দুঃসময়ে পোশাকশ্রমিকদের পাশে থাকুন

চাকরি বাঁচানোর তাগিদে ফেরিতে গাদাগাদি করে কর্মস্থলে এভাবেই ফিরছিলেন হাজারো মানুষ
চাকরি বাঁচানোর তাগিদে ফেরিতে গাদাগাদি করে কর্মস্থলে এভাবেই ফিরছিলেন হাজারো মানুষ

এটা আশাব্যঞ্জক যে ৩৫ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক খাতের করোনা-অস্থিরতায় রাশ টানার একটা সময় এসেছে। মালিক ও শ্রমিকদের মধ্যে যে দূরত্ব তৈরি হয়েছিল, তা প্রশমনের মতো একটা অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। শ্রমিকদের তিনটি সংগঠন (বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কার্স ফেডারেশন, বিআইজিইউএফ ও বিসিডব্লিউএস) ১২ এপ্রিল ছয় লাখ শ্রমিকের পূর্ণ বেতন দাবি করেছিল ঈদের আগেই। এর উত্তরে বিজিএমইএ ১৪ এপ্রিল নববর্ষের প্রথম দিনে বলেছে, এপ্রিলের মজুরি সরকারি ব্যবস্থাপনায় শ্রমিকের ব্যাংক হিসাবে যাবে। মে ও জুনের বেতনও তাঁরা যথাসময়ে পাবেন। এখন সরকারের উচিত হবে মালিক-শ্রমিক সম্পর্কের দূরত্ব কমিয়ে আনতে একটা অনুঘটকের ভূমিকা পালন করা। 

তিন সংগঠন বলেছে, ১০ হাজারের বেশি শ্রমিক ছাঁটাই হয়েছে। বিজিএমইএ সংগঠন হিসেবে অন্তত এই প্রশ্নে দৃশ্যত সংবেদনশীল থেকেছে। করোনার কারণে তারা ছাঁটাই চায় না। এটা না করতে তারা তাদের সদস্যদের প্রতি ‘অনুরোধ’ রেখেছে। বরং ‘বেআইনি ছাঁটাইয়ের’ তথ্য জানতে চেয়েছে তারা। তবে যেখানে সরকারের হস্তক্ষেপ লাগবে, সেটা হলো লে-অফে পড়া শ্রমিকদের সুরক্ষা দেওয়া। এই মুহূর্তে বেআইনি ছাঁটাই এবং আইনি ছাঁটাই (লে-অফ) থেকে সব শ্রমিককে রক্ষা করাই সরকারের পরম দায়িত্ব। এটা রাজনৈতিক প্রশ্ন। লে-অফের বিষয়টিকে বিজিএমইএ কেবলই আইনের চোখে দেখেছে। তারা বলেছে, শ্রম আইনের ১২(১) ধারা তাদেরকে মহামারিতে কারখানা বন্ধ রাখার অধিকার দিয়েছে। এই ‘বন্ধের সময়ে’ শ্রম আইনের ১৬(২) ধারা বলেছে, ‘ক্ষতিপূরণের পরিমাণ হবে সংশ্লিষ্ট শ্রমিকের মোট মূল মজুরির অর্ধেক এবং আবাসিক ভাতার পুরোটাই।’ মালিকেরা বলছেন, শ্রম আইনে ‘সাধারণ ছুটি’ বলতে কিছু নেই। 

প্রলম্বিত ‘সাধারণ ছুটি’ আসলে প্রচলিত আইনও সমর্থন করে না। তাই অপ্রথাগত করোনাকালের ছুটিতে প্রথাগত লে-অফ চলতে পারে না। তিন শ্রমিক সংগঠন সম্ভবত আইনসচেতন ছিল। তাই তারা লে-অফ শ্রমিকদের পূর্ণ বেতন দিতে শ্রম মন্ত্রণালয়, বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর প্রতি ‘দাবি ও অনুরোধ’ জানিয়েছে। করোনা থেকে বেঁচে গেলেও এক বছরের কম সময় চাকরিতে থাকা অন্তত ৬ লাখ শ্রমিক চাকরি হারাবেন। লে-অফে তাঁরা ওই অর্ধেক মজুরিও পাবেন না। 

৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনার বিষয়ে বিজিএমইএ বলেছে, এটা বেইল আউট নয়। দুই বছর পরে ২ শতাংশ খরচাসহ ফেরত দিতে হবে। বিজিএমইএ প্রশ্ন তুলেছে, লে-অফ কেন বেআইনি হবে? এর উত্তর হলো লকডাউনে ছুটি ও লে-অফ দুটোই তাদের চরিত্র হারিয়েছে। তাই রাষ্ট্রীয় ছুটির আর্থিক দায় রাষ্ট্রকেই ঠিক করতে হবে। 

