ওরা কি দৃষ্টির অন্তরালে চলে যাচ্ছে

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

সারা পৃথিবীর দৃষ্টি এখন করোনাভাইরাস মোকাবিলার দিকে। এটিই যথার্থ দৃষ্টি। ধনী, দরিদ্র, সাদা, কালোনির্বিশেষে সব দেশের সব মানুষই করোনাভাইরাসের সর্বগ্রাসী আক্রমণের শিকার। এই কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে; সবার জন্যই সমান উদ্যোগ ও চেষ্টা নিতে হবে। প্রতিটি দেশকে এখন দুটি ক্ষেত্রে সংগ্রাম করতে হচ্ছে। প্রথম ক্ষেত্রটি স্বাস্থ্যগত, দ্বিতীয়টি অর্থনৈতিক। স্বাস্থ্যগত ক্ষেত্রে সব মানুষ কি করোনাভাইরাস রোধের ক্ষেত্রে এবং আক্রান্ত হলে চিকিৎসার ক্ষেত্রে সমান সুযোগ ও সুবিধা পাচ্ছে? দরিদ্র, অসহায়, বিত্তহীন, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী কি সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার সুবিধাগুলো এত দিন পেয়ে এসেছে? এখনো কি পাচ্ছে? এই মানুষেরা যে দৃষ্টির অন্তরালে চলে যাচ্ছে, এটা তুলে ধরাই আমার আজকের লেখার বিষয়।

করোনা মহামারির প্রভাব অর্থনীতিতে নিশ্চিতভাবে পড়ছে; সামনের দিনগুলোতে তা আরও প্রকটভাবে দেখা দেবে। বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক প্রণোদনা প্যাকেজ কি এসব ব্যক্তির জন্য বিশেষভাবে প্রযোজ্য? রোগব্যাধির ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে রোগীদের চিকিৎসার জন্য triage শব্দটি ব্যবহার করা হয়। অর্থাৎ যেসব রোগীর অবস্থা বেশি খারাপ, তাদের আলাদাভাবে বিশেষ চিকিৎসা দেওয়া। বিদেশের হাসপাতালগুলোতে এখন এই শব্দটির ব্যবহার দেখা যাচ্ছে। অর্থাৎ, তারা বেশ জটিল রোগীদের বিশেষ চিকিৎসা দিচ্ছে। বাংলাদেশে যদিও triage শব্দটির ব্যবহার দেখা যাচ্ছে না, তবে অলিখিতভাবে এটির ব্যবহার হচ্ছে ঠিক উল্টো অর্থে। অর্থাৎ দরিদ্র অসহায় মানুষেরা চিকিৎসাসেবা ও অর্থনৈতিক প্রণোদনা পাওয়ার ক্ষেত্রে বঞ্চিত হচ্ছে। তারা নীতিনির্ধারক, সরকারি আমলা, সচ্ছল ব্যবসায়ী, সচ্ছল চাকরিজীবী এমনকি সাহায্য সংস্থার দৃষ্টির অন্তরালে।

এবার আসা যাক অর্থনৈতিক বিষয়গুলোর দিকে। বৈশ্বিক আর্থিক খাতে ও বিশ্ব অর্থনীতির মন্দা শুরু হয়েছে আমেরিকা থেকে, ২০০৮ সালের প্রথম দিকে। এর প্রভাবে সারা পৃথিবীতে অর্থনৈতিক মন্দা ছড়িয়ে পড়েছিল। বাংলাদেশও সেই প্রভাবের বাইরে ছিল না। এবারের করোনার প্রভাবে অর্থনৈতিক মন্দা হবে আরও ব্যাপক ও দীর্ঘস্থায়ী। ইতিমধ্যে বিশ্বমন্দার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। বাংলাদেশ সরকার ইতিমধ্যে অর্থনৈতিক প্যাকেজ গ্রহণ করেছে। এটা নিঃসন্দেহে ভালো উদ্যোগ; এর ইতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে আমরা আশাবাদী। কিন্তু বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এটা হবে একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ। প্রথমত, অর্থনৈতিক প্রণোদনাগুলো ব্যাংকনির্ভর। দ্বিতীয়ত, এগুলো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠাননির্ভর ও আমলানির্ভর। বাংলাদেশে ব্যাংক ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের দুর্বলতা সম্পর্কে আমরা জানি। তা ছাড়া রয়েছে দক্ষ, কর্মঠ, সৎ ও নিষ্ঠাবান লোকের অভাব। সর্বোপরি রয়েছে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাব। সরকারি কার্যক্রমগুলো দরিদ্র, সহায়হীন, ভাষাহীন মানুষসহ আপামর জনসাধারণের উপকারে ঠিকভাবে পৌঁছাবে কি না এবং এ বিষয়ে সরকারের সদিচ্ছা কতটা থাকবে, সে বিষয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। অপেক্ষাকৃত বড় ব্যবসায়ী, সমাজে প্রতিষ্ঠিত ও ক্ষমতার কাছাকাছি ব্যক্তিদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্যই বেশি সুবিধা পৌঁছাবে বলে প্রতীয়মান হয়।

