ী শ্রমিকের দিল্লি ছাড়ার দৃশ্য টেলিভিশনের পর্দায় দেখলাম। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস এই ছবি ছেপে সংবাদ শিরোনাম করেছে, ‘ইন্ডিয়া ইজ ওয়াকিং হোম’। ভারত এর আগে সর্বশেষ এই ছবি দেখেছিল সাত দশক আগে, দেশভাগের সময়। তখন পাকিস্তান থেকে এভাবে বাস্তুচ্যুত লোক ভারতে এসেছিল। তবে এবারের ট্র্যাজেডির চেহারা একটু ভিন্ন। 

২৪ মার্চ সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২১ দিনের লকডাউন ঘোষণা করলেন। এতে ভারতের অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতিতে কী ভয়ানক প্রভাব পড়বে, সে বিষয়ে তিনি কিছুই বললেন না। এ দেশের সুবিধাপ্রাপ্ত পেশাজীবীর কাছে ‘লকডাউন’ মানে হলো ঘরে বসে অফিসের কাজ করা অথবা কাজকর্ম বাদ দিয়ে ঘরে বসে থাকা। কিন্তু গরিবের কাছে এর মানে ভিন্ন। 

কারখানা, অফিস, দোকানপাট সব বন্ধ, অবকাঠামো নির্মাণের জায়গাগুলো অলস পড়ে আছে। রেস্তোরাঁ, চুল কাটার দোকান, বিউটি পারলার—সব বন্ধ। এখানে যাঁরা কাজ করেন তাঁদের সবার রোজগার বন্ধ। দোকান মালিকেরা কর্মচারীদের মায়নাপত্র দিচ্ছেন না। তাঁরা বলছেন, তাঁদের নিজেদেরই তো আয় নেই, বেতন কড়ি কোত্থেকে দেবেন। 

লকডাউন ঘোষণার কয়েক দিন পরই হাতে থাকা টাকাপয়সা শেষ। বাসা বা মেস ভাড়া দেওয়ার টাকা নেই। খাওয়ার টাকাও শেষ। ফলে দিল্লির মতো বড় বড় শহরে কাজের ধান্দায় আসা মানুষ গ্রামে ফিরতে চাইল। বাস-ট্রেন সব বন্ধ। পায়ের ওপর ভর করে কয়েক শ কিলোমিটার পাড়ি দিতে রওনা হলো তারা। 

এই সুদীর্ঘ পথ হেঁটে পাড়ি দেওয়া অত সহজ ছিল না। পথে কোনো খাবার নেই, পানি নেই। জিরোবার জায়গা নেই। ক্লান্ত পা আর চলতে চাইছিল না। কিছু কিছু রাজ্য সরকার এসব মানুষের কষ্ট দেখে বসে থাকা বাস সার্ভিসগুলোকে কিছু সময়ের জন্য সেবা দিতে বলেছিল। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার দ্রুত সব রাজ্য সরকারের সীমান্ত আটকে দিয়ে কর্তৃপক্ষকে বলল, এসব মানুষকে তারা যেন আশ্রয় এবং খাবার দেয়। 

এক সংকট থেকে বাঁচতে গিয়ে এখন আরেক মানবিক সংকট তৈরি হয়েছে। মোদি মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে আটকা পড়া লোকদের বলেছেন, ‘আপনাদের, বিশেষ করে যাঁরা গরিব মানুষ তাঁদের কষ্ট বেড়েছে, এ জন্য আমি দুঃখিত।’ তিনি এই কষ্ট সবাইকে সহ্য করতে অনুরোধ করেছেন। তাঁর সরকার বুঝতেই পারেনি, এভাবে লাখ লাখ লোক দিল্লি থেকে পায়ে হেঁটে নিজ নিজ গ্রামে চলে যাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠবে। 

কূটাভাস হলো, মোদি সরকার এই লোকগুলোকে ঘরে ফিরতে দিতে না চাইলেও বিদেশে অবস্থানরত ভারতীয় কর্মীদের দেশে ফেরার আকাঙ্ক্ষাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছে। এই লকডাউন ঘোষণা করার আগেই হাজার হাজার ভারতীয় লোক বিদেশ থেকে ফিরেছেন। কোভিড-১৯ মোকাবিলায় ভারত যে কত বড় চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে, তা এই পরিযায়ী শ্রমিকদের দুর্দশার মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়েছে। 

এটি অবশ্যই মানতে হবে ১৩০ কোটি মানুষকে ঘরবন্দী করে রাখা মোটেও সহজ কথা নয়। এত বিপুলসংখ্যক মানুষের দেশে, যে দেশের শহর এলাকায় এমনও ঘর আছে যেখানে একটি কক্ষেই এক ডজন লোক বাস করে, সেখানে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা খুবই দুরূহ। 

লকডাউনের পর নানা ধরনের বিপত্তি শুরু হয়েছে। লোকজনকে বাড়ির মধ্যে থাকতে বাধ্য করার কাজটি খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে। কে কে কোন কোন প্রয়োজনে বাড়ি বাইরে যেতে পারবেন, তা নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। এমনও দেখা গেছে, অতি জরুরি ওষুধ কিনতে বের হওয়া লোককেও বাড়িতে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বদৌলতে দেখা যাচ্ছে পুলিশ বহু লোককে বেধড়ক লাঠিপেটা করছে। 

কৃষক শ্রেণির মানুষ এখন মহা সমস্যায় পড়েছে। এখন কোথাও কোথাও ফসল তোলার মৌসুম শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু কৃষকেরা ফসল তুলতে পারছেন না। তা মাঠে নষ্ট হচ্ছে। বাজারঘাট বন্ধ থাকার কারণে খামারিরা গরু–ছাগলের দুধ বেচতে পারছেন না। বহু জরুরি নিত্যপণ্য পাওয়া যাচ্ছে না। এমনকি সংবাদপত্রও সরবরাহ বহু জায়গায় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। 

এই মহা বিপর্যয়ের মধ্যে একটাই সান্ত্বনার বিষয় যে ভারতের সবচেয়ে দূষিত শহরগুলোর বাতাস যেন এক জাদুর ছোঁয়ায় বিশুদ্ধ হয়ে উঠেছে। দিল্লির দূষণ মাত্রা যেখানে সচরাচর ৫০০ ছাড়িয়ে যায় (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিরাপদ মাত্রা হলো ২৫) সেখানে এখন দিল্লির এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সে দূষণের মাত্রা ৩০-এ নেমে এসেছে। দিল্লিতে এখন নির্মল সুনীল আকাশ দেখা যায়। বৃষ্টি হলে এই সূচক ৭ মাত্রায় নেমে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। 

ভারতীয়রা যদিও বড় বড় সংকটের সময় সংহতির পরিচয় দিয়ে থাকে, কিন্তু এবারে সেটি কত দূর সম্ভব হবে তা বলা যাচ্ছে না। ক্ষমতাসীন দল এখন পর্যন্ত লাঠিপেটা করে লোকজনকে ঘরে রাখতে পেরেছে। কিন্তু অর্থনীতির খোলনলচে যেভাবে ভেঙে পড়ছে, বুভুক্ষু মানুষের ক্রোধ যেভাবে বাড়ছে, তাতে তাদের শেষ পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে কি না, সেটাই ভাবার বিষয় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। 

ইংরেজি থেকে অনূদিত। স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

শশী থারুর ভারতের কংগ্রেস দলের সংসদ সদস্য এবং দেশটির সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও জাতিসংঘের সাবেক সহকারী মহাসচিব