ভয়ের জঙ্গলে পড়ে থাকা মায়ের মতো

টাঙ্গাইলের সখীপুরে বনে ফেলে যাওয়া বৃদ্ধাকে সোমবার রাতে উদ্ধারের পর অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকায় পাঠানো হয়। ছবি: সংগৃহীত
টাঙ্গাইলের সখীপুরে বনে ফেলে যাওয়া বৃদ্ধাকে সোমবার রাতে উদ্ধারের পর অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকায় পাঠানো হয়। ছবি: সংগৃহীত

গাজীপুরের জঙ্গল। বনের ভেতর দিয়ে অনেক সাবধানে চলাচল করতে হয়। লকডাউন চলছে। কেউ যদি দেখে ফেলে? এর মধ্যে গাড়ি-ভ্যান কিছু জোগাড় করতে হয়েছে তাদের। এই করে করে মাকে নিয়ে এসেছে তারা—বিপাকে, পরিণামে। 'মা, তুমি এই বনে এক রাত থাকো। কাল এসে তোমাকে নিয়ে যাব'—গজারিবনে ফেলে যাওয়ার সময় এ কথা বলে গেছে তারা। নারীর এক ছেলে, দুই মেয়ে ও জামাতারা মিলে তাঁকে বনে রেখে গ্রামে চলে যায়। সেই গ্রাম, যেখানে এখন রাজত্ব করছে ভয়। করোনা রোগীর ঠাঁই নেই সেখানে। রাতে বন থেকে কান্নার শব্দ শুনে কিছু মানুষ এগিয়ে যায়। পরদিন লোকমুখে শুনে উপজেলা প্রশাসন তাঁকে বন থেকে উদ্ধার করে ঢাকায় পাঠায়।

কেবল করোনা সন্দেহের শিকার হওয়া মানুষ নয়, মৃতের লাশ নিয়েও পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে স্বজনদের। অনেক ক্ষেত্রেই নিজ এলাকায় দাফন করতে দেওয়া হচ্ছে না। লাশের পবিত্র সৎকার করা যাচ্ছে না এলাকাবাসীর বাধায়।

সিরাজগঞ্জের বেলকুচিতে গত শুক্রবারে ভাত চেয়ে বকা পেয়ে আত্মহত্যা করেছে ১০ বছর বয়সী শিশু আফরোজা। করোনা ছড়ানোর ভয়ে প্রবাসীর বাড়ি আক্রমণ করছে প্রতিবেশীরা। দলীয় প্রতিপক্ষের কাটা পা হাতে নিয়ে জাতীয় স্লোগান দিয়ে মিছিল হচ্ছে। একজন ডাক্তার চিকিৎসাসেবা দিতে গিয়ে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন, আরও অনেকে আক্রান্ত। অভিযোগমতে, তাঁকে বাঁচানো যেত যদি সময়মতো ব্যবস্থা নেওয়া হতো, কিন্তু হয়নি। ত্রাণের চাল চুরির খবর প্রতিদিন আসছে।

সবাই এখন ওই মায়ের সন্তানদের নির্দয় বলবে। কিন্তু পোশাক কারখানার কর্মী ছেলেমেয়েরা নিশ্চয়ই কয়েক ঘরঅলা ফ্ল্যাটবাড়িতে থাকে না, তারা থাকে এমন খোলা গ্রামে, যেখানে অসুস্থ মানুষকে লুকিয়ে রাখার উপায় নেই। সেখানে এক ঘরে করোনা সন্দেহের রোগী নিয়ে ৫-৬ জন মানুষ থাকতে চাইলেও আশপাশের মানুষ থাকতে দেবে না। হাসপাতাল নেবে না। সরকার এগিয়ে আসবে না। আশপাশের বাসার লোকজন তাদের তাড়িয়ে দেয়। একটি পিকআপভ্যান ভাড়া করে শেরপুরের নালিতাবাড়ী যাওয়ার পথে সখীপুরের জঙ্গলে সন্তানেরা মাকে ফেলে যায়। সখীপুর থেকে নালিতাবাড়ী নেওয়াও নিশ্চয় সম্ভব ছিল না। তারা যে আশ্রয়ে যাচ্ছে, করোনা রোগী সেখানেও নিষিদ্ধ।