পোশাকশিল্পের শ্রমিকসহ প্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের জন্য প্রণোদনা আছে। কিন্তু বাংলাদেশের অধিকাংশ শ্রমিকই অপ্রাতিষ্ঠানিক, যাঁরা কাজ করেন নানা অনানুষ্ঠানিক খাতে (informal sector)। বহু দিনমজুর, অস্থায়ী শ্রমিক ছোট দোকান ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে নির্দিষ্ট মজুরিতে কাজ করেন। তাঁদের জন্য কি কোনো সরকারি প্যাকেজ আছে? এখন তাঁদের আয়ের উৎস বন্ধ, কিন্তু তাঁদের ক্ষুধার জ্বালা কি থেমে গেছে? যেসব প্রবাসী শ্রমিক বিদেশে আটকে আছেন, তাঁদের অনেকের বেতনও সেখানে বন্ধ। তাঁদের পরিবার যারা দেশে আছে, তাদের আয়ের সংস্থান কোথায়? তাঁদের সংসার কীভাবে চলছে? এসব প্রবাসী শ্রমিকের জন্য প্যাকেজ কে দেবে? কৃষিশ্রমিকেরা কীভাবে ক্ষুধা নিবারণ করবেন?

পৃথিবীর কল্যাণমুখী দেশগুলোর মতো এ দেশে সামাজিক নিরাপত্তা ও বিমাব্যবস্থা নেই। তাই এখন সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির পরিসর বাড়িয়ে দুস্থ, অসুবিধাগ্রস্ত লোকদের সাহায্যের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সনাতনী সরকারি বাজেটের আওতায় এটা করা যাবে না। দুই বছরমেয়াদি একটি কর্মপরিকল্পনা নেওয়া হোক, পরবর্তী সময়ে সেটাকে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সঙ্গে যোগ করা যেতে পারে।

কতগুলো প্রশ্ন রয়ে গেছে। বিত্তহীন, দরিদ্র, সুবিধাবঞ্চিত খেটে খাওয়া মানুষেরা কাজ হারিয়ে এখন কোথায়? তাঁরা ক্ষুধা নিবারণ করছেন কীভাবে? যৎসামান্য কিছু ত্রাণসামগ্রীর প্যাকেট পেয়ে? কোথায় পোশাকশিল্পের সেই সব কর্মী, যাঁরা এখনো বেতন পাননি? কোথায় সেসব পোশাককর্মী, যাঁরা ৫ এপ্রিল ঢাকায় কাজে যোগ দিতে এসে হতাশ হয়েছেন, কিন্তু যাঁদের ফিরে যেতে বাধা দেওয়া হয়েছিল তাঁরা এখন কোথায় থাকছেন, কী খাচ্ছেন? এই মানুষেরা কোথায় মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন? তাঁদের সামনে কেবলই কি অমানিশার অন্ধকার?

বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের প্রধান দুটি কারণের একটি ছিল অর্থনৈতিক মুক্তি (সমতা ও ন্যায়ভিত্তিক অর্থনীতি), অন্যটি ছিল রাজনৈতিক স্বাধীনতা। এই দুটি বিষয় অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। এখনই সময় মানুষের সব অধিকার নিশ্চিত করার; বিশেষত মানবিক মর্যাদার সঙ্গে বাঁচার অধিকার। ইংরেজ কবি জন ডান অনেক আগেই লিখে গেছেন:

Each man’s death diminishes me,

For I am involved in mankind.

Therefore, send not to know

For whom the bell tolls,

It tolls for thee.

সমাজের কাউকেই পেছনে ফেলে রাখা যাবে না। সবার জন্য একদিন ‘শেষ পরিণতির দিন’ আসবে।

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর