'মা খালি কান্দে, তুমি আইস'

১০ বছর বয়সী মেয়েটা ক্ষুধার অভিমানে গলায় ফাঁস নিয়েছে। তার শায়িত দেহের পাশে মা ও ছোটো বোন।
১০ বছর বয়সী মেয়েটা ক্ষুধার অভিমানে গলায় ফাঁস নিয়েছে। তার শায়িত দেহের পাশে মা ও ছোটো বোন।

দুপুরবেলা এখানে আজান হচ্ছে। ওখানে, সিরাজগঞ্জের বেলকুচি থানায় দুই মেয়ের মা মানুষটা ঘরের দাওয়ায় বসে আছে। ক্ষুধায় ভাত না-পাওয়ার অভিমানে যে মেয়েটা আত্মহত্যা করেছে, সেই মরে যাওয়া মেয়েটার এখনো তো তিনি মা। তাই বললাম, দুই মেয়ের মা। বড় মেয়ে আফরোজা (১০), ছোট মেয়ে সুমাইয়া (৫)। বড়টা মরে গেছে। দোষ তো পেটের ক্ষুধারই, আর কারও না।

আফরোজার বয়স আর কোনো দিন বাড়বে না। অভাবের দিনে পাতিলে চাল তোলার সময় তার ভাগের দুমুঠ চাল বেঁচে যাবে। বড় ছেলেমেয়ের নামে নাম হয় গ্রামদেশের মায়েদের। আফরোজা না থাকলেও তাকে আফরোজার মা বলেই ডাকা হবে। তারপর জিজ্ঞাসা করবে, ‘সুমাইয়াক তো দেখলেম, তুমার বড় মেয়া আফরোজাক তো দেখলেম না!’

ঘটনা গত শুক্রবারের। সিরাজগঞ্জের বেলকুচি থানার ওয়াপদা বাঁধের বসতি। মা গেছে গ্রামের আরেক বাড়ির ফ্রিজে রাখা মাছ আনতে, বাবা ঘুরছে কাজের খোঁজে। ঘরে দুই মেয়ে একা। বাবা মানুষটার একটু রাগ হয়েছিল। বিকেলের দিকে মেয়ে ভাত খাওয়া নিয়ে আবদার করায় তাকে চড় দিয়েছিল বাবা। প্রায় ১৫ দিন হয় তাঁত বোনার কাজ বন্ধ আলম শেখের। তারপর থেকে কাজের খোঁজে এদিক যায় সেদিক যায়। উপায় না পেয়ে স্বামী-স্ত্রীতে মিলে সিদ্ধান্ত নেয়, সকাল আর রাত, এই দুই বেলা খাওয়া হবে। আরেক বেলা উপোস। কিন্তু শিশু দুটি তো এ অভ্যাস করেনি। শিশুর মন পেটের কাছে হার মানে।

বাবার চড় খেয়ে ভয়ানক অভিমান হয় তার।

তারপর কী হয়? মেয়েটা, যার নাম আফরোজা, সে গলায় ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করে। সেই মেয়ের মায়ের জবানি এই সময় শুনুক, জানুক।

‘‘মনে করেন যে, দুইটা বেটি। অরা ভাত চাইছে। এখন সুমায় ভাল না। ২০–২৫ দিন ধরে গেদির বাপ বইসে রইছে। বাপে রাগ করি একটা চড় দিছে। বেটি তহন কিছু কয় নাই। বাপে সেহন মোবাইল চার্জ দিবের লেগে আরেক বাড়ি গেছিল। আমি বেটিগুনাক কয়া গেলাম, মিলতাল কইরা থাক, আমি রানমুনি।

পরে বড় বেটি ছোটোটাক কইছে, তুমি বাইরে যাও। কইছে, তুমি বাইরে যাও, আমি পুতুল খেলামু। ছোটাটা হেই কথামতন বাইরে গেছে। আমি পরে বাইত আইসাথন দেহি কেউ নাই। আমি মনে করছি, বেটি মনে হয় আরেক বাড়িত খেলবের গেছে। পাশের বাড়ির আপাক সইছ করি, ‘আমিনা বু আমার বেটিটাক দেখছেও?’