আদিম সময়ে মৃত্যুপথযাত্রী স্বজনকেও লোকে দৈবের ভরসায় পাহাড়ে বা নদীর পাড়ে বা জঙ্গলে ফেলে আসত। করোনার রোগীকে রাস্তায় ফেলে আসার ঘটনা একটা সংকেত যে সমাজ ভেঙে পড়ছে, মূল্যবোধে চিড় খাচ্ছে। পরম সম্পর্কগুলো ছিঁড়ে দিচ্ছে ভয়।
সব হচ্ছে ভয়ের বশে। এসব আচরণের বড় একটা কারণ প্যানিক। প্রথমে কিছু কিছু গণমাধ্যমসহ অনেকে মিলে প্রবাসীদের বিরুদ্ধে ভয় ছড়ানো হলো। অথচ সে সময় অল্পসংখ্যক মানুষ প্রতিদিন আসছিল। সংবাদমাধ্যমে, ফেসবুকে জেনে না-জেনে আমরাও অনেকে ভয় ছড়িয়েছি, নেতিবাচক খবর ছড়িয়েছি, মৃত্যুর নামতা আউড়ে চলেছি। আক্রান্তদের 'অপর' বানিয়ে দূরে ঠেলা, জীবন বাঁচানো ডাক্তারদের প্রতি কারও কারও বিরূপতার মাধ্যমে তাঁদেরও 'অপর' বানানো চলছে। স্বাস্থ্যকর্মীরা ভাড়া বাড়িতে বাড়িঅলার শাসানির মধ্যে পড়ছেন যে, তাঁরা নাকি করোনা ছড়াবেন। এভাবে চলতে থাকলে সকলেই সকলের অপর হয়ে যেতে হবে। সেটা এক কল্পনাতীত পরিস্থিতি।
ইতিবাচক উদাহরণ তৈরি করে সেসব মানুষকে জানিয়ে, তাঁদের সহায়তার জালের মধ্যে এনে এসব ঠেকানো সম্ভব। তা না করা গেলে করোনা আমাদের ভয়ের জঙ্গলে নিয়ে গিয়ে ফেলবে।

অথচ ভরসা তৈরি করা দরকার। ভয়ের ব্যবস্থাপনা থাকা দরকার। সমাজ ও ব্যক্তির মনস্তত্ত্ব বিশেষজ্ঞদের নিয়মিত গণমাধ্যমে ব্রিফিং দরকার। কিছুই কাজ করছে না তা না। চিকিৎসক সমাজ একটা সুযোগ পেয়েছেন, জান দিয়ে তাঁদের অনেকেই জীবনরক্ষীর ভূমিকা পালন করছেন। দুর্বল হলেও মোটাদাগে একটা সিস্টেম কাজ করছে। ডাক্তাররা হাসপাতালে আছেন, ময়দানে আছেন। তাঁদের সর্বতোভাবে সাহায্য করা দরকার।

পুলিশ ও প্রশাসন ত্রাণ ও অন্যান্য ব্যবস্থা নিচ্ছে। তারা যদি দাঁড়ায়, তাহলে অনেক বিপদ কাটানো যাবে। পুলিশ-প্রশাসন-চিকিৎসক ও সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা এই সময় জটিল ও গুরুত্ববহ। এদের ধার এখন অনেক বেশি, তাই সমস্যা কাটতে গিয়ে সাবধানতার ভুলে সমাধান যাতে কাটা না পড়ে, তা দেখা হলে ভালো হয়।

তারপরও প্যানিক আছে, যাচ্ছেই না। কারণ সরকারি অব্যবস্থা। বড় সংকটে যত বড় চেষ্টা লাগে, সেটা এখনো মনে হয় শুরু করা যায়নি। তবে পরিস্থিতি ঠেকা দেওয়া গেছে যেকোনোভাবেই হোক। এখনো সময় আছে ভাইরাসের আগে দৌড়ানোর।

