করোনাকালে কৃষক বাঁচানোর সোজা রাস্তা

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

মাত্র এক–দুই সপ্তাহের মধ্যে চিকন চালের ধান এবং তিন-চার সপ্তাহের মধ্যে মোটা চালের ধান কাটা শুরু করতে হবে। কিছু এলাকায় ইতিমধ্যেই চিকন চালের ধান কাটা শুরু হয়েছে। রপ্তানিমুখী শিল্পকারখানা খোলার আপাতমিথ্যা ঘোষণায় অনেক শ্রমিক শহরে ফিরে গেছেন বলে গ্রামে শ্রমিকের সংকট রয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ বলে গ্রামে ছাত্র–যুবকেরা থাকলেও তাঁরা শ্রমঘন কাজে অনভিজ্ঞ।

১২ এপ্রিল সরকার কৃষি নিরাপত্তায় ৫ শতাংশ সুদে পাঁচ হাজার কোটি টাকার ব্যাংকঋণ বরাদ্দের ঘোষণা দিয়েছে। এই ঋণপ্রাপ্তির সঙ্গে জাতীয় পরিচয়পত্রে পেশা হিসেবে কৃষক, মৎস্যজীবী, খামারজীবী হওয়াকে আমলে নেওয়া যায়। উপজেলা কৃষি দপ্তরের তালিকায় থাকা কৃষক, পোলট্রি, হ্যাচারি ও ডেইরি ফার্মের মালিকদের সুরক্ষিত করে বিজ্ঞপ্তি জারি করা দরকার। বিভিন্ন কৃষি, সমবায়, ডেইরি, হ্যাচারি, পোলট্রি, দুধ, সবজি, ফল ও বীজ উৎপাদনকারী সমিতির সদস্যদের সহজ সুদে ঋণ দেওয়া যায়। পাশাপাশি ধান কাটার মজুরি বাবদ গ্রামীণ পরিবারপ্রতি পরিমাণ নির্ধারণ করে ঘোষণা করলে ভালো হয়।

জাতীয় পরিচয়পত্রের বিপরীতে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ঋণ বরাদ্দ করা গেলে কৃষিঋণ তৃণমূলে পৌঁছানো যাবে। তবে কৃষি ব্যাংক ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের আগের খেলাপি কৃষিঋণ যাতে পুনঃতফশিলীকরণ যাতে না করা হয়। এতে করোনাজনিত ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার উদ্দেশ্য ব্যর্থ হবে। সরকার যেভাবে রপ্তানি খাতের শিল্পশ্রমিকদের বেতন বাবদ পাঁচ হাজার কোটি টাকার ঋণ কর্মসূচি নিয়েছে, তার আদলে কৃষিঋণেও দুর্নীতিমুক্ত ব্যবস্থা আনা হোক। এই ঋণ যাতে চালকলের মালিক, চাল ব্যবসায়ী, সরকারকে ধান সরবরাহকারী দালাল, সারের ডিলার এবং স্থানীয় নেতারা হাতিয়ে নিতে না পারেন, তার যথোপযুক্ত উদ্যোগ ও কৌশল চাই। ঋণসহ যেকোনো সরকারি সুবিধা চাষির হাতে পৌঁছে দিতে খেতের ফলন ও খামার উৎপাদন নথিবদ্ধ (রেজিস্ট্রেশন) করা এবং ডিজিটাল কৃষি তথ্যভান্ডারের বিকল্প নেই।

আবহাওয়া ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা
কালবৈশাখী শুরু হয়েছে, তাই এলাকাভিত্তিক কালবৈশাখীর সঠিক এবং আগাম তথ্য সংবাদ জানানো চাই। এই সময়ে আগাম বন্যা বা কোথাও কোনো ফ্ল্যাশ ফ্ল্যাডের সম্ভাবনা থাকলে স্থানভিত্তিক পূর্বাভাসও ঠিক সময়ে জানাতে হবে। বড় নদীগুলোর উজানে ভারতে আগামী এক–দেড় বা দুই মাসে ভারী বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা আছে। এসব মোকাবিলায় আবহাওয়া অফিস, কৃষি অফিস, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং স্থানীয় সরকারকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।

ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, চীন—এসব দেশে ৮০ শতাংশের বেশি ধান কাটা ও খড় থেকে ধান তোলার কাজ মেশিনে হয়। বাংলাদেশ না করতে পেরেছে রাইস হার্ভেস্টিং প্রযুক্তি ও মেশিনারির উদ্ভাবন, না করতে পেরেছে এই সাধারণ প্রযুক্তির আত্মীকরণ। ফলে কৃষি কায়িক শ্রমনির্ভর এবং খরুচেই রয়ে গেছে। এতে কায়িক শ্রমনির্ভর পেশা হিসেবে কৃষি যেমন সামাজিকভাবে মর্যাদাহীন; তেমনি নিম্ন ফলন, দাম ও লাভের দিক থেকেও কৃষি আর্থিকভাবে আবেদনহীন। তবে সরকার চাইলে দ্রুততার সঙ্গে প্রতিটি ইউনিয়ন ও উপজেলার জন্য রাইস হার্ভেস্টিং মেশিন এবং এসব মেশিনারি রক্ষণবেক্ষণের লোকবল সরবরাহ করার উদ্যোগ নিতে পারে। যদিও বিদেশ থেকে মেশিন আমদানির সময় হাতে একদম নেই। তথাপি দেশে বর্তমানে যেসব যন্ত্রপাতি রয়েছে, সেগুলোকে পরিচালনার চেষ্টা থাকা চাই।

খাদ্য সরবরাহ ও ধান কাটার প্রণোদনার মধ্যমে গ্রামে শ্রম ঘনীভূত করা
সরকার গ্রামে ত্রাণ হিসেবে খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সরবরাহ করলে গ্রাম থেকে শ্রম সরে যাওয়ার পথে পরোক্ষ বাধা তৈরি হবে। পাশাপাশি অঞ্চলভিত্তিক ধান কাটার সময় অনুসারে শ্রমিকদের যাতায়াতের জন্য স্বাস্থ্যবিধি মেনেই কিছু পরিবহনসুবিধা তৈরি করা যায়। কৃষককে ধান কাটা বাবদ ঘোষিত ৫ শতাংশ সুদের কৃষিঋণ সহজ পদ্ধতিতে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে দেওয়া গেলে নগদ প্রাপ্তির আশায় ধান কাটায় অনেকেই উৎসাহ পাবে। শ্রমিক ফেডারেশন কল্যাণ তহবিলের টাকা এখনই বিতরণের জন্য সরকার চাপ দিতে পারে, এতে উপার্জনহীন পরিবহনশ্রমিক এখনই কাজে যাওয়ার জন্য উতলা হবেন না। এই শ্রমিক ধান কাটায় ভূমিকা রাখতে পারেন।

ফসল কাটা প্রণোদনা ও ধানের দাম পরিশোধের স্বয়ংক্রিয় ব্যাংকিং পদ্ধতি
করোনাজনিত মন্দায় যেহেতু কৃষি নিরাপত্তা বিঘ্নিত; তাই কেজিপ্রতি ধানের দাম অন্তত ৩৫ টাকা হলে ভালো হয়। তবে ধান সংগ্রহের ব্যবস্থাকে আধুনিক না করলে ভর্তুকি কেন, ধানের দামই কৃষকের হাতে পৌঁছাবে না। গত বছর সরকার মণপ্রতি ধানের দাম প্রায় ১ হাজার ২০০ টাকা নির্ধারণ করলেও দালাল শ্রেণির সিন্ডিকেট কৃষকদের মণপ্রতি প্রায় ২০০ থেকে ২৫০ টাকা ঠকিয়েছে। ফলে এই পদ্ধতি স্বয়ংক্রিয় না করলে কৃষকদের বাঁচানো কঠিন হয়ে যাবে।

সরকার সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান সংগ্রহ করবে, একটি জাতীয় সফটওয়্যার বা আরও সহজ মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে নাম, ঠিকানা, ছবি, জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর, মোবাইল ব্যাংকিং নম্বর, প্রদানকৃত ধানের পরিমাণ ইত্যাদি রেজিস্টার করে কৃষককে স্লিপ দেবে। পরে চাইলে এখানে ধানের আর্দ্রতা এবং কৃষকের বায়োমেট্রিক সংযোজন করা যাবে। ধান পরিমাণে এবং আর্দ্রতায় বুঝে পাওয়ার ঠিক তিন দিনের মধ্যেই কৃষকের মোবাইল অ্যাকাউন্টে টাকা চলে যাবে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে।

