১ কোটি বিত্তহীনের জন্য প্রণোদনা প্যাকেজ দিন

হোসেন জিল্লুর রহমান।
হোসেন জিল্লুর রহমান।
>

হোসেন জিল্লুর রহমান। শিক্ষাবিদ, অর্থনীতিবিদ ও ব্র্যাকের চেসন। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বাণিজ্য ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা। পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) প্রতিষ্ঠাতা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিজানুর রহমান খান

প্রথম আলো: অনেকের মতে লকডাউন উন্নত দেশের জন্য, বাংলাদেশের মতো পিছিয়ে থাকা দেশগুলোতে সেভাবে প্রযোজ্য বা কার্যকর হওয়ার নয়। আপনি কীভাবে দেখেন?

হোসেন জিল্লুর রহমান: বিষয়টি একই সঙ্গে দুটি সংকট মোকাবিলার প্রশ্ন। স্বাস্থ্য সংকট ও অর্থনৈতিক সংকট, দুটোই সামাল দিতে হবে। এক মাস অর্থনীতি বন্ধ থাকা মানতে হবে। ধনী বা গরিব দেশ বলে কথা নেই। হটস্পট চিহ্নিত করে সুনির্দিষ্ট লকডাউন কৌশল নির্ধারণ করাই মুখ্য। লকডাউন সত্ত্বেও অত্যাবশ্যকীয় সেবা চালু থাকবে, কিন্তু এর একটা সংজ্ঞা ঠিক করা দরকার। আবার ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে, এ ক্ষেত্রেও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার একটা নিয়ম দরকার। পরীক্ষা বাড়ছে, রোগী বাড়ছে, এ রকম একটা ঊর্ধ্বমুখী রেখা এ মাসজুড়ে হয়তো বহাল থাকবে।

প্রথম আলো: উহান দুই মাস ধরে পুরো লকডাউন করে সাফল্য পেয়েছে। লুকানো হটস্পট কী করে বের হবে?

হোসেন জিল্লুর: আমাদের লকডাউনে তার ব্যত্যয় দেখি। তাই হটস্পট চিহ্নিত করার কাজ আরও জোরালো করতে হবে। এই মুহূর্তে নারায়ণগঞ্জ সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ, সেখানে কঠোরভাবে লকডাউন নিশ্চিত করতে হবে। ঢাকাকেও। যেখানে সংক্রমণের বিস্তার সীমিত, সেই এলাকাগুলোকে বিচ্ছিন্ন রাখতে হবে। কিটের ব্যবহার যেহেতু সীমিত, তাই প্রক্সি ইন্ডিকেটর, যেমন কোথাও হাসপাতালে সন্দেহভাজনদের ভিড়, এসব তথ্য সংগ্রহ করে প্রাথমিকভাবে হটস্পট চিহ্নিত করার চেষ্টা সব থেকে জরুরি। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখেই ত্রাণদান, আন্তজেলা যাতায়াত কঠোর নিয়ন্ত্রণ বা পুরো বন্ধ করা ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। একটি সামগ্রিক প্যাকেজ লাগবে।

প্রথম আলো: করোনা সংক্রমিতদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে কী সমস্যা রয়ে গেছে বলে মনে করেন?

হোসেন জিল্লুর: আমাদের স্বাস্থ্যকর্মীদের মনোবলের শুরুর দিকে একটা ধস ঘটেছে। তাঁদের সুরক্ষা সরঞ্জাম ছিল না অথচ তাঁদের দোষারোপের ইঙ্গিত ছিল। পরে কিছুটা অগ্রগতি দেখেছি। এপ্রিল মাসটি আমাদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। সংকট আরও গভীর হওয়ার বিষয়টি সামনে আরও টের পাওয়া যাবে। প্রস্তুতির ঘাটতি অনস্বীকার্য। সুরক্ষা সামগ্রী দানসহ স্বাস্থ্যকর্মী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সংবাদকর্মী, এই ফ্রন্টলাইন কর্মীদের সামনে আনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাঁদের জন্য আমরা কী ভাষা ব্যবহার করছি, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। অনেক তরুণ এমবিবিএস ডাক্তার বসে আছেন। তাঁদের সংগঠিত করার একটা ইমার্জেন্সি প্ল্যান নিয়ে আসা দরকার। পুনশ্চ বলব, চুরি রোধ করে খাদ্যনিরাপত্তা মানে ত্রাণ কার্যক্রম নিশ্চিত করাটা অত্যন্ত জরুরি।

প্রথম আলো: দুর্নীতি, অপচয় এড়াতে মোবাইলে অনুদান পাঠানো?