কয় ‘না, দেহিনেই’। তহন আমি ঘরের দুয়ারে যায়া খাড়াইছি। ভাই রে, কওয়ার ভাষা নাই। মা হয়া ওই দৃশ্য দেখার আগে আল্লা আমাক নিয়া যাতো! কথা আসে না ভাই। কী কমু?

সাহায্য পাইনেই আগে। মরার আগে বেটি খাবের চাইছে। তখন একটা বেটাও একটা রুটি নিয়া আসেনাইকা। এহন আপনারাও ফোন দেন, মাইনসেও খাওয়াবের চায়। আল্লা গো, বেটিগুনাক কিছু দিবের পারিনেই।

ওয়াপদা বাঁধে থাকি। দিন আনি দিন খাই। পরের বাড়িতে কাম করিছি, সুতা কাটিছি। অগারে বাপের জমিজমা যা ছিল সব যমুনাত ভাইঙ্গে নিছে। আমি মা মরা মেয়া। আমরা ভাঙ্গা। ভাঙ্গাআলা মানস্যির আর কী থাকে। আমরাও গরিপ মানুষ, যার সাতে বিয়া হইছে হেও গরিব। গরিব মানস্যির হাত গরিব মানস্যিই ধরে, নাকি ভাই?’

মুখে কোনো কথা আসে না। থেমে থেমে তিনি বলেন চলেন,

‘বেটিগুলারে মাইনসের বাড়ির কামে পাঠাই নাই, সময় ভালো না। এখন বেটিও নাই, খাইখাইও নাই। এহন মানুষ হুনছে, জানছে, এহন এক টাকা দিক দুই টাকা দিক, দিছে।

‘কিন্তু কদিন পরে কী হইব? আবার কামে গিয়াই খাইতে হইব।

‘এনজিও কিস্তি নিয়া ঘর তুলছি, এহনও শোধ হয় নাই। আরও বারোডা কিস্তি বাকি। ১০-১২ বছর আগে ঋণ নিছি। ঋণ হইলে, কাজকাম না থাকলে সেই টেহা ভাইঙ্গা খাওন লাগে। আমরা সাহায্য চাইতে যাই নাই। যার ধন আছে তার মন নাই, যার মন আছে তার ধন নাই; ঠিক কি না ভাই?

‘দুনিয়ার সবচেয়ে আদর করে মা। আমার মা নাই। বেটিটা আমার খুব ভালা ছিল। মায়ের মতো ছিল। সেই বেটিরে আমি ঘর খুইলা দেখি ওই অবস্থা!’

মানুষ যেভাবে কাঁদে, চাপা, ডুকরানো, উদ্দেশ্যহীন—সেভাবে কাঁদেন এই মা। তারপর একসময় একটু দম নিয়ে আবার বলেন,

‘‘বেটিগুনাক মাইনসের বাড়িত কামে পাঠাইনেই, সুমায় ভাল না। এখন বেটিও নাই, খাইখাইও নাই। এহন মানুষ শুনিছে, জানিছে, এখন এক টাকা দিক দুই টাকা দিক, দিতিছে।

কিন্তু কয়দিন পর কী অবো? আবার কামে যাইয়াই খাওয়া নাগব!

একটু সামলে তিনি এবার এই লেখককে পরামর্শ দেন, ‘শরীরের যত্ন রাইখেন, ভাত খায়েন, দেইখাশুইনা চইলেন। আপনিও মানুষ, আমিও মানুষ।’

আমি আর কিছু জিজ্ঞাসা করতে পারি না। ফোনে মায়ের গলার সঙ্গে একটা শিশুর গলা শুনতে পাই। সে কথা বলতে চায়। মায়ের কাছে জানতে চায়, ‘কার সাতে কথা কও, আম্মা?’

সেই আম্মা, যার শোকের কোনো সান্ত্বনা নেই, তিনি বলেন, ‘তুমার মামা হয়।’ তারপর আমাকে বলেন, ‘মামার লগে কতা ক’বার চায়।’

কথা বলি। মেয়েটা যার নাম সুমাইয়া, সে সালাম দিয়ে বলে, ‘মামা, ভালা আছেন? আইস তুমি, আইস, হ্যাঁ। আম্মা খালি কান্দে, তুমি আইস।’

বুঝতে পারি না, কাকে আসতে বলছে ছোট্ট মেয়েটা। তার হারানো বোনটাকে কি?

ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।
[email protected]