অন্যদিকে দালালের মাধ্যমে ধান সংগ্রহ করার বেলায় দালাল শুধু মণপ্রতি কমিশন তাঁর মোবাইল অ্যাকাউন্টে অটো–পে পাবেন, কিন্তু ধানের দাম পাবেন মূল কৃষক—মোবাইল পের মাধ্যমে, উল্লিখিত রেজিস্ট্রেশন পদ্ধতিতে। এভাবে মূল কৃষকের অনুপস্থিতিতে এককভাবে দালালদের কাছ থেকে ধান কেনার ব্যবস্থা বন্ধ হবে। এতে বৃহৎ ও মধ্যপর্যায়ের কৃষক সরাসরি এবং ক্ষুদ্র কৃষক নিজের সুবিধামতো সরাসরি কিংবা দালালের মাধ্যমে সরকারের কাছে ধান বিক্রি করে হয়রানিমুক্ত আধুনিক পদ্ধতিতে টাকা পাবেন। বর্তমানে ধান বিক্রির পর টাকার জন্য এক, তিন এমনকি ছয় মাস ঘুরতে হয়। এতে সরকার ঘোষিত দাম আসে না, শ্রমঘণ্টার অপচয় হয়, হয়রানি ও মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা তৈরি হয়। ঠিক সময়ে টাকা না পেয়ে ধার পরিশোধ, ঋণের কিস্তি দেওয়া হয় না বলে পরবর্তী ফসলের প্রস্তুতিতেও ভাটা পড়ে।

ত্রাণ দিয়ে গুদাম খালি করে বেশি ধান–চাল কিনুন
বোরো মৌসুমে ৬ লাখ টন ধান, ১১ লাখ টন চাল কেনার লক্ষ্যমাত্রা তা মোট উৎপাদিত ফসলের মাত্র ৫ থেকে ৬ শতাংশ মাত্র। করোনাজনিত খাদ্যসংকটের শঙ্কার মধ্যে মাত্র দুই লাখ টন বাড়ানোর এই টার্গেট অন্যায্য; কেননা ত্রাণের প্রয়োজন অনেক বেশি। ত্রাণের মাধ্যমে গুদাম খালি করে, কিছু সাময়িক গুদাম তৈরি করেই বেশি ধান–চাল কেনা উচিত। ধান–চালের সংগ্রহ মূল্য গত বছরের মতোই রাখা হয়েছে, যা পুরোপুরি অগ্রহণযোগ্য। যেহেতু সরকার কৃষক থেকে শুধু ধানই কেনে (চালকল থেকে মূলত চাল), তাই ধানের বিক্রয়মূল্য ন্যায্য হওয়া চাই, হয়রানিমুক্ত এবং দুর্নীতিহীন স্বয়ংক্রিয় মাধ্যমে অর্থ পাঠানোর বন্দোবস্ত চাই। যেহেতু টেকসই ও দুর্নীতিমুক্ত কারিগরি বিকল্প রয়েছে, তাই মোবাইল ব্যাংকিং সক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে ধান কেনার ব্যবস্থাকে স্বয়ংক্রিয় ও বোধগম্য করার দাবি জানাই।

সবকিছুর পরও কোনো এলাকায় ধান কাটা শ্রমিকের সংকট হলে কৃষি ও খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ধান কাটায় কৃষককে সহায়তা দিতে প্রয়োজনে সশস্ত্র বাহিনী, আনসার বাহিনী, গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী কিংবা বিজিবিকে মাঠে নামাতে হবে। বিজিবি ঢাকার রাস্তায় যান চলাচল ও নিরাপত্তা তল্লাশির মতো কাজ করতে পারলে আমাদের কৃষকের সাহায্য করতে পারবে না কেন? বাহিনীগুলো মাঠে থাকলে ছাত্র–শ্রমিক–যুবকদের প্রশিক্ষণও দিতে পারবেন।

ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব: টেকসই উন্নয়ন বিষয়ের লেখক, গ্রন্থকার, ‘চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও বাংলাদেশ’
[email protected]