হোসেন জিল্লুর: মোবাইল ব্যাংকিংয়ে শক্তির জায়গায় বাংলাদেশ আছে। কৌশলটা একমাত্রিক হলে হবে না। কারণ কোথাও খাদ্য না থাকলে সেখানে অর্থ অচল। নগদ অর্থ নাকি খাবার, সেই তর্কে আমরা জড়াব না। যেখানে সম্ভব, সেখানে মোবাইলের মাধ্যমেই টাকা পাঠানো যাবে। অবশ্য আগের বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখেছি, ত্রাণে যাঁরা তছরুপ চাইবেন, তাঁরা ওখানেও পথ করে নেবেন। এখন মোবাইলে ত্রাণ দূরত্বের শর্ত পুরা করবে, গ্রহীতাও পাবে খরচের স্বাধীনতা। দাতাদের সঙ্গে বৃহস্পতিবারেও কথা বলেছি। নগরগুলোতে সেই ধরনের সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রম ছিল না। তাই বিদ্যমান ডেটাবেইস সেভাবে ফলপ্রদ না–ও হতে পারে। ভোটার গ্রামের, কিন্তু বাস শহরে, তাই আইডি দেখে যাতে কারও ত্রাণবঞ্চনা না ঘটে, তা নিশ্চিত করতে হবে। মানুষ চিহ্নিত করা ও ত্রাণ বিতরণের ক্ষেত্রে সবার নজর রাখতে হবে। অনেকে নতুনভাবে দরিদ্র অবস্থায় পড়ে যাচ্ছে, সেদিকেও নজর দিতে হবে। আমাদের গবেষণা সংস্থা পিপিআরসি এবং বিআইজিডি নামে একটি সংস্থা এই মুহূর্তে সারা দেশে সমীক্ষা চালাচ্ছি। এটা ফোনভিত্তিক। নগর দারিদ্র্যের বিষয়টি বোঝা এর লক্ষ্য। ১৬ এপ্রিল এ ফলাফল প্রকাশের আশা করছি। সংকট সুযোগও আনে, এখন নগর দারিদ্র্য দূরীকরণে মনোযোগ দেওয়া যাবে।

প্রথম আলো: বাজেট ঘোষণার মাস জুন চলে আসছে। এবারের বাজেট আগেরগুলোর চেয়ে কতটা ভিন্ন হওয়া উচিত?

হোসেন জিল্লুর: তিনটি সুনির্দিষ্ট কথা বলব। প্রণোদনা প্যাকেজ, গার্মেন্টসে ৫ হাজার, পরে ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। কিছু আনুষ্ঠানিক খাতের জন্য এই প্রণোদনা সীমিত থাকা উচিত নয়। প্রণোদনা—এই শব্দবন্ধটিই বলে দিচ্ছে, এর গন্তব্য আনুষ্ঠানিক খাত, যদিও এর বিস্তারিত জানি না। জানতে আগ্রহী। এই এপ্রিলে কঠোর লকডাউনে পড়া দরিদ্র বা অভাবী, ক্ষুদ্র ও মাঝারি অথচ সংখ্যাগরিষ্ঠ উদ্যোক্তা শ্রেণি—এঁরা অনানুষ্ঠানিক খাতের মানুষ। তাদের জন্য প্রায় সমান অঙ্কের প্যাকেজ বাজেট পর্যন্ত খুব জরুরি। পরে বাজেটে থাকতে পারে। এই মুহূর্তে প্রয়োজনে অন্য প্যাকেজ করুন, কিংবা এর ভেতরে অগ্রাধিকার দিন। এইএমই’দের সচল করতে মে-জুন মাসেই এটা লাগবে। সামনের বাজেট প্রসঙ্গে বলা যায়, অবিলম্বে বাজেটের লাইন আইটেমের একটি রিভিউ দরকার। সাশ্রয় করার জায়গাগুলো চিহ্নিত করুন। যেমন বৈশাখী ভাতা প্রত্যাহার করা যেতে পারে। সবচেয়ে জরুরি বিষয়টি হচ্ছে দেশের আনুমানিক ১ কোটি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য একটি প্যাকেজ ঘোষণা। তবে প্যাকেজ ঘোষণার পাশাপাশি তার উৎস জানাতে হবে।

প্রথম আলো: ধরুন গার্মেন্টস ও রেমিট্যান্স সূত্রে ৬০-৭০ বিলিয়ন ডলারের প্রকৃত বৈদেশিক মুদ্রার যে আয়, সে অবস্থায় আর ফেরা গেল না। তখন তো বেকারত্ব ভয়াবহ আকার ধারণ করবে...

