করোনায় অনলাইন ক্লাস একটা সুযোগ

প্রাণঘাতী করোনার এই মরণ ছোবল আমাদের মাতৃভূমি বাংলাদেশের ওপর দিয়েও বয়ে যাচ্ছে। তাই বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালত এবং প্রায় সব ধরনের ব্যবসা–বাণিজ্য আপাতত বন্ধ আছে। অবশ্য হসপিটাল, ওষুধের দোকান, খাবারের দোকান এবং কাঁচা শাকসবজির দোকান সীমিত সময়ের জন্য খোলা থাকে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অর্থাৎ স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ আছে এবং ধারণা করা হচ্ছে এই বন্ধ আরও দীর্ঘায়িত হতে পারে। এমনকি এই বন্ধ ঈদুল ফিতর পর্যন্ত থাকতে পারে। শিক্ষার্থীরাও যার যার বাড়িতে, শহরে কিংবা গ্রামে অবস্থা করছে। এমতাবস্থায় শিক্ষাকার্যক্রমে মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা থাকে। সম্ভবত এই আশঙ্কা থেকেই সরকার এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে অনলাইনে ক্লাস পরিচালনা শুরু করেছে। শিক্ষাবান্ধব মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীর সরাসরি তত্ত্বাবধানে ‘আমার ঘরে আমার স্কুল’ প্রোগ্রামের আওতায় সংসদ টেলিভিশনের মাধ্যমে এই অনলাইন ক্লাস সরাসরি পরিচালিত হচ্ছে, যা দেশব্যাপী সব মহলের প্রশংসা কুড়িয়েছে।

এ পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনলাইনে ক্লাস পরিচালনা করার জন্য প্রজ্ঞাপন জারি করেছে এবং অনলাইনে শিক্ষাদানের পাশাপাশি করোনা বিস্তার রোধে প্রয়োজনীয় জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম যেমন হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরির সহজ পদ্ধতি, ব্যক্তিগত ও পারিবারিক নিরাপত্তা বিষয়ে কীভাবে কার্যকর ভূমিকা রাখা যায়, সে ব্যাপারে আলোচনা করার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশ গবেষণা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (BDRen)-এর ডেটা সেন্টারের স্থাপিত Zoom App।ication ব্যবহার করার জন্য বলা হয়েছে। ইতিমধ্যেই এই সফটওয়্যারটির লিংক এবং ব্যবহারবিধি সব পাবলিক এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। আগ্রহী শিক্ষকদের অনেকেই ইতিমধ্যে এই সফটওয়্যারটি তাঁদের কম্পিউটারে সংযোজন করেছেন এবং অনেকেই সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে অনলাইনে ক্লাস নেওয়া শুরু করেছেন। উল্লেখ্য, প্রায় সব কটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইনে শতভাগ ক্লাস পরিচালনা করে আসছে এই মহামারি করোনা শুরু হওয়ার পরপরই অর্থাৎ সরকার ঘোষিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই। সে ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন তথা BDRen–এর Zoom App।ication–এর অধীনে জুম Zoom C।assroom ব্যবহার করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনলাইনে তাদের শিক্ষাকার্যক্রম চালু করলে শিক্ষার্থীরা খুবই উপকৃত হবেন।