‘ছুটি’তে গ্রামে গিয়ে ঝুঁকি নিয়ে, হেঁটে পোশাককর্মীদের ঢাকায় ফেরা ছিল আইনের শাসন বিচ্যুতির চূড়ান্ত নিদর্শন। এর মূল দায় সরকারের। তিন সংগঠন অবশ্য বলছে, ২৬ মার্চ থেকে ১০ দিনের ছুটি ঘোষণার পরে বিজিএমইএ বলেছে, এই ছুটিতে তারা নেই। স্বাস্থ্যবিধি মেনে কারখানা খোলা রাখতে পারে। বাস্তবে বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ মালিকদের কারখানা বন্ধ রাখার অনুরোধ করেছিল। তবে ৭০০-৮০০ কারখানা সেই অনুরোধ রাখেনি। এই ‘সমন্বয়হীনতায়’ ৩–৪ এপ্রিল শ্রমিকেরা গ্রাম থেকে কর্মক্ষেত্রে ছুটলেন। ঘটল একটা বিপর্যয়। 

তিন সংগঠনের দাবিমতে, প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা সত্ত্বেও ২৬ মার্চের পরে ‘বেশির ভাগ’ কারখানা খোলা থাকে। পরে ‘বেশির ভাগ’ কারখানা লে-অফে যায়। আবার ৫ এপ্রিলেই কারখানায় যোগ দিতে নির্দেশও দেন। তীব্র সমালোচনার মুখে ৪ এপ্রিল রাত ১০টার পরে ৫ থেকে ১১ এপ্রিল মালিকেরা সাধারণ ছুটি দেন। প্রধানমন্ত্রী দ্বিতীয়বার নির্দিষ্টভাবে পোশাক কারখানা বন্ধের (জরুরি রপ্তানিমুখী ও পিপিই নির্মাতা ছাড়া) নির্দেশ দেন। এরপর কিছু কারখানায় ছুটি, বেশির ভাগে লে-অফ অব্যাহত এবং কিছু কারখানায় ৩১ মার্চেও কাজ চলে। 

এখন বিজিএমইএ বলছে, সদস্যদের কারখানা বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আইনগত কর্তৃত্ব তাদের নেই। কারখানা খোলা রাখা বা না রাখার সিদ্ধান্ত মালিকের। তার মানে রাষ্ট্রীয় ছুটিতে কারখানা খোলা রাখা বা লে-অফ করার জন্য মালিকেরা ব্যক্তিগতভাবে জবাবদিহি করবেন। 

বিজিএমইএ সভাপতি রুবানা হক ২০ মার্চ শ্রম প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ানের কাছে একটি পত্র লিখেছিলেন। তাতে তিনি ‘শ্রমিকদের উৎপাদনে রাখলে সকলের জন্য তা মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি’ তৈরি করবে বলে সতর্ক করেছিলেন। পোশাকশিল্প রক্ষায় ‘সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা’ চেয়েছিলেন। 

২১ ও ২২ মার্চ শ্রম প্রতিমন্ত্রী যথাক্রমে মালিক ও শ্রমিক পক্ষের সঙ্গে সভা করেছিলেন। তাঁরা তখন সবাই পোশাক কারখানা খোলা রাখতেই সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নেন। ২৪ মার্চ জনপ্রশাসনের প্রজ্ঞাপন বলল, রপ্তানিমুখী শিল্পকারখানা চালু রাখা যাবে। ঠিক পরদিনই ২৫ মার্চ সরকার সবার জন্য সাধারণ ছুটির ঘোষণা দিল। প্রথমে ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল, সর্বশেষ ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত বর্ধিত হলো। তাই ২২ মার্চ শ্রমিকদের দেওয়া কাজ করার ওই সম্মতি অকার্যকর করেছে রাষ্ট্র। তাই আমরা উভয় পক্ষের উল্লিখিত যুক্তিতর্কের মধ্যে সরকারের সিদ্ধান্তহীনতাকেই বড় করে দেখি। কলকারখানা অধিদপ্তর ১ এপ্রিল একটি ‘স্পষ্টীকরণ’ নির্দেশনা জারি করেছিল। কারখানা খোলা রাখার পক্ষে এটাকে মালিকেরা যুক্তি হিসেবে দাঁড় করাতে পারবেন। কারণ, তাতে পরিষ্কার লেখা হলো, শ্রমিকদের সুরক্ষা দিন। এরপর যাদের ‘আন্তর্জাতিক ক্রয়াদেশ’ আছে, যাঁরা পিপিই, মাস্ক প্রস্তুত করে চলছেন, তাঁরা খোলা রাখুন। এখানেই শেষ নয়। মালিকদের একটি খোলা লাইসেন্সও দেওয়া হলো। বলা হলো, ‘যাঁরা শিল্প–কলকারখানা সচল রাখতে আগ্রহী’, তাঁরা কারখানা চালু রাখবেন। তাহলে আর বাকি থাকল কী? সব সরকারি-বেসরকারি অফিসে সাধারণ ছুটির মধ্যে ১ এপ্রিল ওই চিঠি জারি হলো কী করে? 