হোসেন জিল্লুর: এটা মাথায় রেখে, নির্দিষ্ট খাতওয়ারি সম্ভাব্য ধসের বিষয়ে একটা পরিকল্পনা দরকার। দীর্ঘ মেয়াদে চিন্তারাজ্যে পরিবর্তন আনতে করোনা একধরনের অনুঘটকের মতো কাজ করবে, সেই প্রত্যাশা করছি। একমাত্রিক জিডিপির মাধ্যমে উন্নয়নকে বোঝার যে চেষ্টা, তা ইতিমধ্যেই বড় ধাক্কা খেয়েছে। আমি আগ থেকেই বলে আসছিলাম, ওই দুই ‘চালকের’ ওপর নির্ভরতার সময় ফুরিয়ে আসছে। এখন প্রবৃদ্ধির নতুন চালক খুঁজতে হবে। মানুষকে কেন্দ্রে রেখে একটা নতুন উন্নয়ন ধারণা লাগবে। নীতিনির্ধারকদের মধ্যে এ–সংক্রান্ত চিন্তায় পরিবর্তন আনাটা বড় জরুরি হয়ে পড়েছে।

প্রথম আলো: দারিদ্র্য দূরীকরণে আমাদের অগ্রগতি আছে। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কয়েক কোটি। ৭২ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনায় এদের ওপর প্রত্যক্ষ প্রভাব কী? দেশের ৯০ ভাগ সম্পদের মালিক ১০ ভাগের প্রতিক্রিয়া দেখেছেন?

হোসেন জিল্লুর: দারিদ্র্য কমার ক্ষেত্রে অগ্রগতি থাকলেও এখন ছন্দপতনের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ২০০৮ সালের বৈশ্বিক মন্দায় একটা মন্থর গতি এসেছিল, যা আমরা কাটিয়ে উঠি। এখন একটা স্বল্পমেয়াদি দারিদ্র্য বৃদ্ধির বাস্তবতা খুবই সুনির্দিষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছি। এই সংকট কেটে গেলে সেপ্টেম্বরের পর নতুনভাবে চিন্তাভাবনা করতে হবে। আর প্রণোদনা তো মূলত কতিপয় গোষ্ঠীর, তাই না? আমাদের অন্তত ৪০ লাখ মানুষের খাদ্যের সংস্থান এখনই করতে হবে। বেদে ও চা–শ্রমিকদের মতো ভয়েসলেস পিপলকেও এর আওতায় আনতে হবে। এভাবে প্রান্তিকজন যুক্ত করলে সংখ্যাটা ১ কোটি ছাড়াবে। রাষ্ট্র এদের সাহায্য দিলেও ব্যক্তি পর্যায়ের বা বিত্তবানদের এগিয়ে আসার দরকার ফুরাবে না। ধনীরা সামাজিকভাবে দায়বদ্ধ। তাদের কম সাড়া দুঃখজনক। কেউ হয়তো নীরবে দিচ্ছেন, কেউ অল্প দিয়ে প্রচার বেশি করছেন।

প্রথম আলো: গার্মেন্টস শ্রমিক নেত্রী নাজমা বেগম আক্ষেপ করে বলেছেন, ৩৫ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানির মধ্যে মাত্র ৬ বিলিয়ন ডলারের ক্রয় আদেশ বাতিল হতে না হতেই বেতন বন্ধ, চাকরিচ্যুতির মতো ঘটনা ঘটল।

হোসেন জিল্লুর: লকডাউনের মধ্যে তাদের কর্মক্ষেত্রে ফেরানো একটি অত্যন্ত দায়িত্বহীন কাজ হয়েছে। একটু কঠিন শোনালেও বলব, আমাদের অর্থনৈতিক, বিশেষ করে সুযোগ-সুবিধা বণ্টনসংক্রান্ত নীতিনির্ধারণে কিছু গোষ্ঠীর (আরএমজি খাতসহ) অ-সমানুপাতিক ও অবিবেচনাপ্রসূত প্রভাব আছে। এবারও আমরা তা দেখলাম। এ কথা আজ সুনির্দিষ্টভাবে বলার সময় এসেছে যে, দেশের অর্থনীতির বিকাশে এই খাতের ভূমিকা আছে, সেটা গুরুত্ব দিই, স্বীকার করি। কিন্তু তাদের ওপরেই ভিত্তি করে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা আসার যে ধারণা তারা দিয়ে চলেন, সেটা সার্বিক বিচারে সঠিক নয়। তারা না থাকলে বাংলাদেশের অর্থনীতি বসে যাবে, তারা ছাড়া দেশ চলবে না, এভাবে আমাদের অনেকের চিন্তাকে তারা জিম্মি করে রেখেছে। এই ভ্রান্তি, এই চিন্তার দৈন্য থেকে আমাদের মুক্তি দরকার।

প্রথম আলো: এই সংকট তো দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে?

হোসেন জিল্লুর: দীর্ঘমেয়াদি নানা সংকট সামনে। মধ্যপ্রাচ্যের দুটি দেশে দেখলাম, প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রতি বৈরী মনোভাব দেখাচ্ছে। রেমিট্যান্সের ধাক্কা কাটানোর সম্ভাবনা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। কী হবে ভবিষ্যতে তার সুনির্দিষ্ট উত্তর নেই। কত ধরনের সমস্যায় যে পড়তে পারি, তা হয়তো আমরা এখন আঁচ করতেও পারছি না। তাই সবাইকে একত্র করে চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করার এবং নিজস্ব উপায়ে এগোনোর সক্ষমতা বৃদ্ধি করার চেষ্টাই হবে আমাদের চ্যালেঞ্জ।

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

হোসেন জিল্লুর: ধন্যবাদ।