উল্লেখ্য, Zoom App।ication–এর অনলাইন ক্লাস, অনলাইন কনফারেন্সসহ নানা অ্যাপ্লিকেশন বিশ্বব্যাপী খুবই সমাদৃত ও জনপ্রিয়। ইন্টারনেট কানেকশন থাকলে এটি ব্যবহার করা খুবই সহজ এবং ৪০-৪৫ মিনিটের একটি ক্লাসে ১০০ জন শিক্ষার্থীর জন্য এটি একটি ফ্রি প্যাকেজ অর্থাৎ কোনো খরচ নেই। গুগল কোম্পানি বিশ্বব্যাপী এই সুযোগটি সবার জন্য উন্মুক্ত করে রেখেছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের দেওয়া অ্যাপ্লিকেশনটি প্রাইভেট ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আনলিমিটেড টাইম এবং ৩০০ জন শিক্ষার্থীর জন্য ব্যবস্থা রেখেছে, যা প্রাইভেট ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটি অফুরন্ত সুযোগ। প্রোগ্রামটির বিভিন্ন ফিচারগুলো পর্যালোচনা ও ব্যবহার করে দেখা গেছে যে এটি একটি খুবই চমৎকার এবং ইউজার ফ্রেন্ড সফটওয়্যার। অনেকটা শ্রেণিকক্ষে ক্লাস নেওয়ার মতোই, বরং আরও অনেক সুযোগ-সুবিধা আছে, যেগুলো সরাসরি ক্লাসে থাকে না। এই প্ল্যাটফর্মে ছাত্র-শিক্ষক সবাই সবাইকে দেখছেন, শুনছেন, প্রশ্ন করছেন এবং উত্তর দিতে পারছেন। প্রয়োজনে চ্যাট বক্সে যেকোনো কমেন্ট, সাজেশন ও প্রশ্ন লিখে রাখতে পারেন। সব আলোচনা-পর্যালোচনা, কমেন্ট ইত্যাদি অটোমেটিক্যালি রেকর্ড এবং ভিডিও করার ব্যবস্থা আছে। সিস্টেমটিতে অটোমেটিক্যালি একটি ওয়েব লিংক তৈরি করা যায়, যা ব্যবহার করে শিক্ষার্থীরা আলোচনাটি যখন ইচ্ছা তখন শুনতে পাবেন এবং দেখতে পাবেন। ফলে যেসব শিক্ষার্থী নির্দিষ্ট সময়ে (ইন্টারনেট ও টেকনিক্যাল প্রবলেমের জন্য) এই অনলাইন ক্লাসে সংযুক্ত হতে পারেনি, পরবর্তী সময়ে এই লিংক ব্যবহার করে তাঁরা পুরো ক্লাসটি শুনতে পাবেন ও উপকৃত হবেন।

এখানে আছে হোয়াইট বোর্ড, যেখানে শিক্ষক ‘সরাসরি ক্লাস’-এর মতোই লিখতে পারেন, ড্রয়িং করতে পারেন, বোঝাতে পারেন, মুছতে পারেন ইত্যাদি। পরবর্তী সময়ে আবার কখন, কোনো দিন, কোনো সময়, রাতে কিংবা দিনে, সন্ধ্যায় বা বিকেলে অর্থাৎ ২৪ ঘণ্টাই ক্লাসের শিডিউল করার ব্যবস্থা আছে। শুধু দরকার একটি ইন্টারনেট কানেকশন এবং একটি ডেস্কটপ কিংবা ল্যাপটপ অথবা স্মার্ট মুঠোফোন। আধুনিক এই প্ল্যাটফর্মটি ব্যবহার করতে তেমন কোনো কারিগরি দক্ষতার প্রয়োজন নেই। যাঁদের সামান্য কম্পিউটার পরিচালনা এবং ইন্টারনেট ব্যবহারের অভ্যাস আছে, তাঁদের এই প্ল্যাটফর্মে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে আধা ঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টা সময় ব্যয় করতে হবে।