২০১২ সালের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং ২০১৮ সালের সংক্রামক আইন মহামারিতে ছুটি চেনে না। লে-অফ চেনে না। লকডাউন চেনে না। চেনে ‘দুর্গত এলাকা ঘোষণা।’ এ সংক্রান্ত সরকারি ঘোষণায় যা যা বলা থাকবে, দুর্যোগকালে তা দেশে প্রচলিত সব আইনের ওপরে প্রাধান্য পাবে। জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কাউন্সিলের সভাপতি সরকারপ্রধান। এই আইনের ৩২ ধারার আওতায় তহবিল হোক। ‘ছুটিকালে’ সব শ্রমিকের ক্ষতি মেটানো হোক। আসলে আইন অনুসরণ না করে গোটা রাষ্ট্রযন্ত্রই একটা অদ্ভুত সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগেছে। জাতি হিসেবে আমরা পরিপক্বতার পরিচয় দিচ্ছি না। 

মহামারিতে দল বেঁধে গ্রামে ছুটি কাটাতে যাওয়া, ‘চাকরি হারানোর ভয়ে’ ৫ এপ্রিলে কাজে যোগ দিতে আসা, আবার মার্চের বেতন পেছাতেই মালিকদের বিরুদ্ধে ছুটি ঘোষণার অপবাদ দেওয়ার মধ্যে একটা স্ববিরোধিতা আছে। আবার বিজিএমইএর দাবি, মালিকেরা প্রথম
ছুটির নোটিশে শ্রমিকদের ‘ঢাকায় যাঁর যাঁর বাসায়’ (২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল) থাকতে বলেছিল। এমনকি ‘সামাজিক দূরত্ব’ মানতে বলেছিল। সেই মালিকেরা যখন কারখানা খোলা রাখা বা লে-অফের সপক্ষে আইনের দোহাই দেবেন, তখন তার মধ্যেও একটা স্ববিরোধিতা ফুটে উঠবে। 

এ ধরনের স্ববিরোধিতাই বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের মর্যাদাকে ম্লান করেছে। তবে গত দুই দিনের ব্যবধানে জারি হওয়া মালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলোর দুটি দীর্ঘ বিবৃতি আমাদের আপাতত আশাবাদী করেছে। কারণ, জুন পর্যন্ত বেতন সমস্যা মিটেছে। এখন লে-অফই জ্বলন্ত বিষয়। গত এক দশকে পোশাকশ্রমিকেরা আমাদের যথেষ্ট দিয়েছেন। তঁাদের ভীষণ দুঃসময়ে রাষ্ট্রের ঋণ শোধের সময়। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, যতটা সম্ভব সুরক্ষা নিশ্চিত করে কারখানা চালানোর বিষয়টি ভাবা যেতে পারে। আন্তর্জাতিক ক্রয় আদেশপ্রাপ্তদের মধ্যে যঁারা এটা চাইবেন, হতে পারে আরও ভেবেচিন্তে, হয়তো সীমিতভাবে সেই উদ্যোগ নেওয়া যায়। তিন (মার্চ-মে) মাসে ৪.৯ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি হ্রাস এবং আরও ১.৯৬ বিলিয়ন ডলারের নিষ্পন্ন না হওয়া দায়ের মুখোমুখি বিজিএমইএ। মাত্র ১৬ ভাগ বেতন, অবশিষ্টের প্রায় ৭৫ ভাগই আমদানি দায়। 

তৈরি পোশাক খাতে একটি উচ্চপর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ দরকার। যার লক্ষ্য থাকবে উভয় পক্ষকে প্রকাশ্যে বাক্‌ ও বিবৃতিযুদ্ধ থেকে নিবৃত্ত করা। 

মিজানুর রহমান খান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক