গো বাজান, ভাত দে

ছবি: দীপু মালাকার
ছবি: দীপু মালাকার

আফরোজা। ১০ বছরের এক মাসুম শিশু। সিরাজগঞ্জের বেলকুচি এলাকার কামার পাড়া ওয়াপদা বাঁধে বাড়ি। বাপ আলম সেখ, তাঁত শ্রমিক। ১০ তারিখ শুক্রবার বাপের কাছে ভাত চায়। অভাবের কারণে তারা দুই বেলা করে খাচ্ছিল। বাবা সেই অভাবের কথা হয়তো বলেছিলেন রাগ নিয়ে। আভিমানে তাই সে ফাঁস নেয়। আত্মহত্যা করে।

স্বজনরা বলেছেন, তার বাপের কারখানা বন্ধ গত ১০ দিন। জমা টাকায় ৪-৫ দিন সংসার চলেছে। তারপর থেকে অনাহারে ছিল। পৌরসভার মেয়র বলেছেন, সরকারি সাহায্য অপর্যাপ্ত। সবাইকে এক সঙ্গে দেয়া সম্ভব নয়। তাই অনেকেই বাদ পড়েছেন।

পিতা আলম সেখ জানান, ১০ দিন ধরে কাজ নেই। ঘরেই শুয়ে বসে কাটাচ্ছি। হাতে টাকা নেই। তাই চাল-ডাল কিনতে পারিনি। ঘরে খাবার নাই বলে মেয়ে আমার কান্নাকাটি করছিল। তাই ধমক দিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছিলাম। এরপর...

ওদিকে বগুড়ার কাজীপুর উপজেলার মন্তাজ আলী। বয়স ৬৫। দিন মজুরি করে পেট চলে। বিবাহিত তিন মেয়ে ঢাকায় গার্মেন্টসকর্মি। বউ পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে বিছানায়। তিনি নিজ ঘরে ফাঁস টাঙিয়ে আত্মহত্য করেছেন। শামসুল হক ও আফসার আলীসহ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রতিবেশী ২/৩ জন নারী জানান, অসুস্থ বউয়ের চিকিৎসা তো দূরের কথা, ঘরে ৩/৪ দিন ধরে খাবারও ছিল না। গোপালপুর ইউনিয়নের ৭ নং ওয়ার্ডের সদস্য গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘মন্তাজ আলি কোনওদিন সরকারি ত্রাণ নিতে আসেননি।’ অন্যদিকে ধুনট থানার ওসি কৃপা সিন্ধু বালা বলেন, অভাবে নয়, বড় মেয়ে রত্না খাতুন ৬ শতাংশ জমি লিখে নেয়ায় তিনি আত্মহত্যা করেছেন।

আফরোজা আর মন্তাজ আলির লাশের পাশে দাঁড়িয়ে আমাদের অনুসন্ধানী মন তর্কই করবে -ক্ষুধায়, না অভিমানে?

২.
মনে পড়ে চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিন লিখেছিলেন প্রায় ১৯ বছর আগে, ‘‘উষ্ণ চা পানের পর মেজাজের উষ্ণতা খানিকটা কমে। জানতে পারি, তিনি আজ দুপুরে এসে পৌঁছেছেন বিমানে করে, পর্যটনের মোটেলে কামরা নিয়েছেন, তারপর সেখানেই লাঞ্চ সেরে শহরে বেরিয়েছেন লাশের সন্ধানে। আলোকচিত্রী বন্ধু ঢাকা থেকে শুনে এসেছেন, রংপুর শহরের রাস্তায় লাশ। ক্ষুধার জ্বালায় মানুষ পড়ছে আর মরছে। তিনি আজ এসেছেন, ইচ্ছে ছিল লাশের ছবি তুলে কালকের বিমানেই ঢাকা ফিরে যাবেন। তারপর এজেন্সীতে পাঠিয়ে দেবেন ছবি। একটা 'হিট' ব্যাপার হয়ে যাবে।
...আমি বলি, লাশ পেতে পারেন হয়তো কিন্তু রংপুর শহরের রাস্তায় নয়, গ্রামে যেতে হবে। তবে অনাহারে কিংবা না খেয়ে মারা গেছে এমন লাশ পাবেন না, পাবেন অপুষ্টিতে শুকিয়ে যাওয়া কারও লাশ।’’ -মোনাজাতউদ্দিন, নেপথ্য সংবাদ।

মাঠে মাঠে সবুজ চারা। ক'দিন পরে শীষ আসবে, তারপর দুধ এসে সেগুলো মাথা নোয়াবে। তারপর পেকে উঠবে সোনার ধান। কিন্তু মাঝখানের এই সময়টুকুতে চাষি বেকার। যারা এলাকার বাইরে ছিলেন তারাও ফিরেছে। লকডাউন।

প্রতিবছর ধান কাটার মৌসুমে কুড়িগ্রাম-লালমনিরহাট থেকে শ্রমিকেরা বগুড়া-সিরাজগঞ্জ যান। লকডাউনে আটকা পড়েছেন সবাই। যা ছিল জমা সব শেষ। হাট-বাজার বন্ধ থাকায় ঘরের ফসলেরও দাম নেই। পানির দরে হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল বিক্রি করছেন। কে কিনবে, সবাই সামনে তাকাচ্ছেন -কী দিন আসছে তার দিকে। ছোট দোকানদাররাও প্রায় পথে। পথ কোথায়?

অথচ সরকারি ভাষ্য মতে, গুদামগুলোতে ১৭ লক্ষ মেট্রিক টন শস্য মজুদ আছে। ৯১ এর মঙ্গা ঘনিয়ে ওঠার কারণ খুঁজতে গিয়ে মোনাজাতউদ্দিন বলেছিলেন, সঠিক সময়ে সঠিক কাজটি করার গাফিলতি। কথিত ডায়রিয়া অর্থাৎ খাদ্যাভাবজনিত অপুষ্টিতে মানুষের মৃত্যু শুরু হবার ১ মাস আগে যদি খাদ্য সাহায্য বৃহত্তর রংপুরের জেলাগুলোতে পাঠানো হতো, তাহলে এতগুলো প্রাণহানি ঘটত না।

কুড়িগ্রামের রাজারহাটে টিসিবির চাল বিতরণে অনিয়মের প্রতিবাদ করায় দুই তরুণকে বাড়ি থেকে ডেকে এনে ভ্রাম্যমান আদালত বসিয়ে জেল-জরিমানা চলবে। উপজেলাগুলোতে ১০ টাকা সের চালের রেশন না–থাকা নিয়ে কথা বলব না। কেউ বলবে না, এ কেমন অর্থনীতি ১০ দিন কাজ না থাকলেই ক্ষুধার জ্বালায় মরতে হয়।

ডেইলি মিরর শিরোনাম করেছে, সাংবাদিকতা না থাকলে করোনা ভাইরাস আরও মানুষ মারবে। না থাকলে আমরা জানতেই পারতাম না, মধ্য আয়ের দেশে মাসুম বাচ্চা বাপের কাছে ভাত না পেয়ে গলায় দড়ি দেয়। আচ্ছা, আমরা কি এই তর্কটা করতে পারব -ফাঁসের দড়িতে আসলে কে ঝুঁলছে? আফরোজা-মন্তাজ আলি, না আমাদের উন্নয়ন?

নাহিদ হাসান: রেল-নৌ, যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটির কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সভাপতি
[email protected]