আমাদের অভিজ্ঞতায় আমরা দেখেছি, শিক্ষার্থীরা অনেকেই এই প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে পরিচিত আছেন অনেক আগ থেকেই। তবে এখানে ছাত্র শিক্ষকের কাছাকাছি বা সংস্পর্শে আসতে পারেন না। পারেন না শিক্ষক ছাত্রকে সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করতে। শিক্ষার্থী এ ধরনের ভার্চ্যুয়াল ক্লাসে সংযুক্ত হন ঠিকই, কিন্তু তিনি কি কম্পিউটার কিংবা ল্যাপটপের সামনে বসে আছেন, নাকি বিছানায় শুয়ে আছেন, শিক্ষক তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। আবার শিক্ষক যেসব আলোচনা করেন, তা যে শুধু শিক্ষার্থীই শুনছেন, তা কিন্তু নয়। হয়তোবা শুনছেন শিক্ষার্থীর পাশে বসা অন্য কেউ কিংবা শিক্ষকের চেয়েও বড় শিক্ষক। তাই সংশ্লিষ্ট শিক্ষককেও অনেক প্রস্তুতি, সাবধানতা এবং সঠিক উচ্চারণ ইত্যাদি খেয়াল রেখে ক্লাস পরিচালনা করতে হয়, যা সরাসরি ক্লাসের বেলায় ততটা প্রযোজ্য নয়। তবে এই ভার্চ্যুয়াল ক্লাসের সুবিধা, উপযোগিতা এবং সর্বোপরি ব্যবহারবান্ধব পরিবেশের কারণে অনেকেই সরাসরি ক্লাসের বিপরীতে আধুনিক এই পদ্ধতির দিকে বেশি মনোযোগী হয়ে যেতে পারেন।

দেশের উচ্চশিক্ষার পরিস্থিতি জানার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যদি ইচ্ছা করেন যে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্যদের সঙ্গে মিটিং করবেন, তাহলে এই পদ্ধতিতেই তা করা সম্ভব। কারণ, এই মহামারির সময় ঢাকায় এসে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে মিটিং করা বাস্তবসম্মত নয়। ধরুন, কোনো উপাচার্য যদি মনে করেন যে বিভাগের চেয়ারম্যানের সঙ্গে মিটিং করা দরকার কিংবা একাডেমিক কাউন্সিল বা সিন্ডিকেট মিটিং দরকার, তাহলে বর্তমান এই দুর্যোগকালে ভার্চ্যুয়াল মিটিংই একমাত্র পথ। কারণ, এখানে ৩০০ জন সদস্য একসঙ্গে যতক্ষণ ইচ্ছা ততক্ষণ আলোচনায় বসতে পারেন। এ ছাড়া আমাদের আছে রমজান মাসের ছুটি, পূজার ছুটি, গ্রীষ্মকালীন ছুটি, শীতের ছুটি, নির্বাচনের ছুটি, পরিবহন ধর্মঘট এবং অঘোষিত আন্দোলনের ছুটি এবং শিক্ষার্থীরা তখন যাঁর যাঁর ঘরে অবস্থান করে থাকেন। এসবের কারণে বছরে প্রায় চার মাস অর্থাৎ এক–তৃতীয়াংশ সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকে। এই সময়গুলোতে শিক্ষার্থীদের সরাসরি ক্লাসের বিকল্প হিসেবে অনলাইন ক্লাসের মাধ্যমে পাঠদান দেওয়া যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে জুম ক্লাসরুমের মতো প্ল্যাটফর্মের কোনো বিকল্প নেই। সর্বোপরি এ রকম একটি সহজ ও সহজলভ্য আধুনিক ডিজিটাল পদ্ধতিতে আমরা নিজেদের খাপ খাইয়ে নেওয়ার এখনই উত্তম সময়।

আমরা বাংলাদেশিরাও এই যুদ্ধের সঙ্গে লড়াই করে চলছি। কর্মহীন খেটে খাওয়া মানুষগুলোর অবস্থা খুবই খারাপ। ছোট ছোট ছেলেমেয়ে, পরিবার-পরিজন নিয়ে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাচ্ছে। কিন্তু সচেতন ছাত্র সমাজ কি বসে থাকবে? না। কারণ, বাংলাদেশের সব যুদ্ধে এ দেশের ছাত্র সমাজের ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। লেখাপড়ার পাশাপাশি করোনা বিস্তার রোধে বিভিন্ন জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম নিয়ে গ্রামগঞ্জে অসহায় মানুষের পাশে থাকবে তারা। তাই দল-মত নির্বিশেষে এবং বিত্তবান সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে এই দুর্যোগকালে দিনমজুর, অসহায়, গরিব দুঃখী মানুষের পাশে দাঁড়াতে এবং সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি।

ড. এম মেসবাহউদ্দিন সরকার, অধ্যাপক ও পরিচালক, ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন টেকনোলজি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।