করোনার ভয়ে মাকে সন্তানদের জঙ্গলে ফেলে আসা, খাদ্যাভাবে কিশোরীর আত্মহত্যা সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক ও অর্থনৈতিক করেছে। সমাজ ভেঙে পড়েছে। অন্তত যে সমাজ আমরা চিনতাম, তা আগের মতো থাকছে না। ত্রাণের অভাব বিরাট জনগোষ্ঠীকে রোহিঙ্গাদের মতো দিশাহীন করে তুলছে। অথচ এখনো বাংলাদেশের জাতীয় সামর্থ্য ফুরিয়ে যায়নি। খাদ্য মজুত আছে, অর্থ এখনো আছে, লোকবল আছে। কেবল দরকার ভয় কাটানোর দূরদর্শী পরিকল্পনা। মানুষ যাতে দেখতে পায় সরকার সর্বোচ্চটা করার চেষ্টা করছে। জনগণ যদি সহায়তা না করে, সরকার যদি জনগণের ভরসা না হয়, তখন যা হয় তার দুটি লক্ষণ ওপরের দুটি ঘটনা। সমাজও নেই, রাষ্ট্রও নেই—তাহলে কী হবে এত মানুষের?

সামাজিক নির্দয়তার লক্ষণগুলো ফুটে উঠছে। যেকোনো মূল্যে সমাজকে যদি জাগিয়ে তোলা না যায়, তাহলে অন্য কিছুও কাজ করবে না। পারস্পরিক সহমর্মিতা ছাড়া, সাহায্য ছাড়া মানুষ টিকতে পারে না। একা মানুষ একটা ছোট প্রাণীর চেয়েও অক্ষম। শারীরিক দূরত্ব মানে সামাজিকতার অবসান নয়। বহুভাবেই মানুষ মানুষের সহায় হতে পারে। মানুষ বাঁচাতেই হবে। যদি শরীর রক্ষার জন্য মেডিকেল সিস্টেম সীমিত সক্ষমতা নিয়েও কাজ করে, তাকে যদি সরকার সর্বতোভাবে সক্ষম করে, তাহলেই হবে। বাকিটা হলো মানুষকে খাবার দেওয়া বা কোনো না কোনো ব্যবস্থার মধ্যে আনা। সরকার ৬০ ভাগ দিলে ব্যবসায়ী-জনগণ ৪০ ভাগ দিতে পারে। মানুষ যখন জানবে যে সরকারি ব্যবস্থাই ত্রাণের জন্য উত্তম, তাহলে বেশির ভাগ মানুষ সেখানেই যা দেওয়ার দিয়ে ভরসা পাবে যে এটা সঠিক জায়গায় যাবে। মানুষকে খাবার ও চিকিৎসা যতটা পারা যায় দিলে ক্ষয়ক্ষতি অনেক কমানো যাবে।

সন্তানের দ্বারা মৃত্যুর মুখে পতিত হওয়ার দুঃখ ওই মা কীভাবে ভুলবেন? স্মৃতি থেকে যাবে। আমরাও মনে রাখছি কে কী করছি, করে যাচ্ছি। মহামারি বিশেষজ্ঞরা বলেন, মহামারির সময়কার সামাজিক-অর্থনৈতিক নির্দয়তার কথা বেঁচে যাওয়া মানুষেরা মনে করতে চান না। তাঁরা নিজেদের মুখোমুখি হতে ভয় পান। আমাদের নিজেদের মুখোমুখি হতে হবে সংকটের পরে নয়, এখনই।

বনের মধ্যে পড়ে থাকা ওই বৃদ্ধাকে উদ্ধার যারা করেছে তারাও মানুষ। কিশোরী আফরোজার পরিবারের পাশে দাঁড়াচ্ছেন অনেক মানুষ। জনসেবা করতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করা ডা. মঈন উদ্দীনও মানুষ। মানবিকতার এই সংক্রমণ দিয়েই আমরা করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে পারব, করোনার বিরুদ্ধে আপাতত আর কোনো প্রতিষেধক নেই।

ফারুক ওয়াসিফ: প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক।
[email protected]